কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ২ অক্টোবর, ২০১৭

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

আঁচড়


রাস্তার পাশে কালভার্ট। মখমল নিরেট আকাশের গায়ে ছিটছিট—যেমন হবার কথা। নীল ঢালু পথ ধরে সাবধানে নামে, হাতে স্কুটারের হ্যাণ্ডেল। মাংস কিনতে হবে। মুরগীর কষা মাংসের সঙ্গে মোটা আটার রুটি। অরিন্দম তথাগত আর গৌরকে নিয়ে গেছে দারুর বোতল কিনতে।

এখানে সপ্তাহব্যাপী মাংসহীনতা চলছে। মাংসব্যবসায়ীদের মাথায় হাত, ঝাঁপবন্ধ। সকালে এসে বসছে কয়েকজন। দোকান ধুয়ে-মুছে রাখছে। ইতঃস্তত করছে দেখে  নীলকে ঠেলা মেরেছে ভিমলিঃ 
-আ-রে বাবু, তু জাকে ঢুঁড়। পেয়ে যাবি ওদিকের বাজারে। আমি রোটি বানিয়ে, প্যাঁজ, লহসুন, মির্চি পিষে রাখছি। তু এলে রাঁধব।

অবস্থা সঙ্গীন। ওদিকের বাজারে কোনোদিন যায়নি নীল। এখন আটটা রাতে নির্জন অচেনা বাজারেএমনিতে এজায়গা নতুন তাদের কাছে। শহুরে আদত ছেড়ে চাকরি করতে এসে নির্বাসন যেন। সে আর অরিন্দম আপাতত ফ্ল্যাটমেট্‌সে একভাবে চোখ আটকে রেখেছে পায়ের দিকে। অসমান ইঁট-খোবলানো বাজারের দিকে ধেয়ে যাওয়া পথ। দু’য়েকটি টিমটিমে আলোয় ভুতুড়ে।

একটামাত্র দোকান খোলা। বাঁশের খুঁটি। বাতি ঝুলছে খাপরার চালা থেকে। তিনটে খাঁচার মধ্যে একটাতে গোটাছয়েক মুরগী ধুঁকছে। নীল সামনে এসে দাঁড়াল। খালি খাঁচার পাশে চেয়ার পেতে দুই ছোকরা মোবাইলের ওপরে হুমড়ি খেয়ে আছে। তৃতীয় লোকটি মাঝবয়সী, দোকানের মালিক। লুঙ্গি গুটিয়েছে ঊরু পর্যন্ত। নীল গলা ঝাড়লঃ
-চিকেন লেনা হ্যায়। হোগা?
-হুঁ। হোগা।
কোনো চাড় নেই লোকটার। বেচলেও চলে, না বেচলেও এরকম ভাব। গা মোড়ামুড়ি দিয়ে বললঃ
-জলদি বোলিএদোকান বন্ধ করে দেব। আর খোলা রাখা যাবে না।
নীল মিইয়ে গেল সামান্য। এখানে তর্কের অবকাশ নেই, পারেও না সে।
-ও-ই, মানে দোস্তরা এসেছে।
-কতটা চাই?
-দেড়-দু’কিলো।
আন্দাজেই বলল। লোকটি খপ করে নড়া ধরে একটা মুরগীকে তুলল খাঁচার ভেতর থেকে। ঝটপট করছে। বাকিরা কঁক-কঁক করে চেঁচাচ্ছে। তার গা শিরশিরিয়ে উঠল দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে বললঃ
-এক কিলো সাড়ে আটসো। চলেগা?
-আচ্ছা।
রক্তমাখা মোটা গাছের কাটা গুঁড়ির ওপরে মুরগী গেল জবাই হতে। লোকটার হাতে ধারালো চাকু। নীল মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। রক্ত-টক্ত পোষায় না।
তা সত্বেও চোখ পড়ে গেল। লোকটি মুরগীর গা থেকে ছাল ছাড়াচ্ছে। নীল ওপাশে সরে গেল। ছেলেদুটির মোবাইল থেকে অদ্ভুত শব্দ উঠছেসে কৌতূহলে পেছনদিক থেকে উঁকি দেবার চেষ্টা করল। স্ক্রিনে দুধসাদা উলঙ্গ দুটি মেয়ে, সঙ্গে নির্গ্রন্থি দৈত্যের মতো কালো আফ্রিকান। ছেলেদুটি ব্লু দেখছে। অন্ধকারে স্টিল ছবি—শিল্যুট। ওদের একজনের হাত অন্যের ঊরুর ফাঁকে। নীল সরে যাবার মুহূর্তে একটি ছেলে তাকাল। বিশ্রী চোখ, দাঁত চেপে নোংরাতম গালির একটা ছুঁড়ে দিল।

মাংসকাটা লোকটি ডাক দিলঃ
-হো গয়া। লে জাইএ।
কালো প্লাস্টিকে ভরে দিয়েছে কাটা টুকরোগুলো। মুরগীটা একটু আগে ছিল। এখন আর নেই। তাজা মাংসের গরম প্যাকেট সে ছোট থলেতে ভরল। বিটকেল গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছে। থুথু ফেলল রাস্তায়। ধুলোয় পড়ে বাবল হয়ে গেল সেটা। স্কুটারের হাতলে ব্যাগ লটকে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করল। সেই পরিষ্কার, নিটোল, মোলায়েম। পাশের মস্ত মাঠ ছমছম করছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তারপরে তাদের কোয়ার্টারস্‌-এর আলোর ফুটকি।
তার মা প্রায়ই বলেন - এত নরম স্বভাব তোর, বড্ড দুশ্চিন্তা হয়!
তার নিজেরও নিজের জন্যে চিন্তা হয়। কাউকে বলতে পারে না। মনে হলো,  প্যাকেটের মুরগী ধড়ফড় করছে। পাশেই খোলা হাইড্রেন। ফেলে দিলে কেমন হয়? তিনবন্ধু মিলে পেঁদাবে তাকে? ওদিকে ছেলেগুলো মুখ খুলে কাঁচা খিস্তি করল। সে পেছন ঘুরে দেখল, বয়স্ক লোকটাও ওদের সাথে জুটেছে। মোট তিনটে মাথা।

মোড় ঘুরে বাড়ির দিকে গেল নীল। হিন্দী নিউজ চলছে কারো টিভিতে। আবার একটি ছেলে ব্লু-হোয়েল খেলার বলি হয়েছে। হাতে কেটে কেটে মাছের ছবি এঁকেছে। ভাবতে গিয়ে সামনের বাম্পে ঠোক্কর খেল স্কুটার। আরেকটু হলে মুখ থুবড়ে রাস্তাতে পড়ে যেত। গতরাতে অরিন্দম বলছিলঃ
-জাস্ট ফর ফান, খেলাটা লোড্‌ করে দেখা যায়?
নীলের কব্জিতে স্কুটারের হ্যাণ্ডেলে ঘষটে গেছে। নুনছাল উঠে জ্বলছে।  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন