কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

শিবাংশু দে

 

কবি ও সুরসুন্দরী

 


                

কবিকে নিয়ে ইয়ারকি-ফাজলামো তো আমাদের বাবাদের আমল থেকেই ছোকরাদের জন্য একটা প্রিয় ব্যসন। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। একশো ষাট বয়স পেরোনো একজন মানুষের প্রতি আর কীসের চ্যালেঞ্জ?  তবু টান না থাকলে কেউ ইয়ার্কি মারে না। উল্কার মতো লাফিয়ে ওঠা ঝলমলে জনতা কীভাবে পলকে ছাই হয়ে ধুলোয় মিশে যায়, এ জীবনে তা অগণন দেখা যায়। যদি তাই হয়, ব্যাপারটা হয়তো সামান্য হলেও সিরিয়স। বাঙালি হয়ে জন্ম নিলে কবির প্রতি একটা 'টান' থেকেই যায়। 'টান' ব্যাপারটা ঠিক কোথা থেকে আসে? পারিবারিক উত্তরাধিকার? ব্যক্তিগত অনুভব? সামাজিক অভ্যেস? যাপিত বিজ্ঞাপন? হয়তো সবই, নানা মাত্রায়। সেদিন একটা লেখা পড়লুম। কয়েকজন ছেলেপুলে আড্ডা দিচ্ছে, তার শ্রুতিলিখন। সেখানে একটি ছেলে বলছে হানি সিং-এর যুগে ফিউসন না করলে বুড়োর গান টিকবে না। তার বন্ধুবান্ধবরা বঙ্গদেশীয় বাঙালি। তাদের অধিকাংশই যাপন অভ্যাসে কোনও না কোনও ভাবে কবি প্রভাবিত। ব্যক্তিসূত্রে হোক, বা পারিবারিক সূত্রে। কবির গান সম্বন্ধে তাদের ভালো লাগা, না লাগার নিজস্ব মাত্রা আছে। কিন্তু বাকি বন্ধুরা ওই ছেলেটির ‘স্মার্ট' সংলাপটির সঙ্গে একমত হতে দ্বিধা বোধ করছে।  গুড়গাঁওয়া-র বিগ ফ্যাট বিবাহ পার্টির গান-বাজনা বা বেঙ্গালুরু-র মধ্যরাতের পাব-এ জড়ো হওয়া মানুষজনের জন্য জকি-র বেছে নেওয়া গানের মধ্যে কবির গান যে আসবে না, সে নিয়ে তো কারো মনে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু হানি সিং-এর গান আসবে। কবির গানের প্রতি কি কোনও মাথার দিব্যি রয়েছে? তাকে কেন সতত, সর্বত্র প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে? অনেক সমঝদারই তো বলেন কবির গান মানে 'নির্জন, এককের গান'।  কেউ ভিন্নমত হতে পারেন, কিন্তু কথাটা অনেকটাই সত্যি।

আমার মনে হয়েছে 'প্রাসঙ্গিকতা'র সমস্যাটি কবির গানের জন্য নয়। বাঙালিরা নিজস্ব 'সাংস্কৃতিক সম্পদ'  নিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই সম্পদের উত্তরাধিকারের সঙ্গে কবির গান ওতপ্রোত। প্রত্যেক বাঙালির জন্য তা এক  মূল্যবান ওয়ারিশনামা। আত্মপরিচয়ের সঙ্গে জড়িত। সে গানের  প্রতি কোনও রকম 'অবহেলা' একজন গড় বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কবির গান যাঁদের জন্য সৃষ্ট হয়নি, তাঁদের কাছেও যেন তার 'প্রাসঙ্গিকতা' থাকে । এই আকাঙ্খা বাঙালির অবচেতনে থেকে যায়। সেই তাড়না থেকেই হয়তো হানি সিং-এর সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেখার উতলপনা ।   

সারাদেশে বসবাস করার সূত্রে দেখেছি বাঙালি জাতির সঙ্গে গানের প্রসঙ্গ ইঞ্জিনের পিছনে কামরার মতো চলে আসবেই। হুবলির এক কন্নডিগা সহকর্মী চুপিচুপি শুধালেন কবির সব গানই কি ট্র্যাজেডি-কেন্দ্রিক? তাঁর শুনতে তেমনই লাগে। হায়দরাবাদে এক নিপুণ যন্ত্রশিল্পী ছিলেন। কখনও আমার সঙ্গে সঙ্গত করতেন। তাঁর ধারণা ছিলো 'গান' নিয়ে যে কোনও  'বাঙালি'র ধ্যানধারণা চূড়ান্ত। তা নিয়ে কোনও ভাবে ভিন্নমত হওয়া যায় না। কারণ তা কবির গান থেকে এসেছে। অথচ তিনি একবিন্দু বাংলা জানতেন না। কবির গান হৃদয়ঙ্গম করা দুরস্থান। শ্রদ্ধেয় মান্না দে'র স্মৃতিচারণে পড়েছি বম্বের একজন নামজাদা সঙ্গীতকার তাঁর কাছে অভিযোগ করতেন কবির গানে কোনও বৈচিত্র্য নেই। একদিন মান্না দে সেই সঙ্গীত পরিচালককে নিজের বাড়িতে ডেকে ঘন্টা ধরে নানা রকম রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন। শেষে শুনিয়েছিলেন 'ওগো স্বপ্নস্বরূপিনী'। উদ্দিষ্ট শ্রোতা গানের নেশায় এমন বুঁদ হয়ে পড়েন, কোনও মন্তব্য না করে নির্বাক বেরিয়ে যান তাঁর বাড়ি থেকে। পরে নাকি তিনি মান্না দে'কে বলেছিলেন সেই সব গানের নির্মাণ এক কথায় 'অপার্থিব'।  

নাহ, কবির গান নিয়ে লিখবো ভাবিনি। মুক্তপক্ষ ভাবনার কোনও দিশা থাকে না। কথার পিঠে কথা চলে আসে। আজ বিকেলে হাঁটতে বেরোইনি। বিভূতিভূষণ পড়ছিলুম। 'কিন্নরদল'। 'মণিডাক্তার'-এ এসে আটকে গেলুম। বিধু গয়লানির মেয়ে 'প্রমো'র গল্প পড়তে পড়তে মনে হলো যেন রাগ  মধুবন্তী। কোনও কারণ নেই। একেকটা রাগের পাগলামিই এরকম। মনে পড়ে গেলে শুনতেই হয়। পড়া ছেড়ে দিয়ে গেলুম রাশিদ খান সাহেবের কাছে। ওঁর সেই তরুণ বয়সে, ১৯৯১ সালে গাওয়া রাগ মধুবন্তী'র অনুষ্ঠানটি আমার প্রিয়। বহু বার শোনা, তবু পুরোনো হয় না। একটা অদ্ভুত রাগ। সেই কোথায় পঞ্জাবের শেষ প্রান্ত মুলতানের থেকে আসা একটা সুর থেকে রাগ মুলতানি, দক্ষিণদেশে এসে রাগ মধুবন্তী হয়ে গেলো। তোড়ি থাটের রাগ, কিন্তু তার সময় আসে অপরাহ্নে, কচি সাঁঝবেলায়। দরবারি বা রাগেশ্রী-র মতো গুমোর নেই কোনও। সহজ শৃঙ্গার রসের রাগ। কান বেয়ে মাথায় যায়। বোধের থেকে অনেক বেশি সখ্য  আবেগের গোধূলি আলোছায়ায়।

গান শুনতে শুনতে চলে যাওয়া বেলুরুর চেন্নাকেশব মন্দিরে সুরসুন্দরীদের সুর-জলসায়। শরীরের চোখ, মনের কান জুড়ে তাদের আবেশ পাহাড়ি মেঘের মতো চমক দিয়ে ভিজিয়ে যায়। এঁদের বয়সও তো কোণার্কের সুন্দরীদের সঙ্গে পাল্লা দেয়। কে বলবে? জন্মান্তরে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। আবার না জন্মালে এঁদের আর দেখা হবে না।  সারি সারি পাথর হয়ে থাকা সেই সব বিভঙ্গ বিলাসিনী  সুরসুন্দরীরা সামনে এসে দাঁড়ায় । কবি আর কী করে দূরে থাকেন? তিনিও পায়ে পায়ে, এভাবেই,

 

'...মুখে তার লোধ্ররেণু লীলাপদ্ম হাতে,

কর্ণমূলে কুন্দকলি কুরুবক মাথে,

তনু দেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাঁধা,

চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা।

বসন্তের দিনে

ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে...

 

…সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতো সন্ধ্যাতারা করে।

অঙ্গের কুঙ্কুমগন্ধ কেশধূপবাস

ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস।

প্রকাশিল অর্ধচ্যুত বসন-অন্তরে

চন্দনের পত্রলেখা বাম পয়োধরে।

দাঁড়াইল প্রতিমার প্রায়

নগরগুঞ্জনক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়…’

 

 

 

 


1 কমেন্টস্: