কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

অলভ্য ঘোষ

বিভাজন উন্নয়ন পরিবর্তন প্রত্যাবর্তন ও ইতিহাস




ভারতীয় রাজনীতিতে উন্নয়ন পরিবর্তন-প্রত্যাবর্তন এই তিনটি শব্দ লাভ-সেক্স-অর ধোঁকা। প্রতিটি রাজনৈতিক দল উন্নয়নের মেনিফেস্টো টাঙ্গিয়ে সাধারণের মন জয় করে। ভোটে জিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে তারপর পরিবর্তনের নামে করে লুঠ ! বলপূর্বক ক্ষমতা ধরে রেখে পুনরায় প্রত্যাবর্তনের চেষ্টায় কোনো কসুর করে  না। উন্নয়ন পরিবর্তন-প্রত্যাবর্তনের রাজনীতিতে সাধারণ কেবল ধোঁকা খেয়ে চলেছেন।
তার জনগণের ওপর রাষ্ট্র নি:শব্দ ভাবে একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চালাচ্ছেশুধুমাত্র জনগণের জল, জঙ্গল, জমি লুঠ করেই ক্ষান্ত নয়, রাষ্ট্র সাহায্য করছে  সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ক্ষমতার ক্রম নিয়ন্ত্রণে। সাধারণ মানুষকে হাতের মুঠোর মধ্যে বন্দী করতে চাইছে। আর এই কাজের সুবিধার জন্য কখনো সাধারণকে সামাজিকভাবে দু-টুকরো করা হচ্ছে আজো দ্বিজাতিতত্ত্ব খাড়া করে । আবার কখনো বা কালো টাকার নামে নোট বন্দী, ক্যাশ লেস ডিজিটাল বিপ্লব বিশ্বায়নের নাম করে   একচেটিয়া অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, মানুষের আর্থিক সম্বল নিয়ন্ত্রণ, খুচরা  ব্যবসা বা মধ্যম বর্গের গলায় বেল্ট পরিয়ে বহুজাতিক কোম্পানি বিস্তারের সবুজ সিগন্যাল।
২০১৪ ভোটের আগে ভারতীয় ঔপন্যাসিক এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তাবাদী অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছিল। এই লেখিকা বলেছিলেন; "Big money is backing Modi to end resistance. "তিনি আরও বলেছিলেন; "Campaign saw massive money being poured in from corporate houses because they see him as the man who will carry forward their agenda of development. "What he [Modi] will be called upon to do is not to  attack Muslims,
it will be to sort out what is going on in the forests, to sweep out the resistance and hand over land to the mining and infrastructure corporations. He has been chosen as the man who does not blink in the face of bloodshed, not just Muslim bloodshed but any bloodshed. রায়ের মতে; The model of development promised by Modi is pro-corporates and one that is dependent on making sure that resources such as land, water, etc, are easily handed over to them. Modi's model of development is akin to the colonisation model that was followed by Western Europe on its path to 'progress' which relied on usurping resources from other countries, এর সাথে যা যুক্ত করেছিলেন তা প্রতিটি ভারতবাসীর কপালে ভাঁজ ফেলে; "India has no option but to colonise itself."
ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান বিত্তশালী রাজ্য ছত্রিশগড়। খনিজ পদার্থে পরিপূর্ণ। যেখানে লোহা থেকে সোনা, টিন, কয়লা, ডলোমাইট, বক্সাইট, লৌহ, আকরিক,  লাইমস্টোন ইত্যাদি প্রাথমিক খনিজ পদার্থ সবই রয়েছে। ছত্তিশগড় রাজ্যের একটি জেলা বাস্তার। বাস্তারের কারণে খনিজ সম্পদের জন্য ছত্তিশগড় রাজ্য যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানাধিকারী ভারতবর্ষে।  ১৯৯৩ সাল থেকে উদারনৈতিক অর্থনীতি ভারতবর্ষে পদার্পণ ঘটলে; সারা দুনিয়া জুড়ে হাজার হাজার মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর নজর পড়ল এই বাস্তার অঞ্চলে। একদিকে অফুরন্ত সম্পদ অন্যদিকে সস্তা শ্রম। ফলে বিনিয়োগের নামে শুরু হলো লুটপাট। জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুললে তা মোকাবেলা করতে ২০০৫ সালে Tata Steel  নিজেদের প্রজেক্ট বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার সাথে হাত মিলিয়ে তৈরি করে সালওয়া জুড়ুম।
২০০০ সালে ছত্তিশগড় রাজ্য তৈরি হওয়ার পর ২০০৭ সালে প্রথম ছত্তিশগড় পুলিশ আইন তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যা ১৮৬১এর ব্রিটিশ পুলিশ আইনের থেকে ভয়ঙ্কর২০০৭এর পুলিশের গ্রেফতারের সংখ্যা যেখানে ছিল ৬০,২৭৯ জন; সেখানে ২০১৪ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৭,৩৯,৪৩৫ জন। ৭ বছরে ১২ গুণ। এর মধ্যে জামিন অযোগ্য ধরায় কেস ৮১,৩২৯। বাদবাকি ৪,৮৮,৩৬৬ জনকে পুলিশ কেস ছাড়া জেলে রেখেছে।
দেশের যে কোনো নাগরিক যে কোনো স্থানে বসবাস বা কাজ করতে পারে ভারতীয় সংবিধানের ১৯(C)ধারা অনুসারে। অথচ প্রশাসনের তরফে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে; বাস্তার জেলার সদর শহর জগদ্দলপুরের Jagdalpur Legal aid forum এর কর্মীদের ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সাংবাদিকদের; জেলে পচে মরো অথবা বাস্তার ছেড়ে চলে যাও।
সারা দেশ জুড়ে কর্পোরেট লুঠ চলছে জল-জঙ্গল-জমির উপর । সেনা মোতায়েন হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে । রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের রাজনীতিকে চালিকাশক্তি করে পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদীর পুরনো লুটের খেলায় বাস্তার একটি উদাহরণ মাত্র।
হিন্দু, মুসলিম, মৌলবাদ খুন, ধর্ষণ, হুমকিসহ নানা কিসিমের গণ্ডগোলের জন্মদাতা । ধর্মের নামে রাজনীতিতে খ্রিষ্টান মৌলবাদও পিছিয়ে কোথায়? এই রাজ্যের অলিতে গলিতে গজিয়ে ওঠা ঠাকুর দেবতা, ভগবান, আল্লাহ, দরবেশ, পীর, তান্ত্রিক, সাধু, সন্ত, সন্ন্যাসীদের সাথে ‘সেইন্ট মাদার তেরেসা’ যুক্ত হয়েছেন। টিভি  চ্যানেল ও সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রচার করে চলেছে তেরেসার সন্ত হয়ে ওঠার কাহিনী। রোমের ভ্যাটিকান চার্চএর অনুমোদন সমারোহে খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী উড়ে গিয়েছেন ভ্যাটিকান সিটি। যেমনটি মুসলিম ভোট ধরতে ফুরফুরা  শরীফ ছুটে যান এ রাজ্যের নেতা মন্ত্রীরাযেমনটি হিন্দু ভোট ধরতে জনসভায় চণ্ডীপাঠ করা থেকে অস্ত্র নিয়ে হাঁটা কোনও কিছুরই কসুর করে না রাজনৈতিক দাদা দিদিরা। রাম নবমীর মিছিলে হাঁটা কিংবা রোজার নামাজ পড়া; যে কোনো  ধর্মীয় কাজিয়া নিয়ে রাজনৈতিক তরজা-নাটক ও ভারতের রাজনীতিতে নতুন নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রসার, প্রচার ও বিকাশের সাথে যুক্ত রয়েছে শোষণ নিপীড়নমূলক সমাজের ইতিহাস। ধর্ম দিয়ে শোষিত, বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষকে  সহজে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায়। অসাম্য, অত্যাচার ধর্মের আফিম খাইয়ে ভোলানো গেলে সহজেই সংঘবদ্ধ সংগ্রামের শিরদাঁড়া ভেঙে লড়াইয়ের চেতনাকে অসাড় করে দেওয়া যায়। ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতার আবির্ভাব ঘটিয়ে সাধারণের লড়াই সংগ্রামের সামর্থ্যকে ধ্বংস করে শাসক ও ধর্মের পাণ্ডারা চায় শর্তহীন আনুগত্য। শাসকের অনুগত করে তোলা ধর্মের নামে রাজনীতির লক্ষ্য। বিশ্বপ্রেম বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি বুলির আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও আগ্রাসন চালিয়ে চলেছে। আর শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে যখন মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে, তখনই নিপীড়নের  যন্ত্রণার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে ধর্মের বলির কাঠে মানুষকে বিভাজন করে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। দমন হয়েছে বিক্ষোভ বিদ্রোহ। আর যেখানে ধর্মের আফিম গেলানোর কর্মটি ব্যর্থ হয়েছে নেমে এসেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ধনতান্ত্রিক শোষণের তীব্রতার সাথে সাথেই এই উপমহাদেশে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্মের নামে রাজনীতি। অনেক কিছু ছাড়া পেয়ে যায় ভারতবর্ষে ধর্মের নামে । এ এক আশ্চর্য ক্ষমতা ভারতীয়দের । কিন্তু যুক্তি বুদ্ধি অনুসন্ধান এসব কিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্ধ বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে পথ চলা বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি চরিত্র নয়। এ  বঙ্গ কবি দার্শনিক, সাহিত্যিক বিজ্ঞানী কার না জন্ম দিয়েছে। ধর্মের পাণ্ডাদের মান্যতা যারা দিচ্ছেন; তারা কি ভুলে গেলেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, ডিরোজিও কথা! সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল বাঙালি।

মৌলবাদী মুসলমানদের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতা হলো তারা মুসলমান  ধর্মাবলম্বী, তাদের কাজ তাই হিন্দুদের ঘৃণা করতে শেখানো। যেমন যেহেতু বহু  হিন্দুরা শিবাজীকে বীর বলে শ্রদ্ধা করে, তাই মুসলমান মৌলবাদীরা শিবাজীকে  হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রচার করে এবং তাকে ইসলাম ধর্মের উপর আক্রমণকারী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। হিন্দুদের দেব দেবী নিয়ে কটূক্তি,  প্রতিমা ভাঙতেও পিছপা হয় না। আবার যদি ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয় হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করা তবে কেন তা মহারাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। কেন ঈশ্বর হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক চাইলেন না রাজা প্রতাপ এবং পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজ্যেও । সব মুসলিম রাজারা হিন্দুদের প্রতি বা হিন্দু ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু ছিলেন না, ঐতিহাসিক তথ্য বলেছে  একথা । হিন্দুদের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল বহু মুসলমান শাসকদের । তা এড়িয়ে যাওয়া মানেই ইতিহাস লঙ্ঘন। ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের সহিষ্ণুতার ও অসংখ্য উদাহরণ আছে!
মারাঠিরা খুব ক্ষমতাবান ছিলেন নিজামশাহী, কুতুবশাহী ও আদিলশাহিতে। ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিলেন নিজামশাহির প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাভি। তাঁর বাবা ছিলেন  বহিরাগত কুলকানী নামক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোক। একজন হিন্দু ছিলেন আহমেদ নগরের নৃপতির পিতা। বিজাপুরের ইউসুফ আদিলশাহ ও এক মারাঠি নারীকে বিবাহ করেন। কোয়াসিম বারি ছিলেন বিদার রাজসিংহাসনের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পুত্র শিবাজীর কন্যাকে বিবাহ করেন । এই মিশ্র সম্পর্ক ও সংস্কৃতির জন্য হিন্দুদের প্রতি সহিষ্ণুতা ছিল এবং এই সব রাজতন্ত্রের মারাঠারা বেশ ক্ষমতাবান ছিলেন। হিন্দুদের নানা ভাবে উৎসাহ দেওয়া হতো দক্ষিণের মুসলমান শাসনে দেওয়া হতো অনেক  সুবিধা ও ক্ষমতা। উত্তরের গোঁড়া মুসলমানদের থেকে অনেকটা স্বতন্ত্র ছিলেন দক্ষিণের মুসলমানেরা । হিন্দুদের সদিচ্ছা এবং আধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো  বাহমানি সুলতানি শাসনে ।

আবার এমনটাও নয় যে দিল্লীর মুসলমান সম্রাট মাত্রই গোঁড়া মুসলিম ছিলেনইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হয় না সে কথা বললে। আকবরের সহিষ্ণুতা সর্বজনবিদিত। এমনকি হিন্দু মুসলিম সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে তিনি দীন-ই- ইলাহি নামে একটি সংমিশ্রিত ধর্ম সৃষ্টি করেন। সাংস্কৃতিক মৈত্রীর বাতাবরণ ছিল উল্লেখযোগ্য আকবরের সময়ে । হিন্দু হলেও শুল্ক মন্ত্রী হিসেবে এক মুসলমান রাজার জন্য তার সব বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতেন টোডরমল। উচ্চ বর্গীয় ব্রাহ্মণ কবি জগন্নাথ পণ্ডিত শাহজাহানের দরবারে স্বাচ্ছন্দ্যে সংস্কৃত কবিতা রচনা করতেন।
সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন শাহজাহান পুত্র দারা। তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন কাশী নিবাসী পণ্ডিতদের সঙ্গে । প্রচলিত ছান্দোগ্য উপনিষদ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদের আলোকে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের চিহ্ন স্বরূপ এই সময় আল্লোপনিষদ বা আল্লা- উপনিষদ রচিত হয়েছিল।
অনেক মুসলিম কাজ করতেন শিবাজির অধীনেও। তাঁরা বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল  ছিলেন প্রশাসনিক এবং সেনাবাহিনীতে। যে নৌবাহিনীর গঠনকে শিবাজির দূরদর্শিতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। সেই নৌবাহিনী গঠন এবং তার নেতৃত্বে ছিলেন দারিয়া স্বয়ং দৌলত খান। মাদারি মোহতার নামে এক বিশ্বস্ত মুসলমান কর্মচারী ছিলেন। শিবাজির আগ্রা থেকে নাটকীয় পলায়নের সময় একজন মুসলমান তাকে সাহায্য করেছিল। যা এখন কিংবদন্তি। তিনি মুসলিম বিদ্বেষী হলে মুসলিমরা তার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেন না। কিংবা তাকে আগ্রা থেকে পালাতে সাহায্য করত না।
সালেরি যুদ্ধের পর গ্রহণযোগ্য একটি সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ঔরঙ্গজেব দক্ষিণী সেনাপতি একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ দূতকে শিবাজির কাছে পাঠিয়েছিলেন। তার প্রত্যুত্তরে দূত হিসেবে কাজী হায়দারকে পাঠিয়েছিলেন শিবাজি। অর্থাৎ এক মুসলিম শাসকের হিন্দু দূত এবং হিন্দু শাসকের মুসলমান দূত। শিবাজির বিশ্বস্ত সহযোগী নেতাজী পালকরের অধীনে সশস্ত্র বাহিনীতে সিদ্দি হিলাল এবং তাঁর ছেলে শিবাজির পক্ষে লড়েন১৬৬০ সালে দ্বিতীয় আদিল শাহের কাকা সিদ্দি জউহর শিবাজির  বিরুদ্ধে পানহালা দুর্গ দখল নিতে এলে, এ যুদ্ধে হিলালের ছেলে সিদ্দি ওয়াহা আহত  এবং বন্দী হয়। শিবাজির সেনা উপাধ্যক্ষর নাম রয়েছে ‘শামা খান’ সভাসদ বাখর  নামক ঘটনাপঞ্জীতে। শিবাজির প্রধান সেনাপতি ছিলেন নুরখান বেগ, ভি কে রাজাওয়ারে তার মারাঠা ইতিহাসের উৎস নামক লেখায় এ কথা উল্লেখ করেছেন। ১৬৪৮ সাল নাগাদ বিজাপুরসেনার অধীনে থাকা পাঁচশত থেকে সাতশত পাঠান সেনা শিবাজির অধীনে যোগ দিয়েছিল।
মুসলমানরা তাঁর পক্ষে যোগ দিতেন না, শিবাজি যদি ইসলাম হঠানোর দায়িত্ব  নিতেন। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকারী মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে প্রজা স্বার্থ রক্ষিত করতে চেয়েছিলেন শিবাজি। বিজাপুরে মুসলিম শাসক আদিল শাহের অধীনে প্রভাবশালী সর্দার ছিলেন শিবাজির বাবা শাহাজি। আবার মহারাষ্ট্রের নিজামের মনসবদার ছিলেন শাহাজির শ্বশুরমশাই লাখুজি ।
অন্তত পাঁচশত সর্দার বিভিন্ন মনসবে অধিষ্ঠিত ছিলেন আকবরের অধীনে। এদের মধ্যে ২২.৫ শতাংশ ছিলেন হিন্দু। শাহজাহানের সময়ও ২২.৪ শতাংশ হিন্দু ছিলেন। ঔরঙ্গজেবকে সবচেয়ে বেশি গোঁড়া মুসলমান বলে মনে করা হলেও, তাঁর সিংহাসন  আরোহণের সময় বিভিন্ন মনসবদারে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ২১.৬ শতাংশ। যে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়ে ছিল ৩১.৬ শতাংশে শাসন কালের শেষে। ঔরঙ্গজেবই তো দক্ষিণের সুবেদার পদে নিয়োগ করেছিলেন হিন্দু রাজপুত রাজ যশোবন্ত সিংহকে। তার প্রথম মন্ত্রী ছিলেন হিন্দু রঘুনাথ দাস। যে কিনা রাজপুত হয়েও রাজপুতদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ধর্মের কারণে যুদ্ধ হতো না প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগের ভারতে। যুদ্ধের মূল বিচার্য বিষয় ছিল ক্ষমতা দখল বা আরো শক্তি অর্জন করার  আকাঙ্ক্ষা। যদিও কখনো এই মূল লক্ষ্য পূরণের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে সাময়িকভাবে, কিন্তু ধর্ম কখনই প্রধান বা একমাত্র বিষয় ছিল না। ঐতিহাসিক  হলদি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মহারাণা প্রতাপ সিংহ ও আকবরের মধ্যে। হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ বলে চালানোর উপায় নেই এ যুদ্ধকে। রাজপুত মান সিংহের নেতৃত্বে আকবরের সেনাবাহিনী পরিচালিত হতোঐ বাহিনীতে ছিল ৬০,০০০ মুসলমান সেনা এবং ৪০,০০০ রাজপুর সেনা। হাকিম খানসুর একজন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন মহারাণা প্রতাপ সিংহের। আর হাকিম খান সুরের অধীনে ছিল বিশাল পাঠান সেনার দল। পানিপথের যুদ্ধে পেশোয়ার বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইব্রাহিম খান গার্ডি।
কেন্দ্রীয় মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে গুরু গোবিন্দ সিংও লড়াই করেছিলেন। তাঁর  সেনাদের মধ্যেও শিখদের সাথে সাথে ছিল হাজার হাজার মুসলমান সেনা। জাঠ, রাজপুত, মারাঠা এবং শিখ উত্থানের পেছনে ধর্মীয় কারণ অস্পষ্ট।
যে শাসকেরা ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় মন্দির ধ্বংস বা লুঠতরাজ চালিয়েছিল, নিজের রাজত্ব কায়েম হয়ে যাওয়ার পরে তারাই ঐসব মন্দিরে অনুদান দিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেব, যাঁর ধর্মীয় গোঁড়ামি বহুল প্রচারিত! যে  কিনা নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় অন্যের রাজত্ব আক্রমণ করে বহু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। আবার সেই ঔরঙ্গজেব অনেক মন্দিরে অর্থ দান করে সাহায্য ও করতেন। আমেদাবাদে জগন্নাথ মন্দিরে তিনি দুশো গ্রাম দান করেছিলেন। মথুরা এবং বেনারসের হিন্দু মন্দিরেও তিনি অনুদান প্রদান করেন। আফজাল খান প্রতাপগড়ে শিবাজির উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে যখন ওয়াইতে শিবির করেছিল, তখন কেবল ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সনাতন আচরণ পালন করেই  থামেননি, দান ধ্যান ও করেছিলেন। সুবিদিত আছে যে, শৃঙেরির মাসারদা মন্দিরটি  ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে মারাঠিরা লুঠতরাজ চালানোর সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীকালে সেটি পুনর্নির্মাণ করেছিল মুসলমান রাজা টিপু সুলতানমন্দির লুঠ এবং ধ্বংসের আসল কারণ ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। আবার এই রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যেই মন্দির পুননির্মানে অর্থ ও সম্পত্তি দিয়ে সাহায্য করা হতো  বা নতুন মন্দির স্থাপনে শাসকরা সহায়তা প্রদর্শন করত। শুধুমাত্র ধর্ম চর্চার কেন্দ্র ছিল না মন্দিরগুলো , প্রতীক ছিল সম্পদ, ক্ষমতা এবং আভিজাত্যের সম্পদ লুঠ ও ভীতির সঞ্চার ছিল আসল উদ্দেশ্য। মন্দির লুঠ করার আসল কারণ কখনোই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ছিল না ।
শুধু মুসলমান রাজারাই মন্দির লুঠ করতো না, সম্পদ লাভের আশায় হিন্দু রাজা  রাও মন্দিরে লুঠতরাজ চালাতকলহনের রাজতরঙ্গিনী নামক স্মরণিকায় বলা আছে যে, কাশ্মীরের রাজা হরষ দেব ও হিন্দু মন্দির লুট করেছেন। তিনি মূর্তি  গলিয়ে ধাতু নিতেন। এমনকি মূর্তিগুলোকে গলানোর আগে মানুষের বর্জ্য ও মূত্র ছিটিয়ে দিতেন। যদিও কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাতের প্রমাণ পাওয়া যায় না কোনো পুস্তকে হর্ষ কর্তৃক দেব মূর্তির অবমাননার জন্য। কথিত আছে যে হর্ষর শাসনে দেব মূর্তি ধ্বংসের জন্য হর্ষর শাসনে রাজস্ব বিভাগে দেবোৎপাটন বিভাগ ছিল । মহম্মদ বিন তুঘলকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে মারাঠি কাব্য কাহিনীতে যে তিনি মোল্লা ও সৈয়দদের গণহত্যা করেছিলেন। ঐতিহাসিক কিছু লেখায় বর্ণিত আছে যে মোল্লারা সম্রাট জাহাঙ্গীরকে ভয় পেতেন। তিনি এলে কেউ কেউ লুকিয়ে পড়তো।
মুসলমান রাজারা ছিলেন নিষ্ঠুর এবং বর্বর, মৌলবাদী হিন্দু সংগঠনগুলোর বরাবর  অভিযোগ এটি। মুসলমান রাজারা মন্দির ধ্বংস করেছে এবং আঘাত হেনেছে হিন্দু ধর্মের ওপর। অতএব মুসলমান মাত্রই হিন্দু বিরোধী। আর আমাদেরও মুসলমান বিরোধী হতেই হবে। ওরা যেহেতু হিন্দু বিরোধী। হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলো যেভাবে যুক্তি সাজায়, ঠিক একই রকম যুক্তি দেয় মুসলিম মৌলবাদীরাও। তারা  তাদের সমর্থকদের বলে বেড়ায়, হিন্দু হলো কাফেরদের ধর্ম। মুসলমান পূর্বপুরুষেরা  এই ধর্মের উপর আঘাত হেনে ঠিকই করেছিলেন। সম্ভব হলে সকল মুসলমানকেই তাই করা উচিত। নিদেন পক্ষে মুসলমানদের হিন্দু বিদ্বেষী হতেই হবে।

এই বিভাজন, ভাগ জিইয়ে রাখা চলছে বিট্রিশ ভারত থেকে । আজও তা টিকিয়ে  রাখা হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণে যা সহায়ক। শ্রেণীবিভক্ত রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক  চেতনার জন্ম দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট ব্যাঙ্ক বানানো সহজ। মানুষের বিভিন্ন মেরুকরণ করে আড়াল করা সহজ হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপদার্থতা ও নির্যাতন। সর্বোপরি ধর্মের নামে বিভাজন, সাধারণ গরীব খেটে খাওয়া মানুষ কৃষক  দিনমজুরদের সংগঠিত সংগ্রামের শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছে ভারতের স্বাধীনতার লড়াই থেকে। তেলেঙ্গানা মতো বৃহৎ কৃষক আন্দোলনেও দেখা গিয়েছে মতানৈক্য।  কত আন্দোলন আতুরেই প্রাণ হারিয়েছে।
ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো আলোচনায় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে এড়িয়ে যাওয়ার যে শিক্ষা সাম্রাজ্যবাদীরা প্রচার করে খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যে ভাঙ্গন ধরাতে, তার ফলশ্রুতি হলো কিছু প্রচলিত সমীকরণ বা ইতিহাসকে জেনে বুঝে বিকৃত করা।  ফলাও এই বিকৃতির ইস্তেমাল করে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ ব্রাহ্মণ্য বাদের মোড়কে  ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিসেবে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। আরো এক ধাপ এগিয়ে বলতে হয় ব্রাম্ভণ্যবাদ ভারতবর্ষ ও হিন্দু, নেশনকে সমার্থক করে দেশপ্রেম একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্মগত এখতিয়ার বলে পরিবেশিত করে আসছে। শুধু আজাদির পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদের দালালদের প্রভাবেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ইতিহাস বিকৃতির প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে।
একটি ব্যক্তি মানবকে মানুষ থেকে মিথএ পরিণত করেছে ‘বিনা রক্তপাতে’  স্বাধীনতা লাভের মজাদার তত্ত্ব কথা শুনিয়ে অহিংসার মূর্তির পূজা করে । আবার কখনও ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি চালিয়ে সাধারণ জনগণকে সংখ্যালঘু মৌলবাদীদের জুজু দেখিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারের দাবি দাওয়াগুলো ভুলিয়ে রেখেছে এই নয়া ঔপনিবেশিক আমলেও । হিন্দু মুসলিম ভারত পাকিস্তান নিয়ে রাজনীতির পারদ চড়িয়ে চাপা উত্তেজনায় মিডিয়াগুলো যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশকে ব্যস্ত রাখে সাধারণের দৃষ্টি এড়িয়ে ঠিক তখনি দেশের সব সম্পদ লুঠ হতে থাকে অবাধে

‘মুসলিমস এগেইন্সট পার্টিশন’(২০১৫) বইটিতে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল  সায়েন্স এর অধ্যাপক ড: শ্যামসুল ইসলাম দেখিয়েছেন কীভাবে মুসলিম  সম্প্রদায়ের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে এই ভাগ বাটোয়ারা সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছিলেন। দেখিয়েছেন কীভাবে এই বিরাট সংখ্যক সংখ্যালঘু মানুষের  মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে সদা বিবাদমান কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ অন্তিম  পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে দর কষাকষি তে লিপ্ত হয়ে ‘দ্য গ্রেট বিট্রায়াল’ ঘটিয়েছিল।  তিনি উল্লেখ করেছেন ‘Sixth Schedule of the 1935 Act’এর ‘Restricted franchise’ অধীনে কেবলমাত্র ২৮.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ভোট দিতে পারতেন। এই বৃহৎ গণতন্ত্রের জন্ম লগ্নে এলিটরা নয়, বরং ২৫ লক্ষ নিরীহ সাধারণ  মানুষের দেশভাগ নিয়ে মতামতের কোনো রকম তোয়াক্কা করা হয়নি। স্বাধীনতা  লাভের অন্তিম পর্যায়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নিজেদের মধ্যে দর কষাকষিতে লিপ্ত ছিল তাদের লক্ষ্য কোনোভাবেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছিলেন, বরং তারা বরাবরই সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বের নামে এদেশের মাটিতে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসি বজায় রাখতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে।
ফলে প্রতিশ্রুতি মত গান্ধীর মৃতদেহের উপর দিয়ে এই দেশটা ভাগ হয়নি। দেশভাগ তথা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের স্বাধীনতা উদযাপিত হয়েছে ২৫ লক্ষ সাধারণ মানুষের মৃতদেহের উপর দিয়ে, সম্প্রদায় নির্বিশেষে মা বোনদের ধর্ষণের মারফত, পিতৃতান্ত্রিক উল্লাসের মধ্য দিয়ে। অথচ চিরকাল এই নন এলিট সাধারণ মানুষেরা তাদের ধর্ম নিয়ে নিতান্তই উদাসীন। ধর্ম তাদের কাছে দৈনন্দিন বিশ্বাসের ব্যাপার। রাজনীতির বস্তু নয়। কংগ্রেসের সবচেয়ে সন্দেহজনক অবস্থান ছিল দ্বি জাতি তত্ত্বে । কংগ্রেস একাধারে দেশ ভাগ বিরোধিতার ভান করে অথচ দেশভাগ এর পক্ষে থাকা মৌলবাদের মতো ভয়ঙ্কর সংক্রামক চিন্তাধারা নিজের মধ্যে লালন করে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের’ মুখোশের আড়ালে। ‘সেকুলার’ ভারতবর্ষের একচ্ছত্র প্রতিনিধিত্ব  দাবি করা কংগ্রেস পাকিস্তানের দাবির প্রবক্তা জিন্না তথা লিগকে মুসলিম  সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করে তার সাথে দেশ ভাগ বাটোয়ারা দর কষাকষি আসলে সেই সমস্ত আপামর জনসাধারণের পিঠে ছুরি মারা ছিল  শেষদিন পর্যন্ত যারা সমস্ত সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশ ভাগের বিরোধিতা করেছিলেন ।
শাসক শ্রেণী দ্বারা রচিত হয়ে চলে মেইনস্ট্রিম ইতিহাস। তাই দেশভাগের জন্য শাসক শ্রেণির কুম্ভীরাশ্রু মেলে স্বাধীনতা উত্তর ইতিহাসে। থাকে জিন্না ও মুসলিম লীগকে একচেটিয়া ভিলেন হিসেবে দেখানোর সমস্ত রকম ব্যবস্থা ‘লাহোর পাকিস্তান প্রস্তাব’এর প্রবর্তক হিসেবে। যারা সেদিন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থে ত্যাগ করেছিল  ইতিহাসে সে সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা স্থান পান না।  স্থান পান না তারা যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিলেন, ভারতের  ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভরসা রেখে মুসলিম লীগের হাতছানি অগ্রাহ্য করে। আলোচিত হয়নি ‘জামেয়াত উলেমা ই হিন্দ’, ‘মোমিন কনফারেন্স’, ‘মজলিস এ এহ্ রার এ ইসলাম’, ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম মজলিস’, ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ ইত্যাদি  অসংখ্য মুসলিম সংগঠনের ইতিহাস যে সংগঠনগুলি ‘আজাদ মুসলিম কনফারেন্স’এ একজোট হয়েছিল হিন্দু মুসলিম ঐক্যের পক্ষে, দেশভাগের বিপক্ষে,  ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে। এদের কথা এই একতরফা ইতিহাস মনে রাখেনি। মনে রাখলে স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মোহগ্রস্ত করে রাখা যেত না।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যে প্রকৃত চিত্র মেলে তা হিন্দু মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ছবি। এই মহাবিদ্রোহে ফিরিঙ্গিদের সাথে লড়তে লড়তে রাণী লক্ষ্মীবাঈ-এর পাশাপাশি প্রাণ দিয়েছেন রাণীর ব্যক্তিগত  সেক্রেটারি এক মুসলিম মহিলা মুনজার তাতিয়া টোপির প্রাণ বাঁচাতে আত্মত্যাগ  করেছেন মৌলভী ফজল্ হক। এক সিনিয়র ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসার থমাস লোয়ে এই অভূতপূর্ব ঐক্যের সম্বন্ধে বলেছিলেন;
"----they all joined together in the cause, the cow
-killer and the cow-worshipper, the pig-hater and
the pig eater of Allah is Good and Mohammed his
prophet and the mumbler of the mysteries of Bram
(Brahma)"
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধ্বজাধারীরা যারা হিন্দু মুসলিম অতীত ঐক্যের কথা অস্বীকার করে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করছেন, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’এর দাবিদাররা যে বিনায়ক দামোদর সাভারকার (১৮৮৩- ১৯৬৬)কে বন্দনা করে থাকে, সেই সাভারকার পর্যন্ত ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে  হিন্দু মুসলিম ঐক্যের কথা অকপটে স্বীকার করে গিয়েছেন। সিপাহী বিদ্রোহের বদলে তিনি হিন্দু মুসলিমদের এই ঐক্যবদ্ধ গণ-অভ্যুত্থানকে ‘ভারতীয় স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন ১৯০৭ সালে। পরবর্তী কালে ব্রিটিশ বিরোধিতা  ছেড়ে এদেশের সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ তৈরি করতে সাভারকার যখন পাল্টি খেলেন (১৯২৫ সালে লিখলেন ‘হিন্দুত্ব’, একটি নতুন ধারণা যা বাল গঙ্গাধর  তিলকের ‘আর্য জাতির’ অবৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।) তখন জিন্নার উদ্দেশ্যের সাথে নিজের উদ্দেশ্য মিলিয়ে দিলেন। কারণ পাকিস্তানের দাবি আর হিন্দু রাষ্ট্রের দাবি তো একে অন্যের পরিপূরকএকটি আরেকটির পথ প্রস্তুত করে দেয়। একটি আরেকটির অজুহাত হিসেবে কাজ করে। সাভারকারের ১৯২৫ সালের হিন্দুত্ব ও হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা, মহম্মদ ইকবালের ১৯৩০ সালে ‘মুসলিম ইন্ডিয়া উইদিন ইন্ডিয়া’, রহমত আলির ১৯৩৩ সালে পাকিস্তানের অজুহাত, ১৯৪০ সালের জিন্নার ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ এক সুতোয় বাঁধা আলাদা কোনো চিন্তা ভাবনা নয়।
Dr. Shamsul Islam তাঁর গ্রন্থ Muslims Against Partitionয়ে দাবি করেছেন; ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই ‘মুসলিম ইন্ডিয়া উইদিন ইন্ডিয়া’ বা পাকিস্তান বা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ কোনোটাই একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি হয়ে ওঠেনি। এগুলো  প্রতিটি ছিল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো একত্র করে সেই এলাকার স্বায়ত্তশাসন। তাই তথাকথিত দেশ ভাগে বিরোধিতার এই স্বায়ত্তশাসন মেনে নিতে পারে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৃথক একটি রাষ্ট্রের দাবি মেনে নেয় এবং এরকম একটা ভাব দেখায় যে তাদের আর কিছু করার ছিল না। দেশের মানুষের শ্রেণিগত একাত্মবোধ ভাঙ্গতেই সময়ে সময়ে সাম্রাজ্যবাদ আর মৌলবাদকে আঁতাত তৈরি করতে হয়। দেশভাগ এই আঁতাতেরই ফল। বিখ্যাত ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদী’  নেতারা লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক, মদনমোহন মালব্য, এম.এস.অ্যানি, বি.এস মুজ্ঞে, লালা হরদয়াল, বিনায়ক দামোদর সাভারকার, এম.এস গোলওয়ালকার প্রমুখরা এই ভাবে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’কেই প্রচার করেছেন, ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের’ মুখোশের আড়ালে। জিন্না ও মুসলিম লীগের  পাকিস্তানের দাবি দ্বিজাতি তত্ত্বের ফেরি তারি রূপান্তর।
পলাশীর যুদ্ধ(১৭৫৭), সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ (১৭৭০-৭১),  চূয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৯) ইত্যাদির ইতিহাস অগ্রাহ্য করে কেশবচন্দ্র সেন যখন ভারত ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আগমনকে দুই আর্য রক্তের মিলনের সাথে তুলনা করছেন তখনই চেনা হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চেহারাটা। তাই তিতুমীরের (সৈয়দ মীর নিসার আলী: (৭৮২-১৮৩১) যখন বাঁশের কেল্লা বানিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে তখন বিট্রিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহর শহুরে বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত বাবু তৈরিতে ব্যস্ত। এই নবনির্মিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরবর্তী কালে যত বেশি আধুনিকতার স্রোতে ভেসেছে তত বেশি উপলব্ধি  করেছে ঔপনিবেশিকতার গোলামী, আর তখন তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে সরাসরি বিরোধিতায় না গিয়ে ‘হিন্দু নবজাগরণ’ এর কোলে ফিরে গিয়ে সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছে।

তথ্য সূত্র:-

ক) সমাজ বিজ্ঞান ও প্রকৃতি পরিচয় (বিশেষ সংখ্যা) তৃতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৬
1) বাস্তার-অঘোষিত যুদ্ধ চলছে - শুভ দীপ
2) মাদার টেরিজা ও বিক্ষোভ দমনের রাজনীতি - কণিষ্ক চৌধুরী
3) রিভিউঃ মুসলিম এগেইন্সট পার্টিশন - শামসুল ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে কিছু কথা - সুজয় মল্লিক
4) শিবাজি ও ধর্ম শিবাজির দৃষ্টিভঙ্গী (শহীদ গোবিন্দ পানসারের ‘কে ছিলেন শিবাজি’ অবলম্বনে) অনুবাদ: ড:সুব্রত রায়
5) প্রকৃতির গভীরে পাড়ি কিংবা বিঞ্জানে ইশ্বরের অন্তর্ধা - অমিতাভ চক্রবর্তী
6) ভারতবর্ষের ভূমি ব্যবস্থা-সংস্কার ও বিবর্তন - বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত
7) পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন, ১৯৫৫ (পঞ্চম অধ্যায়ের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি) গৌতম তালুকদার
খ) আমরা বলছি শোন জুলাই-অগস্ট ২০০৮,বর্ষঃ ২
1) ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি মার্কিন স্বার্থেই রচিত (উন্নয়ন না অর্ন্তঘাত) গুরুপ্রসাদ কর


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন