কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শ্রাবণী দাশগুপ্ত




সোঁদাগন্ধ 

কত রাতে রূপু বিকট কান্না শুনতে পেয়েছিল। ঘুম পাতলা হয়ে আসছিল। মায়ের ফিসফিস আওয়াজ কানে গেল। বাবাকে ডাকছিল মা, শুনছ! ওঠ তো। ওবাড়ির মেশোমশাই বোধহয়...
মেশোমশাই মানে তাদের বাড়িওয়ালাপাশেই দোতলা বাড়ি, লাল টুকটুকে মেঝে আর চমৎকার ঝুলবারান্দা। তারা যেটায় থাকে ওপরে-নিচে ভাড়াবাবা চমকে উঠে মশারি সরিয়ে নেমে ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল, এই পর্যন্তই মনে আছে রূপুর।

চার বছরের ছেলে মায়ের আরো গা ঘেঁষে এসেছিল। মা তার পিঠে চাপড়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল। শীতের রাত্তির চিরে ভালোদিদার প্রাণ নিংড়ানো আর্তনাদ ফেটে   ফেটে ছড়িয়ে যাচ্ছিল পাড়ার গলিতেক্রমশঃ আরো বাড়িতে আলো জ্বলে উঠছিল। রূপু প্রশ্ন করেনি, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই।

ফ্যাকশে হয়ে গেলেও আটচল্লিশবছর ধরে ওই মাঝরাত ভুলতে পারেনি অরূপ। বড় হতে গিয়ে কত মরে যাওয়া দেখতে হয়েছে পরপর। বাবা মারা যাওয়ার সময়ে তার মা চুপ হয়ে গিয়েছিল, বিলাপ করেনি। এখনও নিতান্ত দরকার না পড়লে মা মুখ খোলেনা। সংসারের কোনো ব্যাপারে মা থাকেনা।

অরূপের মেয়ে তিতির নাগপুর থেকে ফোন করছিল রিমাকে সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছে। মা-মেয়েতে অনেক রাত অবধি কথা বলে শুতে এল রিমা। তিতিরের বিষয়ে জানাতে চাইছিল অরূপকে। অরূপ শোনার চেষ্টা করছিল না, ঘুমে আচ্ছন্ন। রিমা বিরক্ত হয়েছিল। মাঝরাতে তুমুল আওয়াজে বৃষ্টি নেমেছে হঠাৎ। ধড়ফড় করে সদ্য-আসা আরামের ঘুম ভাঙল অরূপের।

রিমা বলল, কে যেন চেঁচাচ্ছে গেটে ধাক্কা মারছে, শুনতে পাচ্ছ?
অরূপ কান খাড়া করে জেগে রয়েছে। রিমা বলছে, আমাদের নিচের কলাপ্সবল গেটে আওয়াজ হচ্ছে নাকি? চল দেখি বারান্দায় যাই!

পুরনো পাড়া ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, অলি-গলি-ঘিঞ্জিমোটামোটা দেওয়াল ভেদ করে  পরিষ্কার শোনা যায়না কিছু। একজন ধাক্কা দিচ্ছে লোহার দরজায়, সুর করে কথা বলে যাচ্ছে। কান্না নয়, শোকগাথা বা বিলাপের পাঠ মুখস্থ বলে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীতে এসে দাঁড়াল বারান্দায়। তাদের বাড়ির নিচে গেটে শব্দ নেই, নিশ্চিন্ত হল

মুষলধার বৃষ্টি রূপোর ফুলকি হয়ে যাচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে। কমার নাম নেই। দুটো কুকুর অসহায়ভাবে একটা বাড়ির সিঁড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে। অরূপ ফুটপাথে আর রাস্তায় তাকিয়ে ফুলকি দেখছেরিমাকে বলল-
-ভালো হল। গরম কমবে।
-সারারাত চললে কলকাতা ভাসতে পারে। কাল অফিস-টফিস সব—! চল ছাঁট আসছে।
-তা ঠিক। নেমে দেখে এলে হত।
-মাথা খারাপ হয়েছে? ঘুমোতে চল।  
চীৎকার আর গেটে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ বন্ধ হয়নিঅন্য লোক বেরিয়েছে কিনা দেখা যাচ্ছেনা পাড়া শুনশান।  

-কে চেঁচায়, রূপু? আটকা পড়েছে না?
মা’র ঘর বারান্দার পাশে। অরূপ জানালা দিয়ে ভেতরে অন্ধকার দেখে বলল, কেউ না। জেগে আছ কেন?
আর সাড়া নেই। এরকম হয়ে গেছে তার মা। হঠাৎ কথা বলে নীরব হয়ে যায়
ঢুকে বসার ঘরের দেওয়ালে নোনার দাগ ক্ষতের মতো। বৃষ্টি হলে বাড়ে। সে জোরে নাক টানল, ড্যাম্পের গন্ধ ঘরের মধ্যে। পুরনো ভ্যাপসা গন্ধ। কড়া রোদ উঠলে সামান্য কমবে। 








0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন