মারমেড
মারমেড!!
সেদিন দেখলাম
সমুদ্রের পাড় থেকে একটু ভেতরে, যেখানে অনেকগুলো এবড়ো খেবড়ো পাথর এমনি এমনিই পড়ে
আছে, সেই পাথরের ওপরে এক মৎসকন্যা বসে বসে রোদ পোয়াচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম কোন
মেয়ে বুঝি চলে গেছে ওখানে। পরে ভাবলাম একটা বড়সড় মাছ হয়ত। তারপর বুঝলাম মাছ নয় সে
মৎসকন্যা, নড়েচড়ে কথাও বলে – হ্যাঁ সে সত্যি সত্যিই আমাকে নাম ধরে ডাকল। একদম স্পষ্ট
বাংলা উচ্চারণে। আর এই এতগুলো অদ্ভুত কান্ডর পরেও আমার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করলাম,
অর্থাৎ একটুও অবাক হলাম না। এতটাই স্বাভাবিক লাগল ওকে, ওর বসা, লেজটাকে মাঝেমাঝে
ঘুরিয়েফিরিয়ে রাখা – একটুও আশ্চর্য হলাম না। কোমর পর্যন্ত লম্বা এক ঢাল চুল ওর,
তাও আবার সপসপে ভেজা, মনে হল একটু তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিই, তারপর চুল আঁচড়ে সুন্দর
একটা খোঁপা বেঁধে দিই। তারপরেই আবার ঠিক করলাম, থাক বাবা! একটু বাদেই তো আবার জলে
নেমে যাবে ও, তখন ওই এত্ত বড় খোঁপা নিয়ে ও সাঁতরাতে পারবে না ঠিক করে। তার চেয়ে
ওকে যা মানায়, তাই ভাল। ওর লম্বা চুল জলের সঙ্গে মিশে জল হয়ে ওঠে।
আমাকে ডাকল
বলে সাড়া দিলাম। কিন্তু ওর কাছে যেতে পারলাম না সমুদ্র পেরিয়ে। যেমন ডলফিন ডাকে,
ঠিক তেমনি তীক্ষ্ণ হুইশেলের মত শব্দ করে ও কথা বলছিল। আমার তাই শুনতে অসুবিধে
হচ্ছিল না। কিন্তু আমার স্বাভাবিক স্বর, মানে মানুষের যেমন হয় আর কী, ও যে কী করে
শুনতে পাচ্ছিল, আমি জানি না। আমাদের তেমন দরকারি কোন কথা হচ্ছিল না... অনেক বছর
বাদে ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে যেমন অনর্গল কথা শেষ হতে চায় না, তেমনি কথা
বলে যাচ্ছিলাম আমরা। আর হাসছিলাম,
খুব হাসছিলাম। ওকে আমি মারমেড বলেই ডেকেছি। ওর মুখ যেন স্বর্গের পারিজাত, আসলে এই
উপমাটা ছাড়া আমার মাথায় আর কিছু আসছে না, কারণ পারিজাত কেমন দেখতে হয় আমি জানি না,
আর ওর মুখ যে ঠিক কেমন, তাও বলে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আর ওর শরীর যেন মোম
দিয়ে তৈরি। সূর্যের আলো পড়ে ওর ভেজা গা চকচক করছে। ওর খোলা বুক দেখে নিশ্চিত
কারুরই কামোত্তেজনা জাগবে না। দুই পদ্ম কোরকের মত মখমল সেই স্তন থেকে যে সুগন্ধ
পাওয়া যাচ্ছে এত দূর থেকে, তার ছোঁয়া পেলে যে কোন খল মানুষই সুস্থ হয়ে যাবে বলে এই
মুহূর্তে আমার মনে হল। আর কোমর থেকে ওর মাছের শরীর ক্রমাগত ছটফট করেই চলেছে।
পাথরের ওপর যেটুকু বসে থাকা আছে, তার স্থিরতা দেখলে মনে হয় স্বয়ং হিমালয়ও লজ্জা
পাবে। আর লেজের অংশটি ঠিক তার উল্টো, ছটফটে এক দুরন্ত শিশু যেন! এই যে বৈপরিত্য ও
বহন করছে একই শরীরে, তা ওর পক্ষেই সম্ভব বলে আমার মনে হল।
কিছুক্ষণ পরে
হঠাৎ খেয়াল করলাম, ওর গলার স্বর যেন একটু ফিকে হয়ে আসছে, শ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া
যাচ্ছে। ও কি হাঁফিয়ে গেল? মারমেড, মারমেড তোমার কি কষ্ট হচ্ছে? মারমেড, উত্তর
দাও!! এরপর দেখলাম ও কেমন যেন এলিয়ে পড়েছে, আর ওর শরীরের নিচের অংশ জলের মধ্যে চলে
যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তারপরেই ঝপাং করে একটা শব্দ হল, আর দেখলাম মারমেড আর নেই।
প্রায় সারা
পৃথিবীর লোকগাথা জুড়ে মারমেডের অস্তিত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও
পূর্ব দিকের দেশগুলোয় মারমেড নিয়ে অনেক অনেক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীন
অ্যাসিরিয়ায় এই মারমেডের গল্প প্রথম পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, দেবী
অ্যাটারগাটেস স্বামী হঠাৎ করে মারা গেলে লজ্জা থেকে বাঁচতে শরীরের নিচের অংশ মাছে
পরিণত করেন, আর ইউফ্রেটিসের জলে তাঁর দুই সন্তান সহ আশ্রয় নেন। সেই সময়ে টাইফুন
আসে, সেই দৈত্যাকার টাইফুনকে তিনি এই জলে ডুবিয়ে শান্ত করে দেন। সেই বিপর্যয় থেকে
সিরিয়ার মানুষকে তিনি বাঁচিয়ে দেন সে যাত্রা। আর তাই সিরিয়াবাসী কোনদিন ভক্তিতে
মাছ খায় নি। মারমেডের স্বামী মারমেন হয়ে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসে।
আরেকটি গল্প
প্রচলিত আছে। এই দেবী অ্যাটারগাটেস এক রাখালের প্রেমে পড়েন এবং সেই মনুষ্যপুত্র
রাখাল দেবীর প্রেম হজম না করতে পেরে আত্মহত্যা করে, মতান্তরে বলা হয়, দেবী নিজেই
সামান্য মানুষের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ার লজ্জায় রাখালটিকে মেরে ফেলেন। তবে এই
মারমেড কথায় গ্রীক মাইথোলজির প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। সিরেন নামের এক অতি
ভয়ানক মেয়ে, অথচ তীব্র সৌন্দর্যের অধিকারী, যে সমুদ্রে ভেসে যাওয়া নাবিকদের তার
সুন্দর ও মিষ্টি স্বরে এবং গানে আকর্ষণ করত আর পাথুরে দ্বীপের তটে নাবিকদের জাহাজ
আছড়ে ভেঙে পড়ত। এই সিরেন ছিল নদী-দেবী অ্যাচেলাসের মেয়ে। হোমারের ওডিসিতেও সিরেনের
উল্লেখ আছে। দেবতা ডিমেটার সিরেনকে এক জোড়া ডানা দিয়েছিলেন যাতে সিরেন পারসিফোনকে,
যে কিনা সিরেনের সঙ্গী ছিল আর হারিয়ে গেছিল এক সময়ে, খুঁজে আনতে পারে। তবে মোটের
ওপর সিরেনের গান বলতে ভাল ধারণা পোষণ করা হয় না। এই গান এমনই যার আকর্ষণ এড়ানো
অসম্ভব এবং এ গান যে শুনবে তার পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য! আর সিরেনও আদপে এক
মাংসাশী প্রাণী, মোটা থলথলে চর্বিযুক্ত, যে তার শিকারকে তার শ্বদন্ত দিয়ে নিষ্ঠুর
ভাবে ভক্ষণ করে। অদ্ভুত এটাই যে এই কুৎসিত সিরেন থেকে মারমেডের মত এত সুন্দর ও
নিষ্পাপ এক মূর্তির ধারণা কীভাবে এল, আমার ভাবনার বাইরে তা।
প্রসঙ্গত বলি,
ঊণবিংশ শতকের মাঝামাঝি সমুদ্রে যাওয়া কিছু নাবিকের মুখে শোনা গেছে, তারা মারমেড দেখেছেন স্বচক্ষে। ‘সিরেনিয়া’
নামের এক জলজ স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যারা নদী, সমুদ্র
উপকূলবর্তী এলাকা, সমুদ্রে বসবাস করে। এদের সামনের দুই হাত (limb) প্যাডেলের মত জলে সাঁতার কাটার উপযুক্ত, আর পেছনের দুই ভারী মাংসল
পা(limb) একত্রে যুক্ত হয়ে নিচের দিকে লেজের আকৃতি নিয়েছে। সম্ভবত এদের দেখেই এই
মারমেডের কল্পনা করেছিল প্রথম কেউ। সে যাই হোক, মারমেড এখন আমাদের কাছে অতি প্রিয়
এক অস্তিত্ব, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সিরেনোমেলিয়া এক ধরনের
কনজেনিটাল ডিসঅর্ডার যাকে মারমেড সিনড্রোমও বলা হয়। এক্ষেত্রে জন্মানোর সময়ে শিশুটির
ক্ষুদ্র জননেদ্রিয় সহ দুই পা যুক্ত থাকে। সাধারণত শারীরিক ভাবে যুক্ত যমজদের এই
অসুবিধে দেখা যায়। আর এক্ষেত্রে কিডনি ও ব্লাডারের ব্যাপক জটিলতার ফলে শিশুটি দু
একদিনের বেশি বাঁচে না। ২০০৩ সালের জুলাই পর্যন্ত এই ধরণের মাত্র চারজন শিশু বেঁচে
গেছে।
১৮৩৬ সালে
হানস ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেনের ‘লিটিল মারমেড’ সিনেমা হিসেবে বেরনোর পরে
মারমেড-এর জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। সেই থেকে বিভিন্ন রূপকথা, কমিকস, টিভি শো,
সিনেমায় বিপুলভাবে মারমেডের চর্চা শুরু হয়। হিন্দু ধর্মেও মারমেডের উল্লেখ
পাওয়া যায়। কম্বোডিয়ান ও থাই রামায়ণে রাবণের কন্যা ছিলেন সুবর্ণমচ্ছা (লিটিল
গোল্ডেন মারমেড)। এই মারমেড রাজকন্যে ভেবেছিলেন হনুমান লঙ্কায় আসার যে
সেতু বানাচ্ছেন, তা যেনতেন প্রকারেণ ভেস্তে দেবেন। কিন্তু দেখা গেল,
তিনি নিজেই হনুমানের প্রেমে পড়ে যান। আর সেতুবন্ধন হয়ে যায় প্রেমের হাত ধরে। থাই
লোককথায় এই মারমেডও খুব জনপ্রিয়।
আমার মারমেড চলে গেছে। মারমেড থাকার
জন্য আসে না, জানি। আর আমি মারমেডের অপেক্ষাতেও থাকি না, কারণ জানি ও নিজেই সময়
হলে আমার কাছে আসবে আর আমরা তখন খুব গল্প করব। আমার এই মারমেড খুব ভাল। ও সিরেনের
মত না। ওর গানে, ওর কথায় কোন জাহাজ তো দূর, কোন নাবিকও কখনও আত্মহত্যা করে নি। ওর
মারমেন ওকে খুব ভালবাসে। খুব ইচ্ছে হয় ওদের দুজনকে বাড়িতে নিয়ে এসে খাওয়াই। আমার
এই অদ্ভুত ইচ্ছেগুলোকে নিজেই আবার বাক্সবন্দী করে রেখে দিই। মারমেড আমার কাছে
কল্পনার জগতের হয়েও কল্প-জীব না। একদম বাস্তবের মত প্রত্যক্ষ। আর আমি তাই জানি, ও
আবার যে কোন একদিন ফিরে এসে, ওর সেই আশ্চর্য গলায় আমাকে ডাকবে। ততদিন ওরা সুখে
থাক।
মৎস্যকন্যা আর হস্তিকন্যাদের ঘরের কথা জেনে তুষ্ট হলুম ।
উত্তরমুছুনহস্তিকন্যা! যাই হোক, মারমেড নিয়ে একটি কবিতার সিরিজও লিখছি।
মুছুনভালো লাগলো কল্পগল্পের সঙ্গে মিথের ইতিবৃত্ত নিয়ে তথ্য কথা
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুনপানি মেঁ মীন পিয়াসী... আপনি তুষ্ট করে দিলেন। খুব ভাল। খুব ভাল।
উত্তরমুছুনথ্যাংকইউ থ্যাংকইউ
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর লিখেছ। মারমেড মারমেড। ভালো লেগেছ।
উত্তরমুছুনএটার কথাই আগে বলেছিলাম।
মুছুনআরে দারুণ দারুণ।সবকিছুকে এতো সুন্দর কম্পোজ
উত্তরমুছুন