কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

সম্রাট সেনগুপ্ত




পতঙ্গ

একদিন প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গের পর গগন শাসমল দেখিলেন তিনি ছাড়া তামাম দুনিয়ার মনুষ্য করণিকে পরিণত হইয়াছে। চারিদিকে খটাখট খটাখট টাইপ মেশিনের শব্দ, মসমসে জুতো, ঘুসঘুসে কাশি। গুবরে পোকার ডানার শব্দ তাহার কর্ণে পশিয়া অস্থির করিয়া তুলিল। একলা ঘরের দুর্মর দরজা দিয়া সেই যান্ত্রিক স্বর গগনকে উদ্ভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছিল। দুঃস্বপ্নের মত সে লক্ষ্য করিল বাহিরের বিবিধ ঘরবাড়ি উধাও হইয়া  ততস্থানে কতগুলো প্যাকিং বাক্সের ন্যায় অবয়ব। রাস্তায় কেবল শশব্যস্ত বিক্রেতা একই ছন্দে পা মিলাইয়া দ্রুতবেগে গমন করিতেছে। এক অদৃশ্য রিং-মাস্টারের হস্তের ছন্দে যেন নিয়মে দুলিতেছে পুলিশ, সাফাইকর্মী অথবা স্কুল ফেরত শিশু। শীতল সে চাহনি গণনা যন্ত্রের মতো। সূর্যদেব তাহার দানবিক সার্চলাইটে পর্যবেক্ষণ রিয়া চলিয়াছেন এই অলীক কর্মকাণ্ড। গগন শাসমল ভাবিলেন তাঁহার কর্মস্থলে যাইতে বিলম্ব হইতেছে। পোশাক পরিধান পূর্বক বাহির হইলেন, অপেক্ষায়মান যানে চাপিয়া নির্দেশ দিতেই উত্তর আসিল - টক্কা টরে, টরে টক্কা। তৎসত্ত্বেও যথাস্থানে পৌঁছাইয়া গেলেন দিব্য। ক্লাসরুমে প্রবেশ করিলেন। ঢুকিতেই দেখেন প্রত্যেক ছাত্রের মুখাবয়ব হতে অদৃশ্য হইয়াছে চোখ, নাক, মুখের পার্থক্য। সমস্ত কোনো অশুভ শক্তি যেন ডাস্টার দিয়া ঘষিয়া ঘষিয়া মুছিয়া দিয়াছে। বিস্মিত গগনের সম্মুখে তাহারা বাক্য বিনিময় করিতে লাগিল। সবই অশ্রুত। শুধু শূন্যে ফুটিয়া  উঠিতেছে বিবিধ অক্ষর। পড়িবার চেষ্টা করিতে করিতেই  তাহারা উড়িয়া যাইতেছে বাতাসে। বিভ্রান্ত গগন সরকার চিৎকার করিয়া ছিটকাইয়া বাহির হন শ্রেণীকক্ষ হইতে। টকাটক টকাটক বিমূর্ত শব্দ ভাসিছে চারিদিকে। ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের মত ছুটিয়া চলেন তিনি সহকর্মীবৃন্দের বসিবার স্থলে। কেউ কোত্থাও নাই। কতগুলো কাগজ। সেখানে শূন্যে ভাসমান পেন্সিল লিখিয়া চলিয়াছে কিছু। পড়িতে চেষ্টা করেন তিনি। মুখে কিছু বলিতে থাকেন। নিজের শব্দ নিজেই শুনিতে পান না। একটা কাগজ ভাসিয়া আসে। তাঁহার পকেটস্থ কলমখানি শূন্যে লাফ মারিয়া লিখিতে থাকে সেই পৃষ্ঠার উপরে। খসখস খসখস। পলায়ন করিতে চান গগন। সারা দুনিয়ার মানুষ করণিকে, কাগজে, টাইপ-মেশিনে পরিণত  হইয়াছে তবে! না কি অদৃশ্য হইয়াছে? পথে বাহির হইতেই পুনরায় পতঙ্গের শব্দ শোনা যায়। কোনমতে ঘরে ফেরেন গগন শাসমল। দুয়ার স্বয়ংক্রিয় উন্মুক্ত হয়। ছটফট করেন গগন শাসমল। বড্ড একাকী বোধ হয়।
সন্ধ্যা নামিতেই তাঁহার বাড়িতে এক অচেনা আগন্তুক আসেন। হাতে এক জাবদা হিসাবের খাতা।
দরজা খুলিতেই সে প্রশ্ন করে – গগন শাসমল, আপনি কি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করেন?
- আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর।
- বেশ তবে নির্দেশিত স্থানে স্বাক্ষর করেন।
নিঃশব্দে সই করেন গগন। অতঃপর তিনি উড়িয়া যান। ডানার শব্দ সন্ধ্যা ভাঙে।  কতগুলো বিচিত্র ভাষায় লিখিত ঘোষণাপত্রের নিচে স্বাক্ষরিত প্রাচীন অথচ অপরিচিত এক নাম।
‘ফাউস্ট’!
সজ্জিত শহরের রকমারি আলোর দিকে তখন হাজার হাজার পতঙ্গ মহানন্দে একযোগে ছুটিয়া চলিয়াছে।

3 কমেন্টস্:

  1. অসাধারণ একটা গল্প পড়লাম বহু যেন বহু যুগ পর। কাফকার গুবরে পোকার আরও যে কতটা করুণ দশা হয়েছে এটা না পড়লে জানতেই পারতাম না। গল্পের গগনের অবস্থা যেন, বার্গম্যানের Wild Strawberries এর স্বপ্নে দেখা ঘড়িহীন সেই দৃশ্যের বুড়োর থেকেও শতগুন ভয়াবহ। এক কথায় অনবদ্য।

    উত্তরমুছুন
  2. Metamorphosis!
    দারুণ লিখিয়াছেন। একজায়গায় শাসমল সরকার হইয়া গিয়াছে (বিভ্রান্ত গগন সরকার চিৎকার করিয়া ছিটকা.....), ঠিক করাইয়া লইতে হইবে।

    উত্তরমুছুন
  3. Wonderfully Posthumanist and Kafkaesque… oshadharon lekha…

    উত্তরমুছুন