কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

প্রদীপ চক্রবর্তী


সমকালীন ছোটগল্প 


হোম মানে বাড়ি মানে মা


আমি ‘অনাথবন্ধু হোমে’ থাকি। রাস্তার দিকের বড় দরজাটার উপরে সিমেন্ট দিয়ে বড় বড় করে ইংরাজি হরফে লেখা ‘অনাথবন্ধু হোম’। তার নীচে ছোট হরফেও কিছু লেখা ছিলো - এখন তার উপর আলকাতরা লেপে দেওয়া হয়েছে। এখন  শুধুই ‘অনাথবন্ধু হোম’। হোম মানে বাড়ি।

আমি শুরু থেকেই, মানে আমার জ্ঞান হওয়া থেকেই এখানে। অফিসঘর, স্টোর আর চারটে বড় বড় ঘর আছে আমাদের থাকার জন্য। এখন মানে আজ আমরা বাইশজন আছি। সংখ্যাটা কখনও কমে, কখনও বাড়ে। সাধারণত বাড়ে, কমে না। গত দুর্গাপুজোর আগে ঢাকুকে একটা পরিবার দত্তক নিয়েছে। সবাই বলে,  ঢাকু নাকি লাকি। ঢাকুরিয়াকেই ছোট করে ঢাকু ডাকা হয়। ওকে ঢাকুরিয়া লেকের পাড় থেকে পাওয়া গিয়েছিলো। আমার নাম আদু। আদাড় থেকে আদু। আমার জন্ম নাকি আদাড়ে। এইরকম নামেই  সবাইকে ডাকা হয়। কারও কারও কপালে আবার সৌখীন নামও জুটে যায়। পদ্ম ডেনড্রাইট চাটছিলো পদ্মপুকুরের ধারে বসে। পুলিস ধরে হোমে দিয়ে দিলো। ওর নাম হলো পদ্ম।

আনন্দমাস্টার ইস্কুলে আসার পর আমার নামটা আদাড় থেকে আদু হলো। তবে নামের আবার খারাপ ভালো কি? এনিয়ে আমার কোন কষ্ট কখনও হয়নি।  আনন্দমাস্টার প্রথম দিনেই সবাইকে বলে দিলো, আমাকে দাদা বলবে সবাই।
দাদা আমাদের বাংলা আর ইংরাজি শেখায়। জল পড়ে পাতা নড়ে থেকে ওয়ান মর্ন আই মেট এ লেম ম্যান পর্যন্ত সবই দাদার কাছ থেকে শেখা। দাদা যখনই বুঝতো আমরা বোর হচ্ছি, বলত্‌ এবার ড্রইংএর ক্লাস হবে। আমরাও আঁকাজোকা শুরু করে দিতাম। আমাদের আঁকা টিয়ানপাখি, টমেটো, প্রজাপতি সেদিন ক্লাসঘরের দেওয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। দাদার ক্লাস মানে সবার আনন্দ।
আর একটা দিনও খুব মজার - শিশু দিবস। কত লোকজন আসে। ফিলিম আর্টিস্টরা। হিরো-হিরোয়িনরা আমাদের কেক বিস্কুট টিশার্ট দেয়। তারপর বড়বাবুর অফিসে বসে চা খায়। সিগারেট খেতে খেতে গল্প করে। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিই। অতিথিদের সবাইকে থ্যাঙ্কিউ আন্টি, থ্যাঙ্কিউ আঙ্কল বলতে শিখিয়ে দিয়েছিলো বড়বাবু। হিরোইন হিমানি আমার গাল টিপে বলে - উঁহু, আন্টি না, দিদি। সেই হিমানিদিদিকে সিগারেট খেতে দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কেন কে জানে!

শুক্রবার দিন বিকেল চারটে বাজলেই আমি অফিসঘরের দিকে পা বাড়াই। ঐ দিনটা ভিজিটরদের দিন। সেপাইচাচা ঠাট্টা করে বলে, অনাথদের আবার ভিজিটর! গোরুর গাড়ির হেডলাইট! খুব মজার মজার কথা বলে চাচা। কিন্তু আমাদের ঠনঠনের সঙ্গে দেখা করতে ওর মাসী মাসে দু-একবার আসে। নাম শুনে ঠনঠনের জন্মস্থান বোঝা যায়। আমার নামটা শুনেও যদি জায়গাটা বোঝা যেত, তাহলে একবার খোঁজ করে দেখতাম আমার মায়ের। আগে খুব রাগ হতো, কিন্তু আনন্দদাদা বুঝিয়েছে অনেক। রাগবি না! না জেনে না বুঝে রাগতে নেই। না দেখেও বোধহয় রাগতে নেই।

একটা বাড়ির ছবি আঁকতে  দিয়েছিলো দাদা। ‘অনাথবন্ধু হোম’ এঁকে  দেখিয়েছিলাম। ক্লাসের সবার ভালো লাগলেও দাদা বললো, কিছু হয়নি, এটা তো হোম! আমি বিড়বিড় করে বললাম, হোম মানেই তো বাড়ি, দাদা! অনেকক্ষণ চুপ থেকে দাদা আমাদের বুঝিয়েছিলো, বাড়ি শুধু চুন-সুরকি-সিমেন্ট বা দরজা-থাম নয়, আরও কিছু।

ঠনঠনের মাসী ওর জন্যে গুড় বাদাম মুড়ি নিয়ে আসে। আমাদেরও জোটে ভাগ। একদিন দেখি ঠনঠন ভিজিটরদের বেঞ্চে শোওয়া, মাসীর কোলে ওর মাথা। ঠনঠনের কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এক হাতে, আর অন্য হাতে চোখের জল আড়াল করছে। বড়বাবু সেপাই চাচাকে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে, চাচা খিক খিক করে হাসে। এতে হাসির কী হলো, বুঝতে পারি না। কিন্তু ওর মাসির জন্য কষ্ট হয় আমার।

আনন্দদাদার বদলির সময় হলো। দাদা না থাকলে ইস্কুলে কি মন বসবে? জানি না। ফেয়ারওয়েলে সব ছাত্রদের উনি বললেন, তোমাদের নিজের হাতের আঁকা বা  তৈরি করা ফুল, মূর্তি যে যা পারবে আমাকে বানিয়ে দেবে। আমি যত্ন করে রেখে দেবো।

সবারই মন খারাপ এবং শঙ্কিত এই ভেবে, পরের মাস্টার যদি খুব রাগী হয়! বড়বাবু বললো, ভালো ভালো কথা। দাদা সামান্যই বললো, কিন্তু আমাদের  সবাইকে একজন করে ডেকে কাছে নিয়ে আদর করলো, যে যা তৈরি করে দিয়েছে তার প্রশংসা করলো এবং ভুল থাকলে তা নিয়েও কথা বললো। আমার কান্না পাচ্ছিলো। সবার শেষে দাদা আমাকে ডাকলো। আমার ছবিটা শুধু নিজেই দেখলো তা নয়, সবাইকে দেখালো উঁচু করে ধরে। কুয়াশার ভিতর দিয়ে একটা বাড়ি আর সেই বাড়ির উপর জলছবির মত একটা মা’এর মুখ। আমি তো মা’কে দেখিনি, ঠনঠনের মাসিকে দেখেছি, তো সেই মুখটাই হুবহু তুলে দেবার  চেষ্টা করেছি।

দারুণ এঁকেছিস। দেখলি তো?
হ্যাঁ, হোম মানে বাড়ি, মানে মা।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন