যাত্রা
গতরাতে মিমি প্রায় জেগেই কাটিয়েছে। বড় জ্যাঠিমা বাচ্চাদের
জন্যে মাঝের ঘরে ঢালা বিছানা পেতেছিলেন, সেদিকে তাকিয়ে মিমির ছেলেবেলায় বম্মার
সঙ্গে ঘুমানোর কথা মনে পড়ছিল। কত গল্প বলতেন বম্মা!
সেজজ্যাঠা মারা যাবার পরপরই হঠাৎ করে বম্মার বয়স সকলের চোখ
খোঁচাচ্ছিল। দু’জনেই
বিছানা নিয়েছিলেন। ‘শক্তপোক্ত লোকটা ডেঙ্গির ধকল তিনদিনও সইতে পারল না অথচ
বুড়ির দম দেখ! হপ্তা না যেতেই বিছানা ছেড়ে সটান দাঁড়িয়েছে। নিজের হাতে দুধ জ্বাল
দিয়ে রুটির টুকরো ভিজিয়ে গুড় মিশিয়ে খাচ্ছে আবার সেজ বৌমাকেও হবিষ্যির নিয়ম
শেখাচ্ছে!’ আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি সব্বার মুখে একই কথা ফিরছিল।
বম্মা এসব গ্রাহ্য করতেন না বরং সেজ জ্যাঠিমাকে সান্ত্বনা
দিতে দিতে সত্যই দুধে রুটি ভিজিয়ে বলতেন, “মাইন্ন্যা লও গো বউমা। সেই তের বৎসর থনে
সাদা থান। ওদেরে তো আমিই কোলেপিঠে মানুষ করসি। রত্নারে যখন
কর্কট রোগে ধইরলো, ছোটন আর সেইজ্জা দুইটাই এত্তটুকুন দুধের শিশু। মায়ের দুই পাশ
দিয়া মাই টানে আর রত্নার চক্ষু যেন শ্রাবণ মাসের কুল ছাপাইন্না নদী! আমিই কইলাম, ‘ও মিলন একটা
ছাগী কিন্, বিয়াইন্না ছাগী’। গরুর দুধ অগো পেটে সইতো না
- এমনই কাঁচা বয়স। ছাগীর দামও আমিই দিলাম। বাবায় সোনায়
মুড়াইয়া কন্যাদান করসিলো। এই জমিনও। বাড়ি উঠানের সময়ে শ্বশুরমশাইরে থোক টাকাও
দিসিলেন। এক বত্সরের মাথাতেই সিঁথি বিরান। শাকপাতার জীবন মাইন্যা নিসি না? কপালের লেখন
খন্ডান যায় না’। তারপরেই ল্যাতপ্যাতানো রুটির শেষ টুকরোটা অতি যত্নে মুখে চালান
দিয়ে শ্বাস ফেলে বলতেন, ‘পেটে ধইরলেই জননী হয় না গো মা’।
বাড়ির অন্য মেয়েরা কেউ আসেনি। চিতা ধোয়ার পরে
একটু বেশি সময় নিয়ে আসবার পরিকল্পনা ওদের। শ্রাদ্ধেও থাকা হবে আবার গায়ে হাতে আরামও খেলানো যাবে। জ্যাঠতুতো
বোন চুমকি বেশ জ্ঞান দিয়েছিল মিমিকে, ‘বাংলা সিনেমার স্বভাবটা তোর গেল না। ওখানে পা
ফেলার জায়গা নেই। ভ্যাপ্সা গরমে এসি ছাড়া- উফফ! হোটেলে উঠলেই মেজজ্যাঠা ধম্মসভা
বসাবে। তাছাড়া
বুড়ির শোধও নেই।’ মিমি’র মুখ বিস্বাদ হয়ে
গিয়েছিল। মনে মনে ভাবছিল ছেলেবেলায় বাড়িতে কেউ এলে কী খুশিই না হ’ত ওরা সবাই!
উনি ঠোঁট ফাঁক করলেন। কিছু বলতে চান কি? মিমি কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকলো, ‘বম্মা!’ দরজার
কাছ থেকে ছোটকা’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কৃষ্ণ নাম নেন জ্যাঠাইমা। আপ্নের লাইগা সেজদা, বাবা মা, জ্যাঠামশাই হক্কলডি সগগের
দুয়ারে খাড়াইয়া আসে। যাত্রা করেন এবার’।
ছোটকা’র কথায় সেজ জ্যাঠার
মৃত্যুর ঘটনা ফের তাজা হ’ল যেন। মৃদু ফিসফাস ক্রমশ জোরদার আওয়াজে পাল্টাচ্ছে। বেশ
রসিয়ে বম্মার নিয়ম করে ঘন দুধের সর খাওয়ার গল্প করতে লাগলেন সেজ জ্যাঠিমা। এই বাড়ি কিংবা বাবা, জ্যাঠা,
ছোটকা’ সবাই বম্মার দানে বেড়েছে; আশ্চর্য সেই কথা কেমন দিব্যি ভুলে গেছে সবাই! চোখ
বেয়ে জল গড়ায় মিমির।
মাথার উপরে ফ্যানের হাওয়া ঘুরে
ঘুরে অদ্ভুত এক অসুখের গন্ধ ছড়াচ্ছে। মিমি ছাড়া অন্য কেউ কি টের পাচ্ছে?
জীবন তাহলে এরকম! গল্পটা পড়ে এই চিন্তা একবার হলেও উঁকি দেবে মাথার ভিতরে। কত মধুর রূপও তো দেখি আমরা জীবনের- কথনো প্রেমে, কখনো বন্ধুত্বে অথবা সহমর্মিতায়। চাঁদের আলোকিত পিঠের মতো তারা- যা আমরা দেখি পৃথিবী থেকে প্রতিদিন। বিপরীত পিঠে আছে অন্ধকার- যা আমরা দেখতে পাই না, কোনোদিন পাবোও না পৃথিবী থেকে। চাঁদের ঐ অন্ধকার পিঠের মতোই এই গল্পটা- জীবনের অন্ধকার দিক তুলে ধরে,যেখানে অসংবেদনশীল,অকৃতজ্ঞ কিছু মানুষের কথা শুনি আমরা, নিষ্ঠূর আচরণ দেখি। এই অন্ধকারেও স্থির দীপশিখা হয়ে জ্বলে মিমি। মিমিরাই জীবনের আলো, জীবনের আশা। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ খুব ছোট্ট গল্পের ভিতরেও জীবনের আলো আর অন্ধকার দেখালেন আমাদের।
উত্তরমুছুনপড়লেন এবং এত সুন্দর করে বললেন! ধন্যবাদ আপনাকে।
উত্তরমুছুন