কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৩

১১ প্রশান্ত গুহ মজুমদার

কম্‌ নীর কথা
প্রশান্ত গুহ মজুমদার


কামিনীর কোনো দেশকাল নাই। কামিনীর গণ্ডী আছে। চলাচল নাই। তাহার সিঁড়ি আছে। প্রসাধন নাই। স্নান আছে। অক্রুর প্রভাত আছে। বিরহ আছে। দু দশটি হলুদ যখন আর নাই ওইরূপ তাহার মনে হয়। খুব ছোট অক্ষের কোনো সাদায় সে লিখিয়া রাখে, আজ আবার।

কালের কাহিনী সে জানে না। দেখিয়াছিল অনুর্বর দেওয়াল একদিন স্টেনশিলে ছবি ধরিল। শব্দ ধরিল। নিচে দূরে ওই পুকুরের কালচে পাতায়, শুনিল, রক্ত। অদ্যাবধি সাদা ভিন্ন তাহার কিছু নাই। সাধ হয়, ওই লাল সে মাখিবে একদিন। তাহার তো বাক্য নাই। চরম নীলে সে লাল তুলিয়া ধরিবে, একখানি ঘোড়া তাহার অর্ন্তগত।

সে শীতকাল দেখিয়াছে। বিধূর, মাথা নিচু, ঈষৎ পোয়ালের আগুন, ঘরের বাহিরে ভাঙা চেয়ার অপেক্ষায়। এঁটেল পথ শীর্ণ, মালিন্য তাহাকে বিশেষ করিতেছে। আর সে একা, গণনায় বিবেচ্য নহে। কেবল ঘন কলাগাছের নিচে যখন খন্তা, বদলের আশঙ্কায়, উড়ো খবরে, মাটি ভাঙিতেছে, দ্রুত, টের পায়, তাহাকেও আশ্রয় হইতে হইবে।

নীলচাষ সে শুনিয়াছে, কাছারিবাড়ির চোরাকুঠুরি, লোহার আঙটা, বাতাসের মতো আঘাতে দুলিতে থাকে আর নিরন্তর অশ্রুর মতো, বিধবার মতো শব্দ। এখন সে বুঝিল, তাহাকেও কিছু আলগা হইতে হইবে। বল্মীক ঢিপির ন্যায়। লিখিত, অন্ধকারে, আলোর প্রার্থনায় যাহা একদা লিখিত। সে অপেক্ষা করে।

বস্তুত এ প্রকারে সে দেখিতে পায় মানুষ। অকালের গল্পে তাহাদের ভয়। তাহারা মহাকালের জন্য সিঁদুর তুলিয়া রাখে। আর কত না শব্দ! স্বাস্থ্যের কথা মনে পড়ে। সিঁড়ির কথা। অবাক দুই সাদা ঊরু। অপ্রকৃতিস্থ সতীনের কথা। শুনিতে পায় পদ্মার চর। একখানি নৌকা, স্থির নাই, যাইতেছে। একা নহে, সে রমণীসহ, রজ্জুবদ্ধ, অগোছালো, সেই সঙ্গে। কোথায় যে যায়! অভূতপূর্ব সে পরিত্যাগে বালু সিক্ত, কাশবন।

সিঁড়ি সচল হয়। দুয়ারের পর দুয়ার খাড়া হয়। বন্ধ হয়, খোলে। আর মানুষের বাথানে বাঘ আসে। গন্ডী আছে, তথাপি। সম্ভাবনার মতো পুরনো ডালপাতা ভাঙে। চেয়ারের চারপাশে তখন মানুষ দাঁড়ায়। প্রাচীন অস্ত্রে। গান করে। নিচু, অথচ মন্দ্র স্বরে। সম্পদের জন্য আশঙ্কা। পুনরায় পথের ভয়, তাই। কামিনীর স্বাস্থ্য নাই। তথাপি সে বহু হইবার যাদু আকাঙ্ক্ষা করে। সে আশরীর একখানি প্রভাত প্রাথর্না করে। আর সেসবে অপারগ হইলে সে বৃষ্টি ভাবিতে থাকে। তুমুল, কুলপ্লাবী, দশদিক আচ্ছন্ন। খরা ভাবিতে থাকে। শূন্যতা। হা হা আগুনবাতাস। মানুষীকে সে এক্ষনে দেখিতে পায়। যেন উদ্ধার, যেন বাসন্তী। দুয়ার হইতে বাহিরে আসিয়াছে।

কামিনী অপেক্ষা করে। তাহার তো দেশকাল নাই। সে কেবল অপেক্ষা করিতে পারে। মানুষী বাহিরে আসিয়াছে। তাহার আর পুরোহিত প্রয়োজন নাই। স্মৃতির নাই। সে আকাশ দেখিল। ওষ্ঠে যেন বিদ্রুপ, ওষ্ঠে যেন বঙ্কিম ভাঁজ। সেই যে কলাঝোপের নিচে পুঁথি, ছিন্ন অপেক্ষা তাহার যেন মনে পড়িয়াছে। সময়ান্তরে, বহু নগরের পরে, বহু সেতুর পরে, বিলুপ্ত ধর্মগোলার অবশেষে, পুনরায় একখানি নীলকণ্ঠ উড়িল। উদ্গ্রীব কামিনী আপ্রাণ বিস্তৃত করিতে সচেষ্ট হয়, নিজেকে। বহু স্রোত, ঢেউ উঁচু হইয়া আসিতেছে। এখন তাহার স্নান হইবে। সে প্রস্তুত হয়। গন্ডীর কোনো স্মৃতি তাহার আর নাই এখন।




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন