তার চেয়ে
ঠাকুরমশায় ছক দেখে বললেন, ছেলের নাম তালব্য শ দিয়ে রাখতে হবে। কাকুমণি কবিতা-টবিতা লেখে, বলল শৌর্য। কারুর ভালো লাগল না। কেউ বলল – মনে হচ্ছে ইতিহাস বই থেকে কেউ একটা এসেছে। শোভন, শুভনাথ, শমিক কোনোটাই টিকল না। শেষে কে যেন
বলল, তার চেয়ে ভালো শুভকমল নামটা। এই ‘তার
চেয়ে’ ভালো নামটাই রইল।
শশীভূষণ হাইস্কুল কাছেই। কিন্তু
শোনা গেল তার চেয়ে ভালো ভারত বিদ্যামন্দির।
একটু দূরে তো কী হয়েছে! শিক্ষাই তো সব। তার চেয়ে ভালো ইসকুলেই ভর্তি করানো হলো।
দিন যায়, বছর কাটে। বোর্ডের
পরীক্ষায় সেকেণ্ড ডিভিশন। বি এ পড়ার কথা ছিল, এমন সময় শোনা গেল, তার চেয়ে ভালো বি
কম। চাকরি পাওয়ার ‘স্কোপ’ নাকি বেশি। অতএব বি কম। চাকরি খুঁজতে গিয়ে কিন্তু ‘তার চেয়ে’ ভালো
ব্যাপারটা দেখা গেল না। বাজারে চাকরিই
নেই। বাবা কাজ করেছেন এক সওয়াদাগরি আপিসে, সেখানে কিছুটা সুনাম ছিল। সেখানে বাবার
ধরাধরিতে শুভ একটা কেরাণির চাকরি পেল। এরপর যা হয় – আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন। খরচ কম করতে লেখা হলো ‘গৃকনি’। মানে গৃহকর্ম নিপুণা পাত্রী চাই। চিঠিতে ছবিতে ঘর ভরে গেল। একজনের সঙ্গে যখন প্রায়
ঠিকঠাক তখন মাসি এসে বলল – ও মা এই মেয়ে! তার চেয়ে এই মেয়েটা তো অনেক ভালো। তার চেয়ে ভালো যখন তখন সেই কথাই রইল। একদিন এল পি
রেকর্ড থেকে মাইকে শোনা গেল আলি হোসেনের আলাহিয়া বিলায়ল। বউ ঘরে এলো।
দিন যায়, বছর কাটে। পরিবর্তন জগতের
নিয়ম, তাতে কেউ ডুবতে
থাকে, কেউ উন্নতি করে। ছেলেরা ভালো ভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় শুভকমলের পরিবার পাতি মধ্যবিত্ত অবস্থা থেকে বেশ খানিকটা ওপরের দিকে উঠে
এসেছে। যেমন আজকে এই পিকনিকে দেখা যাচ্ছে। দু’দুটো ভাড়া করা ইনোভা
ছাড়াও বড় ছেলের ইণ্ডিগো মাঠের ধারে। অনেক খাবার দাবার, ক্রিকেট ব্যাটবল, ব্যাডমিন্টনের পালক, শতরঞ্জি, ভাঁজ করা হালকা চেয়ার।
মাঠে পিকনিকের আসর বসাচ্ছে সকলে। দাদু, তুমি আগে এখানে চেয়ারে
বোস! একটা করবী গাছের নিচে শুভকমল বসলেন। এমন সময় ছোট ছেলের শ্যালক বিমল এসে বলল – আরে এখানে কেন, তার চেয়ে ওই জলের ধারটা
অনেক ভালো হবে। কয়েকজন গিয়ে দেখে এলো। হ্যাঁ, এ জায়গাটা
যা তার চেয়ে ওখানটা ভালো।
শুভকমল অবশ্য বললেন, তোরা যা, আমি এখানেই
বসি। এই পাশেই তো থাকবি। ঠিকই। সকলে ওই দিকটায় চলে গেল।
সকালের
দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। একটু হাওয়া দিতেই করবী গাছটা থেকে দু’চার
ফোঁটা জল ঝরে পড়ল শুভকমলের গায়ে মাথায়। শুভকমলের মনে হলো – ‘তার চেয়ে’ ভালোর পেছনে না-দৌড়োনোর মধ্যে
কেমন একটা ভারি নরম প্রাণ-জুড়োনো স্বস্তি
আছে। কয়েক ফোঁটা শান্তির জল ছিটিয়ে করবী গাছটা যেন সেই কথাটাই কানে কানে বলতে
চাইছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন