মেয়েখেলা (পর্ব - ১৬)
আমি কখনো মদ খাই নি। বাবা কখনো খান নি, তাই। আমি কখনো তাস
খেলিনি। বাবা
খেলতে জানতেন না, তাই। বাবার হাত ধরে চলেছি ছোট্ট থেকেই। যে পথ, যে আদর্শ শিখিয়েছেন, অক্ষরে অক্ষরে তা প্রতিপালন করেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশন্যাল লাইব্রেরী, নন্দনে বসে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ দেখা, সব ভালোলাগা বাবাকে
ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে আশৈশব। কিন্তু বাবার
সবচেয়ে পছন্দের মানুষকে আমি ত্যাগ করেছিলাম। বাবা যা কখনো কল্পনাতেও
আনতে পারেন নি। বাবার পছন্দ আসলে আমারই পছন্দ ছিল। কিন্তু তিনি মেয়ের হ্যাসব্যান্ড
ও পরিবারের জামাইকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলেন। পরিবারেরর শান ও বিরাট দম্ভ ছিলেন
আমার বয়ফ্রেন্ড কাম হাসব্যান্ড। বাবা জানতেন আমার এই স্বামী আমাকে নানাবিধ ভাবে
জব্দ করছেন। কিন্তু তিনি তাকে বাজারের সবচেয়ে দামী মাছ ও স্পেশাল মিষ্টি কিনে এনে
খাওয়াতেন। তিনি ছিলেন এ যুগের শিক্ষিত ফাদার-ইন ল। নিজের
মেয়ের কালো রঙের উপর যে করুণা তাঁর দীর্ঘদেহী হ্যান্ডসাম জামাই করেছেন, তার কৃতজ্ঞতা
প্রকাশে তিনি আকুল হয়ে থাকতেন। একদা হ্যাসব্যান্ডকে ‘ইডিয়েট’ বলার জন্য বাবা মা’কে
বলেছিলেন,
মেয়ের মেয়েগিরি ছুটিয়ে দেবো, স্বামীকে সম্মান দিতে শেখাও। হয়তো আমি সংযত না হলে আমায় মেরে শিক্ষাও দেওয়া হতো। মেয়েদের এভাবে শেখানো হয় সামনে, গোপনে কিন্তু শিক্ষকদের নাম বাইরে আনা বারণ, কেননা এতে
অনেকের সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের অপমান করা হয় বলে মনে করা হয়। আমি এই
হিপোক্রাসির বিরুদ্ধে। মানুষেরর ভুল আচরণ নিশ্চিতভাবে সমালোচনা ও সংশোধনের যোগ্য। বাবা
খুব শিক্ষিত মানুষ ও আমার পছন্দের এক জেন্টলম্যান ছিলেন, কিন্তু গতানুগতিকতার
বাইরে বাবা বেরোতে চাননি বা বেরোতে পারেন
নি। তিনি এই সমাজের এক লেয়ারে আশ্চর্যভাবে নিজেকে মিশিয়ে রেখেছিলেন। মেয়ের একমাত্র
রক্ষক ও অভিভাবক স্বামীই হতে পারে, তা তিনি মানতেন ও বিশ্বাস করতেন।
মা একটু আধুনিকমনস্ক ছিলেন। তিনি স্বামীকে দেবতা ভাবার
বিপক্ষে জোরদার সওয়াল করতেন। আমাকে আমার
লিপস্টিক বা হিলজুতো বা প্রেমিক পরিবর্তনের জন্য কথা শোনান নি। সাজের সাথে চেহারা
চরিত্রকে গুলিয়ে না ফেলার ভাবনা আমার মধ্যে মা সর্বপ্রথম জন্ম দেন। পরিবারের অনেকেই তাই আমার এই অধঃপতিত
মানসিকতার জন্য মা’কেই দায়ী করতেন। মা আমার বন্ধু না হতে পারলেও আমাকে সঙ্গ
দিয়েছেন প্রচুর। সবশেষে বলেছেন, লোককে একটু দেখানোর জন্য তো সংসারটা করতে পারতিস!
কী জানি সেই লোক কারা, যাদের সামনে মা আমাকে সংসারী সাজতে বলেছিলেন! হয়তো সমাজ বা
পরিবার। ভালো মেয়ে হলে এরা আমাকে কী দিত? ভেবে উত্তর পাই না। এরা তো সাজগোজ করা, কথা বলা, হাসতে অভ্যস্ত, স্বামী ছাড়া মেয়েদের ‘এসকর্ট সার্ভিসে’র কেউ বলে ফেলতেও
দ্বিধা করে না। ভালো মেয়ে হবার জন্য লড়াই করার ইচ্ছে হয়। কিন্তু এদের জন্য?
আমার এমন কথার বাণে অনেকেই বিরক্ত হয়ে বলেন, আমার স্বামী, বাবা, শ্বশুর
কিন্তু খুব ভালো। আমি অবাক হয়ে বলি, তারা খারাপ আমি কখন বললাম? পাল্টা জবাব আসে না, আপনি নিজের ঢাক নিজে পেটান, অন্যদের সামিল হতে বলবেন না! মেয়েদের
এমন প্রতিবাদে আমি আশার আলো দেখি। আজই যদি সে তার বাড়িতে গিয়ে বলতে পারে - আমি
রান্না করবো, সবাই খাবে; কাপড় কাচবো, সবাই ফিটফাট পরবে; চাকরি করবো, নতুন ফ্ল্যাটের ই এম আই আমিই দেবো, তাহলে স্বামী ও তার পরিবার এখানে বাস করবে কেন? আমার বিবাহের কি এই পূর্বশর্ত ছিল? যদি বলে তবে কিছুটা লাভ হয় পরের জেনারেশনের।
একজন মহিলা আমায় বলেছিলেন, মানে? আপনার মোটিফটা কী? বিয়ে করবো না? স্বামীর সাথে শোবো না? বলুন তবে কী করবো? আপনার মতো
টাকা নেই আমার। কে খেতে দেবে? দু’মুঠো খাবার ও ওষুধ আর মাথার উপরে আমায় যে ছাদ দেবে তার জন্য আমি সব করবো। কোনো লজ্জা
নেই তাতে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। মেয়েরা দু’বেলা খাবার আর অসুখে ওষুধ পেলেই
তাদের সব চাওয়া শেষ? কোনো দাসত্বই
তাদের কাছে লজ্জার নয়! খুব অবাক হই, জানতে ইচ্ছে করে, প্রতিদিন এত মেয়ে যে গায়েব হয়, এত মেয়ের হত্যা হয়, এত মেয়ে বিক্রী হয়ে যায়, এসব কে করে? কারো বাবা, কারো স্বামী, কারো ছেলেই তো করে! এ কথা তো আজও প্রমাণিত হয়নি যে উপরের
সবকটি গর্হিত কাজ মেয়েরাই করে থাকে নিজেদের নিয়ে! তাহলে নিজের স্বামী ও সন্তানকে
নিয়ে আমাদের কেন এত বিশ্বাস ও অহংকার? সিনেমায়
সাহিত্যে চিরকাল দেখানো হয়, স্বামীর এক্সট্রা ম্যারিট্যাল আফেয়ারে স্ত্রী গিয়ে উপস্থিত হয় এবং সেই মহিলার
বিরুদ্ধে প্রায় তরবারি ধরে, কিন্তু যাকে অপমান করার কথা তাকে খুব যত্ন করে বিছানায়
নিয়ে শোয়। প্রতিপক্ষ নির্ধারণে অক্ষম, নাকি নিজের নিরাপত্তার সন্ধানে বেবাক, তা
নিয়ে যতই গবেষণা চলুক, সবাইকে অবাক করে একদিন সেই মহিলা ফুরিয়ে গেলে আফসোস করার
কেউ থাকে না! মর্ষকাম মহিলার শ্মশানযাত্রায় একটিই আলোচনা – আহা রে! বৌদি এভাবে চলে
গেল! দাদাকে কে রান্না করে দেবে? এত কম বয়সে
দাদার কী হবে?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন