শীতের
সন্ধ্যা অথবা একজন ফুলপিসি
সন্ধ্যা
হবার ঠিক মুখে অভয়দাস
লেন কি
রায়েরবাজারের তল্লারবাগ সবই এক। শীত উড়ে যাবার
আগে এইসব শুকনো পাতার স্তূপে রেখে যাচ্ছে শুধু মন খারাপের চিঠি। সন্ধ্যারাগ থেকে কোমল
স্বর ছড়িয়ে ভেসে আসছে সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা সঙ্গীত। জায়গাটার নাম বাহাদুর
শাহ্ পার্ক। একসময় আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড খেলার ক্লাব ছিল এই পার্ক। স্থানীয়দের
কাছে এ ক্লাবের নাম হয়েছিল আন্টাঘর। আন্টাঘর ময়দান পরে ভিক্টোরিয়া পার্কে পরিণত হয়
রাণী ভিক্টোরিয়ার কালে এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের নামানুসারে নাম হয়
বাহাদুর শাহ্ পার্ক। সেখানেই এ মুহূর্তে দু’হাঁটুর ফাঁকে মুখ
গুঁজে বসে আছে টুসি। শীতের হাওয়া লেগে টুসির চুলগুলো একটু একটু হাওয়ায় উড়ছে।
টুসির
খুব মন খারাপ। অমিতেরও কি মন
ভালো? এমন সন্ধ্যা নামলে অমিতের শুধু ফুলপিসিকে মনে পড়ে। পুরো শীতের এসব সন্ধ্যায় ফুলপিসিকে প্রতিদিনই দেখা যেত রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে
থাকতে। অমিতকে দেখলেই একবার করে জিগ্যেস করত, বিকেলের ট্রেন কি এলো রে অমিত? তোর পিসেকে দেখলি? ফুলপিসির বিয়ে হয়েছিল রাজশাহীতে, পিসিরা বিয়ের পরও যদিও ঢাকাতেই থাকত। পিসেমশাই ছিলেন বেতারের সঙ্গীতশিল্পী।
বিয়ের পর তৃতীয়বারের মত ফুলপিসি যেবার শ্বশুরবাড়ি মোহনপুর যায়, সময়টা অস্থির, ১৯৭১।
ঢাকা দাউদাউ করে জ্বলছে। নিরাপত্তার অভাবে পিসিদের পুরো পরিবার রাজশাহীর মোহনপুর
গ্রামে চলে যায়। সে গ্রামও যখন জ্বলে উঠলো তখন আবার রাতের অন্ধকারে পিসিরা ঢাকায় তল্লারবাগেই ফিরে আসে। কিন্তু পিসেমশাই থাকতে পারেননি। কেন না তিনি তখন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে
পড়েছেন। পিসিকে রেখে যাবার আগে পিসেমশাই নাকি বলেছিলেন শিগগিরই ফিরছি। বস্তুত পিসেমশাই আর ফেরেননি। শোনা যায় সে রাতটা ছিল চোদ্দ ডিসেম্বর। রাতের অন্ধকারে তিনি যখন
মোহাম্মদপুর থেকে বেরিয়ে মিরপুরের পথ ধরবেন তখনই তিনি পাকসেনাদের হাতে পড়েন । আর কোনো খোঁজ তারপর মেলেনি। অমিতের জন্ম এইসব ঘটনার
অনেক পরে আশির দশকে। বড় হতে হতে সে দেখেছে গ্রীষ্ম-বর্ষা ফুলপিসি কিছুটা সংযত থাকে, কিন্তু শীত এলেই বড্ড চঞ্চল হয়ে ওঠে। কেবল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় আর পথে যাকে
পায় তাকেই জিগ্যেস করে ট্রেন এলো কি না।
ফুলপিসিকে সরিয়ে রেখে সে
চোখ রাখলো টুসির দিকে। টুসি এখনো আগের ভঙ্গীতে বসে। খোলা চুলের ফাঁকে দুটো শুকনো পাতা আটকে গেছে।
পাতা দুটো ও আলগোছে সরাতে গেলে টুসির শরীরটা কেঁপে ওঠে, ও কি
কাঁদছে! আলো আরেকটু নিভে আসে। একটা ঘর না ফেরা পাখি ডেকে ওঠে, ট্ররর ট্রাক্কা.. অমিত হাত
সরিয়ে নেয়। অমিত আর টুসির কী করে
দেখা হয়েছিল সেসব গল্প এখন থাক, কিন্তু ফুলপিসিকে যে অভয়দাস লেনের টুসিই এনে দিয়েছিল ওদের তল্লারবাগের
বাড়িতে, সে এক বিস্ময় অমিতের কাছে আজও। পিসি কী করে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা অতটা পথ, অতটা মানে পিসি নাকি
ধানমন্ডি লেকের কাছে এসে হাত পা ছড়িয়ে রাস্তায় বসে কাঁদছিল। টুসি সে সময়টায় ক্লাস
শেষে বন্ধুদের সাথে পার্কে গিয়ে বসেছিল। হঠাৎই চোখ পড়ে একজন বয়স্কা বসে কাঁদছে।
দেখে ভদ্রঘরের বোঝাই যায়। কৌতূহলে ও এগিয়ে গিয়ে জানতে পারে
পিসি পথ হারিয়ে ফেলেছে। বাড়ি কোথায় ঠিক
করে বলতে না পারছে না তবে একবার রায়েরবাজার আরেকবার তল্লারবাগ বলতে পারছে। টুসির কী
হলো সে একাই পিসিকে পৌঁছে দিতে গেল। শেষ অবধি বাড়ি খুঁজে না পেয়ে টুসি এবং পিসি
দুজনেই যখন ঘেমে নেয়ে একাকার তখনই অফিস ফেরতা অমিতের সাথে দেখা ব্লু ওয়েজ
কনফেকশনারির সামনে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে
অনেকক্ষণ। টুসি মুখ তুললো অমিতের দিকে। ফুলপিসি
চলে গেছে হঠাৎ করে। ভুগছিল প্রবল শ্বাসকষ্টে। ব্যাপারটা অমিতের পরিবারের জন্য হয়ত
স্বস্তিদায়ক। টুসির জন্য নয়। নিজের কেউ নয় তবু কেন যে কষ্ট, খবরটা টুসি জেনেছে আজ, পিসি চলে যাবার দু’দিন পর। অমিতের এখন বাড়ি ফেরার তাড়া। অনেক পথ উজিয়ে তাকে এখানে আসতে হয় টুসির সাথে
দেখা করার জন্য। ছেলেটার পরীক্ষা, গিয়ে পড়াতে হবে। সামান্য উসখুস করে সে যখন একটা
সিগারেট ধরাবে বলে দেশলাই খুঁজছিল, ভাঙা স্বরে টুসি জিগ্যেস করলো, তোমায় অশৌচ পালন করতে হচ্ছে না?
অমিত বললো, না। তবে এবার
বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। পার্কে এভাবে আর কতক্ষণ টুসি? ছেলেটার পরীক্ষা তুমি জানো।
টুসি সোজা হয়ে বসে, হ্যাঁ চলো, বলে খোলা চুল বেঁধে নিল ক্লিপে। উঠে দাঁড়িয়ে জামার পিছনে লেগে
থাকা ঘাস শুকনো পাতা হাত দিয়ে ঝেড়ে নিতে নিতে বলল, সত্যি খুব দেরি হয়ে গেলো তোমার।
তারপর দুটো আলাদা রাস্তা ধরে ওরা যে যার গন্তব্যে ফিরতে থাকে। স্ট্রিট লাইটগুলো হয়ত তখন এ ওকে বলে, দু’চোখে যা দেখো, যা তুমি সত্য বলে ভাবো, তার
কিছুই আসলে সত্য নয়।
কেনো এতো বিষন্নতা ছড়িয়ে যাওয়া
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন