চিয়ারলিডার
স্যাঁতসেঁতে
ঘরটায় রোদ তেমনভাবে ঢোকে না। বরং দরমার গা থেকে উঠে আসা ভ্যাপসা গরমটাই যেন
চিরস্থায়ী। মায়ের হাঁপের অসুখটার মতো। কাজ থেকে ফিরে রাতের ঘুমে অবশ্য কোনও ব্যাঘাত ঘটে না
পানুর। মায়ের কোঁকানি আর পাশের বাড়ির বৌয়ের মার খাওয়ার চিৎকার — কোনওটাই ওর ঘুম
ভাঙ্গাতে পারে না। এখন ওর স্বপ্নে চিয়ারলিডাররা আসে। ফরসা মেয়েগুলো, ছোট ছোট পোশাক
পরে যখন নাচ করে, কী সুন্দরই না লাগে! চার মারলে নাচে, ছয় মারলে নাচে, আউট হলেও নাচে। পানু হাঁ করে তাকিয়ে
থাকে ওদের দিকে। মালিক যখন ধমক দিয়ে ওঠে, পানু সম্বিত ফিরে পায়, হাঁকতে থাকে, “গরম
ভাত, মাছের ঝোল, মাংস, খুব সুন্দর রান্না, একবার খেলে ফিরে ফিরে আসবেন, দামও কম...
বৌদি ভিতরে বাথরুম আছে, এসে দেখুন”।
আশেপাশের
আর চারটা হোটেলের সাথে লড়াই, কে বেশি খদ্দের নিয়ে আসতে পারে। খদ্দেরদের মনোরঞ্জনের
জন্য হোটেলে একটা টিভি আছে। পানুর দেখার সুযোগ কম। ওর এমনিতে খুব একটা আগ্রহও নেই
মারপিটের সিনেমা আর নাচ গান দেখার। শুধু এই আই পি এল-এর সময়টাতেই ও কেমন আনমনা হয়ে
যায়। ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, কলকাতা, পাঞ্জাব এ কটা দিন ওর ঘরবাড়ি। ওকে টানতে থাকে কোহলি, ম্যাক্সওয়েল, ক্রিস গেল,
ওয়ারনার, এবি...। আর অবশ্যই মাঠের ঐ মেয়েগুলো। এই গরমেও কেমন ঠাণ্ডা লাগে পানুর।
একবার মাঠে গিয়ে দেখার খুব ইচ্ছে ওর। সন্টুদাকে জিজ্ঞেসও করেছিল টিকিটের দাম। নাহ,
ওর একমাসের বেতনেও কুলোবে না।
টিভিতেই
দ্যাখে পানু। মালিকও সবসময় বকে না। বিশেষ করে সন্ধ্যায় যখন খদ্দেরের আনাগোনা একটু
কম। অস্ট্রেলিয়ার ঐ বোলারটা কী বলটাই না করল আগের দিন, গেল ব্যাট ছোঁয়াতেই পারছে না!
ব্যাঙ্গালোর দলটার যে কী হল এবার? তবে
আজকে নিশ্চয়ই ম্যাক্সওয়েল খেলবে, আগের দিন পারে নি। ধোনির রাগ তো জানে না, ওকে
ক্যাপ্টেন করে নি... বুঝবে এবার। সারাদিন ভাত-ডাল-খাসীর মাংসের মাঝেও ঘুরপাক খেতে
থাকে পানুর মাথায়।
খেলা
শেষে যখন প্রাইজ দেয়, গোগ্রাসে গেলে পানু তখন। ইস একটা ক্যাচ ধরার জন্য কতগুলো টাকা, বিরাট চেকটার উপরে লেখা
এতগুলো শূন্য গুনতেও পারে না ও। আর কেমন ইংরাজীতে কথা বলে প্রাইজ পাওয়ার পর! ঐ
মেয়েগুলো তখন কোথায় থাকে?
রাতে
এই ঘুপচি ঘরে ফিরে এসে রোজকার রাত্রিযাপন। মায়ের কাশির ওষুধটা ফুরিয়েছে, কতদিন
আগেই অন্য মেয়েমানুষ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া বাবা নাকি কয়েকদিন ধরে দুপুরে আসছে, চেহারা ভেঙে গ্যাছে -
মা কিছু বলে নি, বস্তির মুখে যতন জানালো। টিউবয়েলের
জলে রাতের স্নান, টিমটিমে আলোয় ঢেকে রাখা ভাত, সাথে মায়ের অবিরাম অনুযোগ — পানুর
কানে ঢোকে না কিছুই। মাদুর টেনে যখন এলিয়ে দেয় সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা, ভিড় করে
আসে ঐ রঙের জগত — জিততে গেলে তিন বলে দশ, ধোনির হাতে ব্যাট...
পানুরও
জিততে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে এই দুচ্ছাই জীবনটাকে ছুঁড়ে ফেলতে। ম্যাক্সওয়েলের মতো,
জীবনের সমস্ত ইচ্ছেশক্তি জড়ো করে মাঠের বাইরে পাঠাতে ইচ্ছে করে দারিদ্র, ঘেন্না আর
অবহেলাগুলোকে। আর তখন নিশ্চয়ই ঐ মেয়েরা আবার দুই হাত তুলে নেচে উঠবে...
অসামান্য তোমার দেখার চোখ ও প্রকাশের ভাষা।
উত্তরমুছুন