কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

স্লাভো জিজেক

 

ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনে প্রকৃত বিভাজন রেখা

(অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী)



 

ইজরায়েলের উপর হামাস যে বর্বর আক্রমণের মুখটি খুলে দিয়েছিল তাকে নি:শর্তভাবে এবং কোন 'যদি’ এবং ’কিন্ত’ ছাড়াই সমালোচনা করা উচিত। গণহত্যা, ধর্ষণ এবং ইহুদি গ্রাম এবং কিবোতজিম বা যৌথ খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইজরায়েলের ছোট শহরগুলো থেকে বেসামরিক নর-নারীদের অপহরণ এবং একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান যা শেষমেশ একটি সংগঠিত গণহত্যার কেন্দ্রে পর্যবসিত হয় - এসবই নিশ্চিত করে যে হামাসের সত্যিকারের লক্ষ্য ছিল ইজরায়েল রাষ্ট্র এবং সব ইজরায়েলীকে হত্যা করা। সুতরাং বলতেই হবে যে বিদ্যমান পরিস্থিতি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের পর্যালোচনা দাবি করে - কোন ন্যায্যতার দাবি হিসেবে নয়, তবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে সামনে উত্তরণের জন্য গোটা বিষয়টা সম্পর্কে স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে প্রথম বিবেচনার দিকটি হলো যে নিরঙ্কুশ হতাশা অধিকাংশ ফিলিস্তিনীর জীবনকে অন্যদের জীবন থেকে আলাদা বা স্বতন্ত্র করে। আজ থেকে এক দশক আগে জেরুজালেমের রাস্তায় যে বিচ্ছিন্ন আত্মঘাতী হামলাগুলোর ঢেউ দেখা দিয়েছিল, সেই হামলাগুলোর কথা একবার স্মরণ করুন। একজন সাধারণ ফিলিস্তিনী তেড়ে যাচ্ছে কোন ইহুদির দিকে, ছুরি টেনে বের করে নিরীহ প্রতিপক্ষকে আঘাত করছে যদিও এই ফিলিস্তিনী ভাল করেই জানে যে এই অসহায় প্রতিপক্ষ সাথে সাথে মারা যাবে। এই 'সন্ত্রাসী’ আচরণ বা কাজগুলোর কোন নিহিত বক্তব্য ছিল না, ‘প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করো!’ জাতীয় কোন আর্তনাদও ছিল না। এই বিচ্ছিন্ন ফিলিস্তিনী আক্রমণকারীদের পেছনে কোন বৃহত্তর সংগঠনও ছিল না। এগুলো ছিল ভয়ানক হতাশার চিহ্নবাহী কিছু ব্যক্তিগত আক্রমণ।

বিষয়গুলো আরো মন্দ দিকে বাঁক নিলো যখন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু চূড়ান্ত ডানপন্থী এবং ইহুদি অভিবাসী  বা সেটেলার সমর্থক দলগুলোর সাথে একটি নতুন সরকার গঠন করলেন যারা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনী এলাকাসমূহকে ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্তিকরণের পক্ষেও প্রচার চালায়। জাতীয় প্রতিরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নতুন মন্ত্রী ইতামার বেন-গ্ভির মনে করেন যে, ‘পশ্চিম তীরে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে পারা আমার অধিকার,  আমার স্ত্রীর অধিকার, আমার সন্তানদের অধিকার এবং সেটা আরবদের অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ’। এই ব্যক্তি আরব-বিরোধী চরমপন্থী দলগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য অতীতে সেনাবাহিনীতে কাজ করা চালিয়ে যেতে বাধা পেয়েছিল যেহেতু ইহুদিবাদী ঐ চরমপন্থী সংগঠনগুলো ১৯৯৪ সালে হেবরনে আরব গণহত্যার জন্য দায়ি ছিল।

মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব অবস্থান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গর্ব করা ইজরায়েল নেতানিয়াহুর বিদ্যমান সরকারের অধীনে ইজরায়েল একটি ধর্মবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের ‘মূল নীতিমালা’-র তালিকা পরিষ্কারভাবেই বলছে: ‘ইজরায়েলের সব অংশের ভূমির উপর ইহুদি জনগণের  রয়েছে চূড়ান্ত ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার। গালিলি, নেগেভ, গোলান, জুদিয়া ও সামারিয়া সহ সরকার  ইজরায়েলের সব অংশে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের অবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টা চালাবে।’

ইজরায়েল সরকারের এমন সব প্রতিশ্রুতির মুখে ইজরায়েলের সাথে আলাপ-আলোচনায় আসতে না চাইবার  জন্য ফিলিস্তিনীদের নিন্দা-মন্দ করাটা বেশ অযৌক্তিকই মনে হয়। ইজরায়েলের বর্তমান সরকারের দাপ্তরিক কর্মসূচীই আলোচনাকে টেবিল থেকে সরিয়ে নিয়েছে।

কিছু ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা অবশ্য জোর দিয়ে বলেই যাবেন যে নেতানিয়াহু সরকার নিশ্চিত জানতেন যে সামনে  কিছু আক্রমণ ইজরায়েলের উপর আসতে যাচ্ছে যেহেতু গাজায় ইজরায়েলী প্রহরা এবং গোয়েন্দা গতিবিধি সংক্রান্ত সক্ষমতার শক্তি যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে। কিন্ত যখন (হামাসের) এমন আক্রমণ ক্ষমতায় থাকা ইজরায়েলী চরমপন্থীদের স্বার্থকেই রক্ষা করে, তখন নেতানিয়াহুর ’মিস্টার নিরাপত্তা’ হবার দাবির প্রতি সন্দেহ ছুঁড়ে দেয়।

সত্যি বলতে দু’দিকেরই - হামাস এবং ইজরায়েলের অতি-জাতীয়তাবাদী সরকার - এই দুই পক্ষের অবস্থানই যে কোন বিবেচনায় যে কোন রকমের শান্তির বিকল্প পথ খুঁজে নেবার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান। দু’পক্ষই যেন মৃত্যুর পক্ষেই সংগ্রামে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। হামাসের এই আক্রমণ ইজরায়েলের নিজের ভেতরেই এক বড়  সঙ্ঘর্ষের সময় আছড়ে পড়েছে যখন নেতানিয়াহু সরকার ইজরায়েলের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতাকে সীমিত করার প্রয়াস চালাচ্ছিল। গোটা ইজরায়েল তাই একদিকে জাতীয়তাবাদী মৌলবাদী যারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করতে চায় এবং একটি সুশীল সমাজ আন্দোলনের ভেতর বিভক্ত যারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসের বিপদটি বুঝতে পারলেও অধিকতর মধ্যপন্থী ফিলিস্তিনীদের সাথে মৈত্রী গড়তে অনিচ্ছুক।

ইজরায়েলে এখন ঘনিয়ে আসা সাংবিধানিক সঙ্কট আপাতত: স্থগিত রাখা হয়েছে এবং জাতীয় ঐক্যের একটি সরকার ঘোষণা করা হয়েছে। এ সেই পুরনো গল্পই: বাহ্যিকভাবেই দেখা যাচ্ছে এবং গভীর, অন্তর্গত  বিভাজন সহসা এক বহি:স্থ বৈরীর কারণে কেটে গেল - যে বৈরী উভয়ের কাছেই বৈরী।  কিন্ত ঘরের ভেতরে শান্তি এবং একতা বজায় রাখার জন্য একজন বহি:স্থ বৈরী তবে থাকা একান্ত দরকার? কীভাবে এই দুষ্ট চক্র ভাঙ্গা সম্ভব?

প্রাক্তন ইজরায়েলী প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট অবশ্য মনে করছেণ যে, সামনে এগিয়ে যাবার রাস্তা হলো হামাসের সাথে লড়াইয়ের পাশাপাশি ইহুদি-বিদ্বেষী নয় এমন ফিলিস্তিনীদের কাছে পৌঁছানো এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার জন্য প্রস্তÍত থাকা। ইজরায়েলী উগ্র-জাতীয়তাবাদীরা যেমনটা দাবি করে যে কোন ’শান্তিবাদী ফিলিস্তিনী’ নেই, সেটা সত্য নয়। বরং এই দাবির উল্টোটাই - শান্তিবাদী ফিলিস্তিনীরাও রয়েছেন। সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে শতাধিক ফিলিস্তিনী শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবী একটি খোলা চিঠিতে ’মানবতার বিরুদ্ধে নাজি অপরাধকে যে কোনভাবে লঘু করে দেখা, এর যে কোন রকম ভুল ব্যাখ্যা অথবা  ইহুদি-বিদ্বেষের বৈধতাদান অথবা নাজি বাহিনী কর্তৃক ইহুদি গণহত্যার বিরুদ্ধে কোন ঐতিহাসিক সংশোধনবাদের প্রচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা-র ডাক দিয়েছেন।’

একবার যদি শুধু আমরা স্বীকার করে নিই যে, সব ইজরায়েলী উগ্র জাতীয়তাবাদী নন এবং সব ফিলিস্তিনীই  উগ্র ইহুদি-বিদ্বেষী নন, শুধুমাত্র তখনি আমরা চারপাশের হতাশা ও সংশয়কে মেনে নিতে শুরু করতে পারব যা অশুভের বিষ্ফোরণ ঘটায়। শুধু মাত্র তখনি আমরা ফিলিস্তিনী এবং ইহুদিদের ভেতর কিছু আশ্চর্য মিলও দেখতে পাব - ফিলিস্তিনীদের কাছে আজ তাদের নিজেদের জন্মভূমিই অস্বীকৃত আর ইহুদিদের ইতিহাসও একই রকম দূর্ভাগ্যের অভিজ্ঞতায় আচ্ছন্ন।

'সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটির ক্ষেত্রেও একইরকম সাদৃশ্য। ফিলিস্তিনে বৃটিশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ইহুদি সংগ্রামের সময়ে ’সন্ত্রাসবাদী’ শব্দটির একটি ইতিবাচক অর্থ ছিল। ১৯৪০ সালে মার্কিনী সংবাদপত্রগুলোয় ’ফিলিস্তিনের সন্ত্রাসবাদীদের কাছে চিঠি’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হতো যেখানে হলিউডের চিত্রনাট্যকার বেন হেশট লিখতেন, ‘আমার সাহসী বন্ধুরা - আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে যা লিখছি তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না যেহেতু বাতাসে এই মূহূর্তে রয়েছে প্রচুর সার। তবে আমেরিকার ইহুদিরা তোমাদের পক্ষে রয়েছে।’

আজ যখন কে সন্ত্রাসী বা কী কী কাজ করলে কেউ সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচিত হবেন ইত্যাদি নিয়ে নানা তর্কের স্তÍপ জমে উঠেছে, সেই যাবতীয় তর্কের নিচে রয়ে গেছে অসংখ্য ফিলিস্তিনী আরব যারা দশকের পর দশক এক কারাগার রাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তারা কারা এবং এই  মৃত্তিকা কাদের? তারা কি ’অধিকৃত এলাকার’বাসিন্দা, ‘পশ্চিম তীরের’ মানুষ, ‘জুদিয়া এবং সামারিয়া’-র অধিবাসী অথবা ১৩৯টি রাষ্ট্র কর্তৃক  স্বীকৃত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এবং ২০১২ সাল থেকে যে রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘে একটি অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে রয়েছে? তবু ইজরায়েল যারা বাস্তবে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, ফিলিস্তিনীদের সাময়িক বসতি স্থাপনকারী হিসেবে দেখছে, একমাত্র খাঁটি আদি বাসিন্দা হিসেবে ইহুদিদের একটি ’স্বাভাবিক’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাধা বা প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছে। রাষ্ট্র হিসেবে ইজরায়েল কখনোই তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়নি, কোন আশা দেখায়নি অথবা রাষ্ট্রে তাদের ভূমিকার কোন সদর্থক রূপরেখা আঁকেনি।

সত্যি বলতে হামাস এবং ইজরায়েলী চরমপন্থীরা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র। আমাদের তাই দুই চরমপন্থার কোনটিকে বেছে নেব সেই ভাবনার বদলে উভয়পক্ষের মৌলবাদী এবং উভয়পক্ষের ভেতরেই তুলনামূলক যুক্তিবাদী যারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন, তাদের ভেতর একটি পক্ষকে বেছে নিতে হবে। ফিলিস্তিনী এবং ইজরায়েলী চরমপন্থীদের সাথে কোন সমঝোতাই হতে পারে না এবং এই উগ্রবাদীদের সাথে লড়তে হবে একই সাথে ফিলিস্তিনী নিরাপত্তার অধিকারের পক্ষে মুক্ত কণ্ঠ  দাবি তোলার সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ইহুদি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধেও অটুট ও অবিচল লড়াইয়ে সামিল হতে হবে।

একথা শোনাতে যতই অলীক বা অবাস্তব শোনাক, এই উভয় সংগ্রামই মূলত: একটি সমগ্রেরই অংশ। সন্ত্রাসবাদী সব আক্রমণের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে আমাদের নি:শর্ত সমর্থন যোগানো উচিত। একইসাথে গাজা ও অধিকৃত ভূ-খন্ডে সত্যিকারের নি:সহায় ও হতাশ যে অবস্থার মুখোমুখি অসংখ্য  ফিলিস্তিনী বাস করছেন, তাদের প্রতিও নি:শর্তভাবে সহানুভূতিশীল হতে হবে। যারা মনে করেন যে এই  অবস্থানের ভেতর ‘বৈপরীত্য’ রয়েছে তারাই মূলত: আজ ফিলিস্তিনী ও ইহুদিদের ভেতর একটি সমাধানের রাস্তা কার্যকরী ভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন।

(স্লাভো জিজেক, ইউরোপীয়ান গ্র্যাজুয়েট স্কুলে দর্শনের অধ্যাপক, ’হ্যাভেন ইন ডিসঅর্ডার’গ্রন্থের লেখক। এই লেখাটি এবছরের ১৩ই

 অক্টোবর ’প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’ কর্তৃক প্রথম মুদ্রিত হয়।) 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন