কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধর্ষণ-সংস্কৃতি ও ধর্ষকের মনস্তত্ব    



জীবাশ্মবিদ ফিলিপ গুনৎস মানুষের মস্তিস্কের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় বানরদের খাদ্যাভাসের উল্লেখ করে বলেছেন যে তারা আজ অব্দি নিরামিশ খাবারই খায়।
এবং প্রায় ৩০ লক্ষ বছর আগে আদিম মানুষ ঘন ঘন মাংস খেতে শুরু করে যার ফলাফল হিসেবে তার মস্তিস্ক গোটা শরীরের তুলনায় বড় হতে শুরু করে এবং সেই মস্তিস্ককে কাজে লাগিয়েই আদিম মানুষ থেকে আজকের মানুষের ঊদ্ভব হয়েছে। মানুষ ছাড়া বোধহয় আর কোনও জীবজন্তুরই নিজস্ব কোনও সচেতন সংস্কৃতি ছিল না এবং আজও নেই। এমনকি আমাদের ওই আত্মীয়দেরও নয়। কেননা সংস্কৃতি হল টিকে থাকার কৌশল। নৃতত্ত্বে এবং সমাজতত্ত্বে সংস্কৃতি কথাটাকে আরও ব্যপক অর্থে ব্যবহার করা হয়। টাইলারের মতে, সমাজের সমষ্টিগত জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নৈতিকতা, রীতিনীতি, আইন, মানুষের অর্জিত বিভিন্ন অভ্যাস ও দক্ষতা – জটিল মিশ্র রূপ হল সংস্কৃতি। ম্যালিনস্কি বলেছেন, সংস্কৃতি হল মানুষেরই একটি উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য সাধন করে। কিন্তু নর্থের মতে, মানুষ তার অভাব মেটাবার প্রয়োজনে যে সব উপায় উদ্ভাবন করেছে সেগুলোই হল তার সংস্কৃতি। আবার অন্যদিকে গ্রাহাম ওয়ালাস বলেছেন, সংস্কৃতি হল মানুষের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ এবং উদ্দেশ্য সমূহের সমষ্টি। আবার পেয়ার বলেছেন, সংস্কৃতি হল সেইসব আচার, প্রথা, জ্ঞান ইত্যাদির সমষ্টি যা কোনো সমাজের সদস্যরা বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে। অন্যদিকে ম্যাকাইভার বলেছেন, সংস্কৃতি হল আমাদের প্রকৃতির প্রকাশ যা আমাদের জীবনধারা, চিন্তাচেতনা, সাহিত্য, ধর্ম, আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদির মধ্যে নিহিত থাকে।

তার মানে যেটা দাঁড়াল, সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক উত্তরাধিকার। এটা আসলে একটা সামাজিকভাবে উৎপন্ন বিষয় যার অংশীদার হল গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত প্রত্যেক সদস্যই।   

দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতি একটা অবিনাশকারী ব্যপার। সংস্কৃতি সমাজের রীতিনীতি, ঐতিহ্য, প্রথা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে বংশানুক্রমে সঞ্চালিত হয়।

তৃতীয়ত, প্রত্যেক সমাজেই সংস্কৃতির একটি স্বতন্ত্র ধারা প্রবহমান থাকে। এই ধারা অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে।

চতুর্থত, সংস্কৃতি হল একটা স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের সৃষ্টি করে। মানুষের মন এই ঐতিহ্য বহন করে চলে। তাই সংস্কৃতি মূলত মানসিক বা অন্তর্মুখী বিষয়।

ষষ্ঠত, সংস্কৃতি মানুষের প্রয়োজন মেটায়। গোষ্ঠীর সেই সব নৈতিক ও সামাজিক চাহিদা মেটায় সংস্কৃতি যেগুলো ছাড়া গোষ্ঠী টিকতে পারে না।

সপ্তমত, ব্যক্তির আচরণ কোনপথে এবং কতটা পর্যন্ত যাবে, কোন লক্ষ্যে সে পৌঁছাতে চায়, সংস্কৃতিই তা ঠিক করে দেয়।

সর্বোপরি, সংস্কৃতি মানুষের হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। জ্ঞান মানুষের বুদ্ধিকে উন্নত করে আর সংস্কৃতি তার হৃদয়কে গঠন করে। সংস্কৃতির সঙ্গে সামাজিক ক্ষেত্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সংস্কৃতিসম্পন্ন ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ব্যক্তির সংস্কৃতি সমাজের জীবনকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে ব্যক্তির জীবন সমাজের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়।

এবার একটু দেখে নেব আমরা ধর্ষণ কাকে বলে। সাধারণ ভাবে কোনও ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম বা অন্য কোনও ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানো হয় যখন, তখন তাকে ধর্ষণ বলা হয়। উল্লেখ্য শারীরিক বলপ্রয়োগ, অন্যভাবে চাপ প্রদান কিম্বা কর্তৃত্বের অপব্যবহার ধর্ষণের এক  গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। তাহলে কি যে সংস্কৃতিতে বা জীবনধারায় উপরোক্ত পদ্ধতিতে যৌনসঙ্গম  বা অনুপ্রবেশ ঘটানো হয় তাকেই আমরা ধর্ষণ সংস্কৃতি বলব? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, সেটাকে আমরা ধর্ষণ সংস্কৃতি বলব। তবে ধর্ষণ সংস্কৃতি বলতে শুধু সেই টুকুকেই বোঝায় না। ধর্ষণ সংস্কৃতি কথাটার চৌহদ্দি আরও অনেক ব্যপক ও বিস্তৃত। আমাদের ধর্ষণ সংস্কৃতির ঠিকঠাক অর্থ বুঝতে গেলে আরও একটু গভীরে যেতে হবে। আমাদের জানতে হবে ধর্ষকদের মনস্তত্ত্ব। তবেই আমরা বুঝতে পারব আসলে ধর্ষণ সংস্কৃতি বলতে ঠিক কী বোঝায়। তাহলে, পাঠক, চলুন এবার আমরা ধর্ষকদের মনস্তত্ব জানবার জন্য ইতিমধ্যেই যে সমস্ত গবেষণা ও সমীক্ষা হয়ে গেছে, করেছেন বিভিন্ন সমাজতাত্বিক ও মনস্তাত্বিকরা, সেইসব গবেষণা আর সমীক্ষা গুলোকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখি।

মানুষের  সম্মতিসূচক যৌন আচরণ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হলেও ধর্ষণ নিয়ে মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা একেবারে নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখনও পর্যন্ত ধর্ষণকে পরিস্থিতি-ফ্যাক্টর হিসেবেই দেখা হয় আর বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে তার নিস্পত্তির চেষ্টা করা হয়। তবে উন্নত বিশ্বে এ ব্যপারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ২০ টি বিভিন্ন কর্মসূচী চালু আছে যেখানে অপরাধীর মনস্তত্ব নিয়ে গবেষণা করা হয়। দেখা গেছে বেশ কিছু সংখ্যক ধর্ষকের মানসিক সমস্যা রয়েছে যার ফলাফল হিসেবে তারা নারীদের সহজ দৃষ্টিতে দেখতে পারে না শুধু নয়, অনেকেই অন্য মানুষদেরর সঙ্গে ভালোবাসা, বিশ্বাস, সহানুভূতি বা সমবেদনা পাওয়ার মতো কোনও সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। অপরাধ পরবর্তী শাস্তি, তার নিজ পরিবারের অসম্মান, ভিকটিমদের শারীরিক আঘাত – এইসব কিছুই তার মাথায় থাকে না। এই ধরনের গবেষণা ও সমীক্ষার পাশাপাশি ধর্ষণ করেও পার পেয়ে যাওয়া ধর্ষকদের ওপর গবেষণা করে ওয়েনস্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক মনবিজ্ঞানী আন্তোনিয়া অ্যাবে দেখেছেন যে যারা ধর্ষণ করে, তারা প্রথম যৌবন থেকেই দু একটা যৌন অপরাধ করতে শুরু করে বিশেষ করে হাইস্কুল বা কলেজের প্রথম দু এক বছরের মধ্যে। তাদের এটা শুরু হয় পরিচিত কারো সাথে কিছুটা সীমা অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে। অ্যাবে দেখেছেন যে যারা প্রথমবার অপরাধ করার পর   অনুতপ্ত হয় তারা পরবর্তীকালে সেই পথে আর যায় না এবং নিজেকে শুধরে নিতে সক্ষম হয়। অ্যাবের পাওয়ায়া তথ্য থেকে দেখা গেছে যে সব ধর্ষকরা ধর্ষণের পরে তার দায় ভিক্টিমের ওপর চাপিয়ে দেয় তারা ভবিষ্যতে আবারও ধর্ষণ করে। তাই যারা কোনও রকম যৌন হয়রানি করার পর অনুতপ্ত হয় না, তারা প্রত্যেকেই এক একজন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ধর্ষক।

আবার আমেরিকার সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল সাইকোলজি অব ভায়োলেন্সের প্রতিষ্ঠাতা হামবি বলেছিলেল, ’ধর্ষণ বা যৌননিপীড়ণকারী  অনেক পুরুষই মনে করেন সমবয়সীদের  মধ্যে সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার একমাত্র উপায় হল উচ্চতর যৌন অভিজ্ঞতা লাভ করা এবং নিজের পুরুষত্ব প্রমাণ করা। যৌন সক্রিয়তা না থাকা প্রায়শই কলঙ্কজনক তাদের জন্যে। অনেকে আতঙ্কে থাকে যৌন অভিজ্ঞতা আবিস্কার না করার কারণে’। হামবির মতে, এই ধরনের চাপের ফলেই পুরুষ যৌন অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। হামবীর দেওয়া এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পাঠকদের অনুরোধ করব সংস্কৃতির অর্থ অনুধাবনের জন্য। আমি শুরুতেই যে টাইলার, ম্যালিনস্কি, গ্রাহাম ওয়ালেস বা পেয়ারের দেওয়া সংস্কৃতির সংজ্ঞাগুলো উল্লেখ করেছিলাম, সেগুলোকে একবার মিলিয়ে নিতে। দেখুন খুব ভালো করে খেয়াল করে, হামবির দেওয়া তথ্যেও আমরা পাচ্ছি ধর্ষকদের মধ্যেও কিভাবে একই রকম জ্ঞান, বিশ্বাস, রীতিনীতি, চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ, আদর্শ কাজ করে। তাহলে এবার নিশ্চয়ই আমরা বলতে পারি যে এই সমাজে, এই পৃথিবীতে ধর্ষকদেরও নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে যেটাকে তারা মনপ্রাণ দিয়ে অনুসরণ করে চলে। অতএব একথা প্রমাণিত সত্য যে ধর্ষণ সংস্কৃতি বলে একটা ব্যাপার পিতৃতান্ত্রিক সমাজে রয়েছে বলে নারীবাদীরা যে দাবীটা করেন সেটা আদৌ শূন্যে ঢিল ছোঁড়া নয়। তার একটা বাস্তব ভিত্তি আছে। কি তাই তো ?

তিহার জেলে মধুমিতা পান্ডে ২০১২ সালে ধর্ষকদের নিয়ে একটা সমীক্ষা করেছিলেন। সেখানে তিনি দেখেন অধিকাংশেরই কোনও অনুশোচনা বা অনুতাপ তো নেইই বরং তাদের বক্তব্য ছিল মেয়েরা তাদের চোখের সামনে আগ বাড়িয়ে ঘুরে না বেড়ালে এত ধর্ষণ হত না। মধুমিতার বক্তব্য, ওই সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রায় প্রত্যেকেই মনে করে যে ‘ধর্ষকদের সঙ্গে সহজাত ভাবেই কোনও একটা কিছু ভুল করা হচ্ছে’। মধুমিতা পান্ডে তার সমীক্ষায় এমন একজনকে পেয়েছিলেন যে নিজে একজন মধ্যবয়সী  এবং সে পনেরো বছর বয়েসের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল। উদ্দিষ্ট ধর্ষকের অনুতাপ হয়েছিল। তবে সেটা তার কাজকর্মের জন্য নয়। বরং বাচ্চা মেয়েটির নষ্ট হয়ে যাবার কারণে। ঊক্ত ধর্ষকের বক্তব্য অনুসারে, ‘ও তো আর কুমারী নেই। কে আর ওকে বিয়ে করবে? জেল থেকে ছাড়া পেলে আমিই ওকে বিয়ে করব’। মধুমিতা পান্ডের এই সমীক্ষা থেকে বা উপরোক্ত ধর্ষকের বয়ান থেকেও এটা স্পষ্ট ধর্ষকদের মধ্যে একটা পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ থাকে যে আদর্শের কথা, ধ্যান ধারণার কথা, চিন্তাভাবনার কথা, ঐতিহ্য বা নিয়মনীতির কথা, আচার আচরণের কথা আমি একেবারে শুরুতেই উল্লেখ করেছি সংস্কৃতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পেয়ার-ম্যাকাইভার-টাইলার-এর বক্তব্যে। পাঠকদেরকে বলি, এখানে আরো আর একটা জিনিস লক্ষণীয়। ম্যালিনস্কি-নর্থ-গ্রাহাম ওয়ালেস যে উপায়ের কথা বলেছেন ব্যক্তির উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে, যে অভাব মেটাবার প্রয়োজনের উপায় উদ্ভাবনের কথা বলেছেন বা যে মূল্যবোধ এবং উদ্দেশ্য সমূহের কথা বলেছেন, উপরোক্ত ধর্ষকের স্বীকারোক্তি থেকে আমরা সেই মনোভাবকে খুঁজে পাই যার ফলে আমরা সহজেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে নিছকই কোনো চরম পুরুষ বিদ্বেষ থেকে নারীবাদীরা ধর্ষণ সংস্কৃতির অস্তিত্বের কথা বলেন না। ধর্ষণ সংস্কৃতির অস্তিত্ব একটা বাস্তব ঘটনা যেটা পিতৃতন্ত্রের বেশ খানিকটা চৌহদ্দি জুড়েই বহাল তবিয়তে বিরাজিত। 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন