ধারাবাহিক উপন্যাস
তাহার নামটি
(বারো)
“জুলপি!”
অঞ্জন চমকে ওঠে, মুখ ফিরিয়ে দেখে সন্ধ্যের আলোয় রাজীব
দাঁড়িয়ে আছে তাদের ছাদের সিঁড়িতে।
“তুই?”
“ভাল লাগছিল না, তাই চলে এলাম”
“আয়, বস”, অঞ্জন রাজীবকে নিজের পাশে ডাকে।
অঞ্জনের পাশে এসে পাঁচিলে হেলান দিয়ে বসে রাজীব, “দিদি কাল
বিকেল থেকে বাড়ি ছেড়েছে, রাতে একবার এসেছিল, টি. পি. মাইতিটা নিয়ে আবার চলে গেছে”
“সে কি!”
“ওর কোনো বন্ধুর বাড়িতেও নেই, খোঁজ করে এলাম”
“তাহলে? পুলিশে জানাবি?”
“নাহ্, জানানো যাবে না, জ্যে ফেঁসে যাবে”
“ওহ্, তাহলে?”
“আর কি, অপেক্ষা করতে হবে। টি. পি. মাইতি নিয়ে গেছে মানে
ঠিকই আছে”
“হুম্”
দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। ওদের চোখের সামনে দিয়ে
ক্যান্টিলিভার উঠে যায়, নেমে আসে।
“তুই এই অন্ধকারে ছাদে কি করছিস?” রাজীব জিজ্ঞাসা করে।
“কিছু না, ভাললাগে ছাদে আসতে। রাজীব,-” বলেই থেমে যায়
অঞ্জন।
“কি?”
“আমি গরিমাকে করেছি”
রাজীব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অঞ্জনের দিকে, তারপর
বলে ওঠে, “বাল!”
আবার দুজনে চুপ হয়ে যায়,
রাজীব বলে, “কেমন লাগল রে?”
অন্ধকারে অঞ্জন বলে “ভালই”
“পুরো চুদেছিস!? সামনে, না পিছনে?”
“হুম”
“হুম মানে কি?! সালা, দুটোই!” অঞ্জনের ঊরুতে জোরে চাটি মারে
রাজীব।
অঞ্জন কিছু বলে না।
“ভাই বল! ভাই, কেমন হল! বল ভাই!” উত্তেজিত হয়ে অঞ্জনের কোলে
উঠে বসে রাজীব।
অঞ্জন হেসে ফেলে। অঞ্জনের গলা জড়িয়ে রাজীব তার কোলে বসেই
লাফাতে থাকে উত্তেজনায়।
“কাকুর কথা মনে পড়ে তোর?”
রঞ্জনা মুখ তুলে ঋতমের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে, তারপর
বলে, “রেয়ার”
“ছোটবেলায় তো তুই খুব বাবা ন্যাওটা ছিলিস”
“বড় হয়েও ছিলাম”
“তবে?”
“জাস্ট মনে পড়েনা, কি করব!”
“হুম”, ঋতম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
“হতাশ হলি যে?”
“তোর মুঠো খুব আলগা জানিস তো,”
“জানি, এজন্য আমার মাঝেমধ্যে খারাপও লাগে”
ঋতম অল্প হাসে।
“তোর মনে পড়ে?”
“কি?”
“তোর বাবার কথা?” রঞ্জনা জানতে চায়।
“মা তোকে বলেছে?”
“হ্যাঁ, সকালে কথা হচ্ছিল”, রঞ্জনা জানায়।
“পড়ে, ওই রেয়ারই”
“মৃতের প্রতি অভিযোগ পুষে রাখা যায় না, তাই আমার কোনো রাগ
নেই, কিন্তু, তোর রাগ হয় না অরীন রায়ের উপর?”
“হতো, একটা সময় প্রতিশোধ নেওয়ার কথাও ভাবতাম”
“তারপর?”
“তারপর একবার বইমেলায় দেখলাম ওনাকে, অটোগ্রাফ দিচ্ছেন, ভীড়ে
মিশে কাছে চলে যেতে দেখতে পেলাম অনীতা
সিরিজ বইটায় সই করছেন। দেখলাম, ওনার মুখে বইটায় সই করতে করতে, জানিস তো, একটা
অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল যেন, আমি ছিটকে সরে এলাম”
দুজনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
“তারপর থেকে কেন জানিনা আর রাগ আসেনা”
“দুর্বল হয়ে পড়েছিস?”
“নাহ্, বলতে পারিস ক্ষমা করে দিয়েছি।”
অঞ্জন গরিমার সামনে বসে আছে প্রায় পনেরো মিনিট হল। এখনও
পর্যন্ত সঠিক কোনো অজুহাত সে খুঁজে পাচ্ছে না। অপমানে গরিমার কান, নাকের পাটা লাল
হয়ে আছে।
“আমাকে খুব সস্তা মনে করিস, না? যেহেতু মুখ ফুটে না চাইতেই
তোর সাথে শুয়েছি?”
মুখ না তুলেই মাথা নাড়ে অঞ্জন।
“তোর যদি কিছু বলার না থাকে বেরিয়ে যা এখান থেকে”
অঞ্জন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, যেতে গিয়েই থামে, বলে, “আমি
তোকে ভালবাসিনা”
গরিমা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকায় অঞ্জনের দিকে, তারপর হঠাৎই
হাসতে শুরু করে দেয়, অঞ্জন অবাক হয়ে তাকে দেখতে থাকে।
হাসতে হাসতেই গরিমা বলে ওঠে, “ওহ্ তুই এইজন্য চাপ খেয়ে
গেছিলি! হা হা!”
“হাসছিস যে?”
“ভালো না বাসলে কি শুতে নেই? কোন গীতায় একথা লেখা আছে?”
অঞ্জন কোনো কথা খুঁজে পায় না।
“বস তুই...গান্ডু!”
অঞ্জন বসে পড়ে, “না মানে, সেদিন তুই ফিঙ্গারিং শুরু করতেই
আমার অন্য একজনের কথা মনে পড়ে গেল, আমার
মনে হল আমি যদি তোর সাথে শুই তাহলে তাকে ঠকানো হবে।”
“ভালোবাসিস তাকে?”
“জানিনা”
“সে?”
“জানেনা”
“জানেনা মানে, বলিসনি তাকে?”
“নাহ”
“বলে দিস”
“হুম, দেখি”
গরিমা অঞ্জনের চোখে তাকিয়ে বলে, “তাহলে আমরা এটা আর করব
না?”
“না রে, আর পারবো না মনে হয়”
“এত দ্বিধা কেন তোর? দেখি... মনে হয়... জানিনা...- তুই আদৌ
ওকে ভালোবাসিস? এটা ইনফ্যাচ্যুয়েশান নয় তো...”
অঞ্জন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর হেসে বলে, “এটা
প্রথমবার তো, তাই শিওর হতে পারছি না, পরের বার থেকে আর দ্বিধা করব না।”
বেরোতে গিয়েও ঋতম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, ঘরের ভিতরে
ঘুমিয়ে আছে রঞ্জনা, জানালা দিয়ে তার মুখে আলো এসে পড়ছে, পায়ের থেকে চাদর সরে
গিয়েছে অনেকটা, শীত লেগে কুঁকড়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। ঋতম মনে মনে ভাবে, ঘুমোলে
মানুষকে সত্যিই শিশুর মত দেখায়।
“ওকে বাঁধা সম্ভব নয়”
চমকে পিছন ফিরলে ঋতম দেখে অনীতা কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছেন।
“জানি, বাঁধতে চাইও না আর”
“তবু হাতে ফাঁকা খাঁচা নিয়ে বসে আছিস এখনো”, অল্প হাসেন
অনীতা।
“যদি কোনোদিন...”
“যদি... শব্দটা খুব ক্ষতিকর ঋতম, আমায় দেখে টের পাস না
সেটা?”
“দেখি মা। কিন্তু এতে ক্ষতির কিছু দেখিনি কখনো”
অনীতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন ঋতমের দিকে।
ঋতম বলে, “উনি চলে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ওনার চলে যাওয়াটা
আমার কাছে, ওনার এই না থেকেও আমাদের মধ্যে থেকে যাওয়ার চেয়ে, বড় হয়ে ওঠেনি
কোনোদিন”
অনীতা মাথা নিচু করে ফেলেন।
“খাঁচাটা কোনো দিনই ফাঁকা ছিল না, অপেক্ষা ভরা আছে
খাঁচাটাতে, আর সেটা খাঁচাটার শূন্যতার চেয়ে অনেক বেশি ভারী।”
অনীতা চুপ করে থাকেন।
“আমি আসি মা।”, ঋতম বেরিয়ে যায়।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন