কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ২ অক্টোবর, ২০১৭

সুবীর সরকার

উত্তরকথা





(২২)

পেছনে তখন পড়ে থাকছে দলদলির ভরা হাট। কত কত মানুষের, চেনা অচেনার এক চারণভূমি। কইকান্ত আর রাধাকান্তর তখন গরুর গাড়ির দুলুনিতে কেমন এক ভ্রমবিভ্রমের নেশার পাকে জড়িয়ে পড়বার দশা হয়। না কি, তারা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তে থাকে। একটা চলমান জীবনের দীর্ঘতাকে তারা অতিক্রম করে আসতেই থাকে। বামনডাঙ্গার সেই রাতের আন্ধারে মিশে থাকা আহত চিতাবাঘের হাহাকার থেকে সোমেশ্বরীর বিবাহনাচের দলে তুমুল নাচতে থাকার দৃশ্য ভরা হাটের ওপর উড়তে থাকা বগিলার মতন কেবলই পাক খেতে থাকে। ঘুমে ঢলে পড়বার আগে তাদের কানে এসে বাজে গান-

‘চিলমারিয়া চিকন চিড়া
দিনাজপুরের খই
ও রে, অংপুরিয়া বাচ্চা বাপই
কুড়িগ্রামের দই’

জীবনের ওঠাপড়ার দিকে বারবার যেতে যেতে অনন্তের এক যাপনের কাছেই তো কইকান্তদেরকে যেতে হয়। আসা ও যাওয়ার ভিতর উত্তরাঞ্চলের হাটগঞ্জ পাথার নদী মেঘ ও মইষাল মিশে থাকে। ধান-পাট-সরিসার ক্ষেতে সাদা বকের  দল, শালিকের দঙ্গল, খোরা জালে বন্দী ঝাঁক ঝাঁক মাছ সব নিয়ে মানুষের আবহমানের জীবনযাপন। নদী নদী ফরেষ্ট ফরেষ্ট এক জীবনে কেবলই জুড়তে থাকে উত্তরের নোলোক পড়া মেয়েদের গান-

‘ঘাড়ত কেনে গামছা নাই
গামছাবান্ধা দই নাই
হাত্তির পিঠিত মাহুত নাই
মাহুতবন্ধুর গান নাই
দাড়িয়াবান্ধা খেলা নাই
বড় গাঙত পানি নাই
ও রে, আজি মন কেনে মোর
উড়াং রে বাইরাং করে’




(২৩)

কুদ্দুস, ইয়াসিনদের কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে গেল ধলা গীদালের কথা৫০/৮০ মাইলের ভিতর যত হাট, যত গাঁ গঞ্জ, যত ফরেষ্ট সবখানেই মিথের মতন এই ধলা গীদাল। বাবড়ি চুল, কপালে অজস্র কুঞ্চন, হাতির দাঁতের চিরুনী চুলে ছুঁইয়ে তার কিসসা বলা, আর দোতোরা বাজিয়ে সর্বশরীরে দুলুনি এনে গান শুরু করা উত্তরের এত এত জনপদগুলিতে তাকে ঘন জঙ্গলের প্রাচীন শালগাছের মতন উপাখ্যানের নায়ক করে তুলেছে। আর হাটে হাটে তাকে নিয়ে যে কত কত উপকথা ঘোরে, তার ইয়ত্তা নেই। আজ পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে এমনই হয়ে আসছে। গানে গাঁথায় তার বুনে যাওয়া কথাকিসসায় আস্ত এক সময় ও উত্তরের ভুবনজোত। হাতি জোতদারের বাড়ির ডাকাতির গল্প বল, কোচবিহারের রাজকুমারের সেই মহাশিকার বল, রাজকুমারী নীহারবালার বিবাহে দু’রাত্তিরের গানপালার আসর বল, কালজানি নদীর সেই ভয়াবহ বন্যা বল, ঝামপুরা কুশানীর কুশান গানের যাদুতে আটকে থাকা বল, জল্পেশের ভরা হাটের সেই সিজিলমিছিল বল - সব সবকিছুই ধলা গীদালের আখ্যানের জরুরী অংশ হয়ে পড়ে। সে তার দল গড়েছে কত কত বার। কত কত গীদালের গুরু সে। কত বাবুর ঘরের জ্ঞানী মানসি, খবরের কাগজের বাবুর বেটা, কত সিনেমার মানসি তাকে নিয়ে কাজ করতে চেয়েছে। দ্যাশ বইদ্যাশে নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই ধলা গীদালের মন জয় করতে পারে নি তারা। ধলা গীদাল এই হাটটাট গঞ্জগাঁ নদীমাঠের জঙ্গলের ছায়ায় ছায়ায় কেবল থাকতে চেয়েছে, আদিঅনন্ত আবহমানের এক জীবন জড়ানো উত্তাপ জড়ানো জীবনের ভেতরেই। তার হাসিমুখের কুঞ্চনে সে কেবল গেয়েই চলেছে জীবনেরই গান-

‘ধান কাটে ধানুয়া ভাইয়া রে
ও জীবন, ছাড়িয়া কাটে ও রে নাড়া
সেই মতন মানুষের দেহা
পবন গেইলে মরা জীবন রে’




(২৪)

আস্ত একটা জীবন নিয়ে কী করে মানুষ! এই জিজ্ঞাসাই কি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মানুষকে! জীবন যাপন করতে করতে কি ক্লান্তি জমে! ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গিয়ে কি এক খোঁজ পীড়িত করতে থাকলে তখন তো আর পলায়ন ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। সেরকম এক উপায়হীনতা থেকে ফরেষ্ট ফরেষ্ট হেঁটে হেঁটে কুদ্দুস ও ইয়াসিন এক কুড়ি সাত বছর আগে চলে গিয়েছিল আসাম দেশের এক বাথানে। কিন্তু তাদের সর্বশরীরে মিশেই ছিল উত্তরের সব নাচ, সব গান, সব গানবাড়ি, রাতের পর রাতের সব গানপালার আসরগুলি। আর ছিল ধলা গিদাল। তার এত এত সময় ডিঙিয়ে আবার ফিরতে হলো তাদের। আর এই ফেরাকে উৎসবের মর্যাদা দিতে মধ্য হাট থেকেই আজ ফিরতে হচ্ছে রাধাকান্ত আর কইকান্তকে। এসবের ভিতর সাজিয়ে রাখা থাকছে গানের পর গান-

‘ছাড়িয়া না যাইস রে
বুকে শ্যালো দিয়া
তুই সোনা ছাড়িয়া গেইলে
আদর করিবে কায় জীবন রে’...









0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন