বর্ষার কবিতা
(এক)
ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে হলেই
মেঘকলমে উড়ে আসে একটি দীর্ঘ চিঠি
লেখা হয়নি... লেখা হবে
পৃথিবীতে যেদিন গাঢ়তম বর্ষা নামবে
জোনাকির পাখা ভিজে আলো নামবে টুপটাপ
গাছেরা সঙ্গোপনে কথা বলবে বিকেলের
দাঁড়িয়ে থাকা অন্যমনস্ক এক বালকমেঘ
ভুলে যাবে আকাশের রাস্তা
অবিন্যস্ত কালো রঙে
পাতা জুড়ে নেমে আসবে বিদ্যুৎ পতন...
(দুই)
দেখা হয় মাঝে মাঝে মফঃস্বল শহরটির সাথে
স্তন্যদান শেষে মায়ের মতো সে কাজ করে অঝোরে
পরে থাকে খেলনা দুপুর, ব্যস্ত
ফলের গাছ
আমাকে দেখে সে ভারী বিব্রত
মুখ শুকনো, চোখ উজ্জ্বল "কি হয়েছে মা বল!"
আমি চোখে চোখে বালিপতন ঘটাই
এসবই আমার নির্মেঘ বৃষ্টিপাত
মফস্বল শহরটির গায়ে লেগে আছে জামরুল ছায়া
বৃক্ষদের বড় হওয়া চলতে থাকে মেঘের সাথে
পথ নেই, রাত নেই, শ্রাবন্তী দিন শিশু মেয়ের মতন
আধডোবা পুকুরের পাশ দিয়ে কলার উঁচিয়ে চলা রাস্তা
খই বাছা ধান জমে আছে আদুরে ঝোপটির চোখের পাতায়
সে পথে তেতো গাছ ফেলছে পাতা
লতানো ঔষধি শিকড় ঝুমকো চুলের মতো
গেঁথে আছে বর্ষার টুপটাপ মৃদু মাটিতে
তালপাতার বাঁশী ঠোঁটে কৌশুলী
বর্ষাযুবক সে পথেই
এই মফস্বল, এই রাস্তা আর আমি
একচিমটি মহাকাশের মতো বার বার পূনর্জন্মের
অপেক্ষা করি...
(তিন)
বৃষ্টি আসার আগে পাশাপাশি দুটো বাড়ি
ছাদের টবে একই গাছ, অপেক্ষাও এক
বৃষ্টি আসে, টব ছাপিয়ে জল সশব্দে সিঁড়ি
দিয়ে ঢুকতে থাকে ঘরে ঘরে
দুপুর শেষ, বন্যা নেমেছে বৃষ্টির জলে
ছাতাখানি খুলে রাখলো আরজনে
মেঝেতে মেঘ পড়ে আছে, বিদ্যুৎ ঘুমিয়েছে লজ্জাহীন
সব বৃষ্টি শেষ হলে তবেই না খটখটে দিন
ভেজা পার্স পড়ে আছে
টাকা কয়েন পরিচয়পত্র সব উড়ে গেছে নিজস্ব ঠিকানায়...
(চার)
পংক্তির গায়ে গায়ে
কবি মেখে নেয় অনভ্যাসের যৌনতা
তার ক্ষয়িত আধাআধি দধিসুখ, অম্লশরীর
হলুদ ফুল হয়ে ফুটে থাকে
প্রিয় কল্পিত সত্ত্বার সোঁদাগন্ধ
জাফরান শয্যায় এই অধোগমন
আঙুলে নিয়ে আসে আন্দামানের দ্বীপগুচ্ছ
সফেদ মেঘের ক্ষরণ, কালোবৃষ্টির অলস হেঁটে চলা
জারোয়া গ্রামে রাত হাত বাড়ায়
পোড়া শিকারের দগ্ধতায়
কলমে ফুটতে থাকে...
তার সব অতৃ়প্ত আদিবাসী পক্ষপাত...
(পাঁচ)
ছোটবেলায় তোদের বাড়ি খুব যেতাম আমি
আসার সময় আমার ফুলছাপ জামার পকেটে থাকত
তোর বাড়ির সমূহ শব্দ,
আমাদের বাড়িতে এমন নরম পলির মতো শব্দ ছিল না যে
এমন কি সেইসময়ে জানালার কাচ ভিজিয়ে দেওয়া
বর্ষা দিনের ঝমঝমগুলোও নিয়ে আসতাম
কেমন যেন, আলাদা মেঘকথা হয়ে তারা আমার
জামায় লেগে থাকতো
জল হয়ে ভিজিয়ে দিতো আমাদের খরখরে বিকেল
তোদের বাড়ির সমস্ত শব্দগুলোই আমাকে ভীষণ টানতো
আদরের মিঠাস, দুপুরের নিষিদ্ধ পাতা উল্টানোর ফিসফিস
সন্ধ্যার সাঁঝবাতি জ্বলে ওঠার সময় কিছু রিনরিন, শশীদির রেওয়াজ,
প্রকাশকাকুর ছবি আঁকার ঘরে তুলির হেঁটে চলার খসখস
ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে রমাজ্যাঠিমা আর কমলজ্যেঠুর চোখের পাতা ফেলার অরণ্যপ্রপাত
তোর দাবার গুটির ঠকঠক ইত্যাদি
ইত্যাদি
আজ বহুবছর পর তোদের চকচকে বাড়িটায় গিয়ে ভুল বর্ষায় পেলাম তোকে
বিচ্ছেদের পর এই তোর প্রথম বাড়ি আসা
সব দেখে টেখে আসার সময়
জমিয়ে রাখা ঐ সব শব্দগুলো আমি তোদের জাফরিকাটা বারান্দার খোপে রেখে এলাম
সকাল হলেই কেমন হামলে পড়বে দেখিস...
(ছয়)
বর্ষাকাল এলে আমি ভীষণ স্বদেশী হয়ে উঠি
ঠোঁটে মাখতে থাকি কাদাজল,
শরীর খুঁড়ে ফিরতে থাকে লাঙলের ফলা
দেশের মাটি ঝলকে ঝলকে উঠে আসে
মাটির বুকে আমার জিভ চাটতে থাকে তেতো
ফোঁড়ন
ছিঁটেফোঁটা আদরের আশায় আমার সব সন্ধ্যা তোমাকে
গুঁড়ের চায়ে মিশিয়ে নিও এই মেয়েকে
মাটির দহ, মাটির দেহ, গহীন ডুবিয়ে এক বংশীসুর
চেনা দেশ, অচেনা মেঘ এনো রোজ রোজ...
(সাত)
অমৃত কলসী আমার কাছে ভুল থাকা থেকে গেলো
আসমান থেকে আজকাল কালো জল নামে
চেনাব উপত্যকায় ছড়িয়ে গেছে পুনঃ পুনঃ স্নান
বরফের পাশে তোমার হাত, আমার হাত
নীল হয়ে আছে সদ্যফোঁটা হিমালয়
কালো জলে পুন্যেরা মেশে, পাপেরা মেশে, রক্ত ও ঘাম
তারপর সন্ত্রাসের মতো পাহাড়ি বৃষ্টি আসে
সবচেয়ে দুর্গম গুহাটি আমাদের।
ত্রাসের মতো প্রেম
ফিকে আলো হয়ে জেগে থাকে... সেখানে...
(আট)
কোনদিন তোমার মুঠোতে ছিল
কাচের স্বপ্ন, বিপ্লবের আচমকা মেদুর মেঘ
সেদিন রোদপড়া পিচরাস্তা
আমার মনে হতো যেন
লাল ঢেউয়ে ভরা উপচানো নদী।
আজ তোমার হাতে নীল পুঁজিবাদ,
নিভৃত ঘরের শাসিত মেঝে চুপচাপ
সব নদীতে বাঁধের পর বাঁধ শুধু
আমিও শুকিয়েছি, তুমিও শুকিয়েছ
প্রকৃতি কোনদিন খেয়ালী হবে
আমি এখনো বিশ্বাস করি, অপেক্ষা করি...
(নয়)
বর্ষার সন্ধ্যায় এই যে তুমি চোখ ডুবিয়ে পড়ছো বই
মনে হয় চারপাশে জমে উঠেছে আমার প্রিয় বাবা গন্ধ
একটি অমোঘ সাম্প্রদায়িকতা যাকে জমিয়ে রেখেছে সারাজীবন
যার ভীড়ে আমার ছোটবেলা ঘুরেছে
কখনো নেমেছে অন্ধকার বৃষ্টি
এখন রাস্তা আলো করে হেঁটে যায় তোমার চোখ
আমার মনে হয় আসলে বাবার মনে ছিল
এক নির্দোষ মেঘ
কতটা ভুলে গেলে এখনো সীমান্তের ওপারেই বাবার বর্ষা নামে অঝোরে...
(দশ)
প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় সদর দরজা বন্ধ করে নিভারাণী
তারপর এক পৃথিবী বৃষ্টি নামে তার উঠোনে
পাড়ায় খটখটে রাত হইহই রইরই
এই নিজস্ব একা বৃষ্টিপাতে বেঁচে থাকার জন্যই
নিভারাণী মরে রোজ রোজ...
(এগারো)
গণসঙ্গীতের সুরেও বর্ষা নামে
রবীন্দ্রগানের মতো আকুল কদম হয়তো নয়
শক্ত ঠোঁটে জমে ওঠে লঙ্কারস
হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু যুবক যুবতী
চিরদিনের জন্য কেবল ভিজতেই থাকে ভিজতেই থাকে...
(বারো)
গভীর বৃষ্টির সময় আমি দেখি
শহরের রাস্তায় রাস্তায় অযুত মানুষ এসেছে নেমে
বৃষ্টি ঢাকছে তাদের
নীরব অগুনতি মানুষ দাঁড়িয়ে মাথা নত করে
শহরে কথা নেই গান নেই
সার সার বৃষ্টি ঝরে ঝরে শেষ হয়ে যাচ্ছে
শ্রাবণী পূর্ণিমার শেষে
এসব মানুষেরা ঘরে ফিরে যাবে
তাদের নোনতা হাতে লেখা
থাকবে ঝাপসা সময়ের গান
মৌসুমী বায়ুর অতীত কর্ষণের আঁচড়
(তেরো)
ছাদে দাঁড়াও সুকুমারী
এক ক্ষণজন্মা বর্ষা আসার কথা রাতবিরেতে
এই ধরনের নাম বিংশশতকে কেউ রাখে না
সুকুমারীর বাবা রেখেছিলেন
সুকুমারীর বাবা কিন্ত খুব আধুনিক ছিলেন
ঘরের দেয়ালে সাজিয়েছিলেন
মকবুল ফিদা হুসেন সারি সারি
সন্ধ্যার বৃষ্টির সময় এইসব বিতর্কেরা
দুঃখ, প্রেম, উল্লাস, অভিমান ইত্যাদি
পারস্পরিক সম্পর্ককে চুমু খেতো
তারপর ঘুমিয়ে থাকতো নিপাট বিছানায়
অথচ মেয়ের নাম শুধু সুকুমারী
সুকুমারীর মা প্রতিবাদ করেছিলো
মা মারা গেছে অকাল জোৎস্নায়
অরণ্যের মতো ঘর পেরোয় আজকাল ধূসর হস্তীযূথ
সুকুমারীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে পিতা
পিতাপুত্রীর নিঃশ্বাসে ঘরে বয়ে যায় বনজ বাতাস...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন