বর্ণমালার সাতকাহন
(১২)
আত্মঘাতী গোল। ছোটো থেকে বড়ো অর্থ বদলে অনর্থ করে। আত্মঘাতী গোল যে করে তার প্রতি পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নেয় ঘৃণায়। কতবার মনে মনে কতলোক হত্যা করে তাকে। মুহূর্তের ভুল। সেই খেলোয়াড় বঞ্চিত সব সমবেদনা থেকে। বাঙালি পরিবারে চল্লিশ বছর আগে জীবন জুড়ে ছিল ফুটবল। যখন থেকে দেখানো হতো টিভিতে। মাঠ থেকে বলছেন অজয় বসু বা…
রেডিও কলকাতা ক। ধারাবিবরণী শুনতে
শুনতে উত্তেজিত। আমার দাদুরা এক একটা পাস এক একটা ভুল কর্নার বা পেনাল্টি নিয়ে বালকের মতো তুমুল তর্ক ও চেঁচামেচি করতেন। একান্নবর্তি পরিবার তো বটেই,
আশপাশের লোক ওপরতলার ভাড়াটে সকলে মিলে জড়ো
হয়ে খেলা দেখতেন। রাস্তা থেকে মনে হতো বাড়িতে বুঝি বিরাট কলহ হচ্ছে।
পরবর্তীকালে টিভিতে রাত জেগে বিশ্বকাপ
ফুটবল দেখা হতো বাবা, বিশেষত মা’র সঙ্গে। তাদের সময় আমাদের সময় মেলে না। তখন প্রায়
সকলেই ব্রাজিলের সাপোর্টার। প্লাতিনি-জিকো-
মারাদোনা আসার পর আলাদা হয়ে গেল শিবির পরিবারে। প্লাতিনির স্টাইল, মারাদোনার পাওয়ার
প্লেতে। সাফল্যের নিরিখে হৃদয় জয় করে এরপর আমরা সবাই হয়ে গেলাম আর্জেন্তিনার সাপোর্টার,
কেবল মারাদোনা ম্যাজিকে। দশ নং জার্সি অমরত্ব
পেল। অশোক দাশগুপ্তর ‘খেলা’ পত্রিকা আসত নিয়মিত। দেশ, আনন্দমেলা, নবকল্লোল,
প্রসাদ সহ। খেলা পত্রিকাটি তখন
আমার সবচেয়ে প্রিয়।
গাভাসকারের চির অনুরাগী ছিলাম।
একবার কল্যাণীতে এক জ্যাঠার বাড়ি গিয়ে দুপুরের পর সকলে স্থির টিভির পর্দায়। গাভাসকার
ব্যাট করছিলেন সেদিন তুমুল জ্বর গায়ে। সেঞ্চুরি করেছিলেন ওইভাবেই। উল্টো দিকে বিশ্বনাথ।
একটু বড়ো হয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপে তরুণ রবি শাস্ত্রী স্কুলে সকলের হার্ট থ্রব হলেন। আমি
অবশ্য ইমরান ও ওয়াসিম আক্রামের সৌন্দর্যে মোহিত। গাভাসকার যেন দেবতা। ‘সানি ডে স’ ও
আরো দুটি বই একেবারে বুঁদ হয়ে পড়েছি। মনে পড়ে, ফুটবলে বিরাট আলোড়ন ও আলোচনার বিষয়
হলো ডায়মন্ড স্ট্রাটেজি। কোচ হিসেবে কখনোই পি কে নয়, ভক্ত ছিলাম অমল দত্তর। পি কে-র
মতো তাঁর ক্ষমতার লবি ছিলো না। গ্ল্যামার ছিলো
না। তবু অমল দত্ত আমাদের প্রিয় কোচ ছিলেন ও থাকবেন।
ছোটো দাদুর কাছে স্লেট আর চকখড়ি দিয়ে এঁকে
এঁকে শিখেছি মিডফিল্ড, লিবেরো, বক্স টু বক্স মিডফিল্ড, ট্রাকোয়ারতিস্তো, ডিফেন্সের
নানা প্যাটার্ন।
সম্ভবত ৩_৪_৩ ছিল ৫_২_৩-এর বদলে ডায়মণ্ড-এ। অমল দত্তর সাফল্য। অনেক ভেঙে চুরে খেলাতেন, বিপক্ষ একদম ধরতে পারত না। ১ ২ ১ ৩ ২-তেও কখনো।
সুব্রত ব্যানার্জি, বাবু ঘোষ, বিদেশ
বোস, বিকাশ পাঁজি, সত্যজিত - এমনকি কৃশানু, বিকাশ, শ্যাম থাপা, কিম্বা ডাকনামে মনাদা।
জামশিদ নাসিরি ও মজিদ বাসকার কবেই হয়ে গেলেন বাঙালির হৃদয়ের মণি। আমাদের কাছে জীবনের
অনেকটা সময় জুড়ে খেলা ছিলো। খেলা মানে খেলা ছিলো না শুধু, বরং একটা উন্মাদনা।
খুব বেশিদিন নয় কিন্তু, অদ্ভুত
শিল্প ছিল মজিদের পায়ে। মোহনবাগান আত্মার আত্মীয়, চিমা ওকেরি, প্রথম বিদেশি এলেন আমাদের
সময়। আমাদের গ্রাম থেকে প্রচুর মেয়ে ফুটবল খেলতে যেত। কেউ কেউ এন সি সি করতে যেত। গ্রামের
মেয়েরাই মুখ্যত।
মুগ্ধ হয়ে দেখতাম তাদের।
ওই সময় ক্লাব বদলের ব্যাপারটা বিরাট টেনশনের ছিল। টুটু
বোস, অঞ্জন মিত্র এঁরা সব এব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। শিবির বদলের আগে দু’একজন ফুটবলার কিডন্যাপ
হবেই। সকলেই জানত। তারপর অনেক জলঘোলা। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা থাকলে প্রতিবার পাড়ায়
গৃহযুদ্ধ। সেদিন বন্ধু শ্যালক বউ অন্য পক্ষের হলে যা তা কাণ্ড হতো। কিন্তু ওইটুকুই।
সরলতা ছিলো অনেকটা বড়োদেরও।
ছোটোবেলায় অর্থাৎ আশির দশকেও এত
অশ্লীলতা ছিলো না।
আমরা ছোটরা যেমন বন্ধুকে বন্ধু
জানতাম, ছেলে বা মেয়ে হয়না তার। বড়ো হয়ে অনেক
পণ্ডিত সমাজে এটুকু পরিণত মস্তিষ্ক নেই দেখে দুঃখ পাই। পুরুষ ও নারী মানেই একটা কদর্য ইসারা। তাই মনে হয় ছোটরা অনেক
বিষয়ে বড়দের চেয়ে প্রাপ্তমনস্ক।
পাড়ার একটি ছেলে, পারিবারিক বন্ধু
আমার চেয়ে অগ্রজ, হঠাৎ স্বাভাবিকভাবে এমন অকথিত বিষয় হলো যে রিহার্সাল হলে বা আড্ডা
হলে সেই এবং একমাত্র সেই আমাকে বাড়ি দিতে আসবে।
আমাদের ছাদের পাঁচিলের ওপর বসে গল্প হতো রাত দুপুরে। বাবা একতলায় নিশ্চিন্তে বই পড়তেন, মা সমিতির মিটিং থেকে ফিরে
কখনো ভুরু কপালে তোলেননি। সেই কৈশোর আড্ডায় আমাদের মনেও কখনও কু-ইচ্ছা জাগেনি। আমার
মা বাবা, তাঁরা বুদ্ধিজীবী সমাজের ছিলেন না বা তাঁরা মহা পণ্ডিত ছিলেন না। একবার দোলের
দিনে সে আলাদা করে অনেক বেশি রং মাখিয়ে দিল। এক রাতে বাড়ি ফেরার পথে হাঁটু মুড়ে বসে
একটি রাংতা জড়ানো গোলাপ দিয়েছিল। সেদিন একটু মন একটু মাঠ পেরোলো সহসা। সেই গোলাপ নিহিত
প্রণয় পল্লবিত হওয়ার আগেই অবশ্য আমারই বান্ধবী তার প্রেমিকা হয়ে গেল। অচেনা এক অস্থিরতা,
অভিমানে শৃঙ্খলিত মূক পশুর মতো বুকের ভেতর ঝড় তুলেছিল। কাকে বলে ভালোবাসা? বয়স কম
থাকলে কিছু শব্দের অর্থ জানা যায় না যতই অভিধান পড়া যাক। প্রতারণা শব্দটা এরকম একটি
শব্দ।
সেই রাগ সেই তীব্র অভিমান কি কাজ
করেছিল আত্মঘাতী গোলটি করার সময়! জীবনের ময়দান থেকে ছিটকে যেতে হয় প্লেয়ারটিকে
খাদের কিনারে। তবু খেলা হয়। হার জিত থাকেই। খেলাটাই একমাত্র শর্ত।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন