দুগ্গাঠাকুর
-হ্যাঁ
রে দিদি... ওই ফেল্যাট বাড়িগুলোতে দুগ্গা ঠাকুর বচ্ছর বচ্ছর আসে, না রে? গণেশ পায়ের নখ খুঁটতে খুঁটতে জিজ্ঞেস করল।
সন্তোষপুর
খালের এদিকটায় দু-চারখানা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর, এখনো ভালো করে ইলেকট্রিকের লাইন আসে
নি, খাল পেরোলেই উল্টোদিকে সার বাঁধা অ্যাপার্টমেন্ট। একতলাগুলো ফাঁকা, গাড়ি থাকে। ওইখানেই পাশে অল্প জায়গা করে একচালার দুগ্গাঠাকুর। ছাদ থেকে নিচ অবধি জোনাকির মতো ছোট
ছোট বেগুনী- সবুজ আলো, ধূপের গন্ধ, ধুনোর গন্ধ হাওয়ায় ভেসে আসে, সকালে ঘুম থেকে
উঠে লুচি-আলুর দমের ছ্যাঁকছোক শোনা যায়...
-বল
না রে দিদি, আমাদের বাড়ি দুগ্গাঠাকুর আসে না কেন?
-কী
করে আসবে? আমাদের তো পয়সা নেই, দুগ্গাঠাকুর এলে কত্ত আলো দিতে হয়, ঢাক বাজাতে হয়, পুজোর ভোগ ... সে ওনেক খরচ,
আমরা কোত্থেকে দেবো বল?
-কেন?
ছোট্ট ছোট্ট মাটির প্রদীপ বানিয়ে দেবো ... ওই বাবা যেমন বানাতো! সেরম ক’খানা প্রদীপ দিলে হবে না? সাথে আমার ওই
প্লাস্টিকের ড্রামখানা বাজিয়ে দি যদি?... তাহলে?
-আর
ভোগ? কী খাওয়াবি ঠাকুরকে?
-আচ্ছা
দিদি! ঠাকুর পান্তাভাত খায় না? গোটা সেদ্ধ? খিচুড়ি আর লাবড়া?... আমরা যেমন খাই?
-দিদি
খানিক ভেবে চিন্তে বলল – সে দুগ্গা ঠাকুর না হয় খেয়ে নেবেখন, কিন্তু মা’র সিংগি
মশাই? ও’র জন্যে তো মাংস লাগবে? ও কি আর খিচুড়ি, পান্তা ভাত খেতে পারে?
-মাংস
আমরা কিনতে পারব না দিদি?
-না
রে, এ কি যেমন তেমন সিংগি?... এ দুগ্গা ঠাকুরের সিংগি বলে কথা!! এত্ত বড় দুগ্গাঠাকুর,
এতগুলো হাত, এত অস্তর-সস্তর, তাকে পিঠে করে সেই হিমালয় থেকে কলকাতা নিয়ে আসতে হয়
... সিংগি মশাইয়ের গায়ে কত জোর দরকার বল দিকি! তারজন্য রোজ দুবেলা অনেক অনেক মাংস খেতে
দিতে লাগে, বুঝলি?
-হ্যাঁ
রে দিদি, ঠাকুর এরোপেলেনে করে হুস করে চলে আসতে পারে না?
-নাহ,
দুগ্গাঠাকুর শুধু সিংগি করেই আসে, পেলেনটা ছোট না? অতগুলো হাত নিয়ে ভিতরে ঢুকতে
পারে নাকি? ... বোকা ছেলে!
গণেশ
মাথা চুলকোতে চুলকোতে ভাবে, ঠিকই তো, এ ভারি
অসুবিধে… ও তাই চুপ করে খালের জলে ফ্ল্যাট-বাড়ির আলোগুলোর ছায়া দেখতে থাকে, কেঁপে কেঁপে ওঠা চিকচিকে
আলো… মনে মনে ঠিক করে, বড় হয়ে একদিন সে
দুগ্গাপুজো করবেই, নিজে দুগ্গা ঠাকুরকে পিঠে চাপিয়ে বাড়ি নিয়ে
আসবে … সিংগি মশাইকে সেদিন আর লাগবে না।
ভাই… ভাইইই… ওই দ্যাখ, মা আসছে। যা না, এগিয়ে যেয়ে জিনিসগুলো ধর না… অকম্মার ধাড়ি ছেলে! দ্যাখ
গে যা, মা কাজের বাড়ি থেকে কত্ত কী খাবার নিয়ে এসেছে…
যাআআআ… কি রে গেলিইই? মা পারে নাকি একা সব বয়ে
আনতে! … যা… ছুট্টে যা… আমি উনুনে আঁচ দিচ্ছি, উঠতে পারব না।
***
গণেশ
ছুট লাগায়, সামনের গলি পেরিয়ে বড় রাস্তা... এদিকটায় কত আলো! ওই যে দূরে মা, হাতে অনেকগুলো
প্যাকেট, চটের ঝোলাখানাও ঢিপি হয়ে রয়েছে... মা কেমন ঝুঁকে আছে একদিকে, এত কিছু একা
টানতে কষ্ট হচ্ছে বড্ড! --- গণেশ লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝটপট মা’র কাছে পৌঁছে যায়...
দাও মা, আমাকে ঝোলাখানা দিয়ে দাও।
মা’র শিরা ওঠা রোগা রোগা হাত থেকে ঝোলাটা জোর করে টেনে
নেয় – উফফ, কী ভারি! মা কাপড়ের খুঁট দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হেসে ফেলে।
গনেশের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে মা আর ছেলে রাস্তার ধার ঘেঁসে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে
আনমনে। হাতের ভারি ঝোলাখানায় আঙ্গুল কেটে যাওয়ার জোগাড়। গণেশ তাড়াতাড়ি পা চালায়। সত্যি, সিংগি মশাই’এর মতো গায়ে
বল আনতে হবে আরো... মা’র ঝোলাপত্তর বইতে পারবে না নইলে!
বড় রাস্তা থেকে চুঁইয়ে নেমে আসা একফালি আলোতে গণেশ
মা’র মুখের দিকে চেয়ে দেখে একবার। উস্কোখুস্কো চুল, টানা টানা চোখ, শুকনো ঠোঁটে
একটা আলতো হাসি কী সুন্দর লেগে আছে... ঘামে ভেজা মা’র হা-ক্লান্ত মুখখানা কেন জানি অবিকল দুগ্গা ঠাকুরের মতো মনে হয় তখন...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন