কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


পিঞ্জর      

 

গতরাত্রির আধখানা প্রায় হুল্লোড়েই কেটে গেছে। ফিল্মিগান, মজার গল্প এসব যে যেমন পারো গাও শোনাও, তারপর ঘুম আটকাতে না পারলে একটু মটকা মেরে নাও, ব্যস। কী করা যাবে, টু বেডরুম কোয়ার্টার, গিজ গিজ করছে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবে। পারলৌকিক কাজকর্ম চুকেবুকে গেছে আজ নিয়মভঙ্গের ব্যাপারটা মিটে গেলেই এক বছরের জন্য নিশ্চিন্ত সামনের বছর বাৎসরিকটা হয়ে গেলে পুরো ঝামেলাটাই শেষ

পুত্র শুভ্রশঙ্খ বিবাহিততার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সংখ্যাই অধিকশুভ্রশঙ্খ তাদের খুব পছন্দের জামাই, তাই সুযোগ সময় পেলেই তারা এদিকেই পা বাড়ায়এটা তো আবার শুভ্রর মায়ের মৃত্যুযেতেই হবে দল বেঁধেঅনেকদিন একটা বিছানা দখল করে পড়েছিলেন মহিলাকেবল বিছানা কেন, ঘরটা? রোগীর ঘরে কারোকে থাকতে শুতে দেওয়া যায় নাকি? সে যদি আবার নিজের বাপের বাড়ির লোকজন হয়! শুভ্রর স্ত্রী মধুরা নিজেই বারণ করেছিল আসতেমাঝে মধ্যেই ফোনে কথা হত দিদি বৌদিদের সঙ্গেসকলের একই জিজ্ঞাসা কদ্দূর এগোলো বুড়িএই এগোনো কথাটা প্রথমবারে বুঝে উঠতে পারেনি মধুরাওর বড়দি যখন বুঝিয়ে বলল, এগোনো মানে অবস্থার অবনতি, মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া, সেদিন দু বোনের কি হাসি! হাসি থামতেই গম্ভীর গলায় বলেছিল মধুরা, ‘আমি যদিও করি না কিছুইওসব সেবা শুশ্রূষা আমার দ্বারা হবে না সে শাশুড়ি  হোক বা যেই হোক না কেনদিদি জানতে চেয়েছিল, ‘বিছানাতেই তো সবকিছু, তা আয়া রেখেছিস নাকি’? ‘উঁ, আয়া, পয়সা যেন গাছে ফলে’! দিদির কৌতূহল, ‘তবে কে করছে এতসব? শয্যাগত রোগীর খিদমত তো কম না’! মধুরার ঝটিত জবাব, ‘কেন, ওর আনম্যারেড বোনটা মানে ঘাড়ের বোঝা অলকা আছে না! আমি বলে দিয়েছি, আর তো কোন কাজ নেই তোমার, খালি তো রান্নাটুকু কর, মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে হ্যাঁ, মায়ের সেবায় কোন ক্লান্তি নেই তার, সেদিক থেকে আমি নিশ্চিন্ত দিদির কৌতূহলের যেন শেষ নেই আবার জানতে চেয়েছিল, ‘শুভ্র কি বলে’? বলে মধুরা, ‘কি বলবে আবার, আমি বলে দিয়েছি মা পড়ে আছে, তোমার বোন আছে তার জন্য, তোমাকে আদিখ্যেতা করতে হবে না ওষুধপত্র কোম্পানি হসপিটাল থেকে যা পাওয়া যায়, তাই যথেষ্ট ডাক্তার ফল দুধ খাওয়াতে বলেছে আচ্ছা তুইই বল দিদি, বিছানায় পড়ে থেকে বেঁচে থাকার কোন যুক্তি আছে’? এ ব্যাপারে মধুরার বাপের বাড়ির সকলেই একমত, বিছানায় পড়ে থাকা মানুষ নিজের কাছে যতখানি বোঝা, পরিবার সকলের কাছে তার দ্বিগুন বোঝা সে,যত শিগ্গির সে চোখ ওল্টাবে ততটাই মঙ্গল সকলের পক্ষেএদিকে ননদ অলকা মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মরিয়া মাকে ফল, হরলিক্ জাতীয় পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার কথা বলেছেন ডাক্তার ভেবেছিল, দাদা নিজে থেকেই সে সবের ব্যবস্থা করবে, কিন্তু কোথায় কী, হাসপাতালের বিনা পয়সার ওষুধ ছাড়া প্রেসক্রিপশনে লেখা বাড়তি কোন ওষুধ পর্যন্ত বাজে খরচের তালিকায় চলে যায়দাদাকে বলতে গেলেই দেখিয়ে দেয় বৌদিকে, ‘জানিস তো, সংসারটা তোর বৌদিই চালায়, আমি পেমেন্টটা এনে ওর হাতে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত, যা বলার তোর বৌদিকে বলবিচুপ হয়ে যায় অলকা জানে, বৌদিকে বলা মানেই দুদশটা কথা হজম করা ছাড়া আর কিছু হবার নয় অলকা হাড়ে হাড়ে টের পায়, বৌদি কী চোখে দেখে তাকে এই মা-টা চলে গেলে মনের সঞ্চিত কিছু ভার নামিয়ে দেওয়ার আর কোন জায়গাই থাকবে না অবশ্য এই অবস্থায় মাকে আর বিব্রত করতে চায় না অলকা তাই রাতের অন্ধকারে নীরবে চোখের জলে বালিশ ভেজায় বৌদি অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ে দুঃখ কাকে বলে জানে না, তাই কারো দুঃখে দোসর হবার মনটিও গড়ে  ওঠেনি তার স্বামী সন্তান আর বাপের বাড়ির লোকজন, তার ভাবনা ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ অলকা জানে, মা ধীরে  ধীরে দুর্বল হতে হতে কোন এক মুহূর্তে এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে, যে মুক্তির প্রার্থনা তার ঠোঁটে লেগে থাকে প্রতিনিয়ত দাদা বৌদিরহ্যাঁতেহ্যাঁমেলায়, ‘নাতেনা মায়ের মৃত্যু ওদের দুজনকে স্বস্তি দেবে কিন্তু ও যে চূড়ান্তভাবে একা হয়ে যাবে! ভাবে এক এক সময়, দাদার মেয়েটাকে, যে এখন মাত্র দুবছরের তাকে নিয়েই কাটিয়ে দেবে সময়, কিন্তু হবে কি তা? মায়ের কাছে দূরের কথা মায়ের ঘরে পর্যন্ত একটিবারের জন্যও বৌদি ঢুকতে দেয় না মেয়েকে মা একদিন বলেছিল তাকে, ‘আমার কাছে আসতে হবে না, অলকা, বল না বৌমাকে, তুই দরজার কাছে দিদিভাইকে কোলে নিয়ে একটু দাঁড়াবি, আমার দেখেই শান্তি বৌদিকে বলেছিল অলকা মায়ের এই  আর্তির কথা বৌদি চোখ কপালে তুলে বলেছিল, ‘সর্বনাশ! এ কথা বলেছে তোমার মা! তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি অলকা ওই রোগীঘাঁটা হাত দিয়ে আমার মেয়েকে ধরেছ তো তোমার হাত আমি ভেঙে দেব

এক রবিবারের সকালে সত্যি সত্যিই মা ওকে একা ফেলে পাড়ি দিল পরলোকের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল ও সর্বহারার মত চোখ ভরা বিরক্তি নিয়ে উঠে এল দাদা বৌদি দাদা মায়ের গায়ে হাত দিয়ে, নাড়ী দেখে বুঝলো মা আর নেই বৌদি জানতে চাইল, আছে না গেছে দাদা তৎপর হয়ে উঠল ডাক্তার ডেকে ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখিয়ে নিতে রবিবারে দুজনেই বেশ দেরী করে ওঠে বউদি তার বিরক্তির কথাটা চেপে রাখতে পারল না, বলা যায় সে সৌজন্যটুকু রক্ষা করার  প্রয়োজনও বোধ করল না ধাক্কাটা ততক্ষণে কিছুটা সামলে উঠেছে অলকা শুনতে পেল, বৌদি বলছে, ‘মরার আর সময় পেল না, মাটি করে দিল সকালের ঘুমটা অলকা আর কাঁদছে না এখন সান্ত্বনার একটাই জায়গা এখন আছে ওর কাছে, মা মুক্তি পেয়েছে এই অবহেলার জীবন থেকে শুরু থেকে মায়ের জীবনের সমস্ত ঘটনাগুলো প্যানোরামার মত একে একে ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে যেন চেতনা থেকে দেখেছে অলকা, মা কখনো একসাথে বসে খায়নি স্বামীসন্তানের সাথে তাদের  পেট ভরিয়েই যেন তার তৃপ্তিস্কুল ছুটির দিনে মা খেতে বসলে সামনে গিয়ে দাঁড়াত অলকা, দেখত  মায়ের জন্য মাছ তরকারি তেমন কিছু নেই মাছের যে টুকরোটি রয়েছে, খুব কাছে গিয়ে দেখলে তবেই তার অস্তিত্ব ঠাহর করা যায় অলকা কারণ জানতে চাইলে মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলতেন, ‘আমি ভাতটা একটু বেশি খাই, মাছসব্জি তেমন  দরকার পড়ে না অলকা শুভ্রর মধ্যে বয়সের পার্থক্য বছর দুয়ের হবেযখনকার কথা তখন দুজন মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রভালমন্দ বোঝার বয়স হয়েছে অলকা ভেবেছিল, তারা দুজন মিলে ব্যাপারটা জানাবে বাবাকে হোক ছোট্ট পরিবার, খাটুনিতো আছেই মা নিজের দিকে নজর না রাখলে শরীরটা  ভেঙ্গে পড়বে না! ছেলেমেয়েদের কিছু একটা বলে মা বুঝিয়ে দেবে, বাবার কথা তো আর অমান্য করতে পারবে না! আর বাবাকেও দুজন মিলে বললে গুরুত্ব না দিয়ে পারবেন না বলতে হবে, যা যা  রান্না হবে তা সমান ভাগ করে খেতে হবে হ্যাঁ, একটি ট্র্যাডিশন আছে বটে, স্বামীসন্তানকে খাইয়ে তবেই ঘরের গৃহিনী অন্ন গ্রহণ করবেন অলকা ভাবে, যে ট্র্যাডিশন ক্ষতিকর তা কেন চলতে থাকবে অনন্তকাল? অন্তত ছুটির দিনগুলোতে খাই না চারজন একসাথে বসে দাদাকে প্রস্তাবটা দিতেই সে বলে উঠেছিল, মা কি খেলো না খেলো তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই, অলকা যদি চায় বলুক না বাবাকে! হেঁসেলটা তো মায়ের, মা কাকে কতটুকু  খাওয়াবে, নিজে কি খাবে সেটা তো  মা বুঝবে, ওসব মেয়েলী ব্যাপারে সে নেই অলকা দেখেছে, ছোট থেকেই দাদা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত যত দিন গেছে ততই এই আত্মপ্রেম প্রবল হয়ে উঠেছে দাদার মধ্যে পড়াশুনো শেষ করে ভাল একটা চাকরীও জুটিয়ে নিয়েছে দাদা বৌদিকে দাদার পছন্দ হওয়ার একটিই কারণ, বৌদির বাবা পয়সাওয়ালা লোক, তা না হলে রূপেগুণে বৌদি এমন কিছুই নয় যে দাদার পাশে দাঁড়াতে পারে বৌদির অহংকারটাও সেই এ্কই কারণে কথায় কথায় সে দুই পরিবারের আর্থিক সামর্থ্যের তুলনা করে ভাবখানা এমন যেন  সে দয়া করেই বিয়ে করেছে দাদাকে দাদাও তেমন সে যেন জীবনের আকাঙ্ক্ষিত নারীটিকে খুঁজে পেয়েছে বৌদির মধ্যে বৌদি বুঝে গেছে অর্থের প্রতি দাদার দুর্বলতার কথা আর সে জন্যই দাদাকে মুঠোর মধ্যে ভরে নিতে একটি দিনের সময়ও ব্যয় করতে হয়নি তাকেবৌদির মন-জুগিয়ে-চলা দাদার মনে মায়ের জন্য কোন জায়গাই অবশিষ্ট ছিল না, তাই মৃত্যুর পর মায়ের জন্য এক ফোঁটা চোখের জলও খরচ করেনি দাদাট্রাক এলে মায়ের মৃতদেহ তাতে চড়িয়ে দেওয়া হলঅলকাকে বলা হল আশপাশ থেকে কিছু ফুল সংগ্রহ করে শবদেহের উপর ছড়িয়ে দিতেমৃত্যুর পর চরম অবহেলায় মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হলকোন প্রকারে মাতৃদায় নামক বিরক্তিকর বোঝাটি নামিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দাদা

আজ নিয়মভঙ্গের দিন কিন্তু দাদার তৎপরতার শেষ নেইনিমন্ত্রিতের মধ্যে শুভ্রর নিজ পরিবারের তেমন কেউ না থাকলেও সপরিবা্রে শ্যালক শ্যালিকাগণ উপস্থিত বৌদির নির্দেশে লিষ্ট বানানো  হয়েছে দাদা বাজার থেকে ফিরলে সব দেখার পর বৌদির মুখ তৃপ্তির আভায় ঝলমল করে  উঠলো বৌদি খুশী তো দাদাও খুশী

দাদা রান্নার লোককে সতর্ক করে দিল, রান্না যেন এক নম্বরের হয় এবং একটার মধ্যে তৈরী হয়ে যায় দাদার বড় ভায়রার আবার খাবার সময়ে নড়বর হলে হজমে বিঘ্ন ঘটে, তাই সময় বেঁধে দেওয়া হলও তাই একটার সময়েই বসে পড়লো সকলেপ্রায় পনের জনের সমাবেশঅলকার উপর ভার পড়ল পরিবেশনেরবাবা মা বেঁচে থাকতে যখন ঘটা করে লক্ষ্মী বা সরস্বতী পুজা হত তখন নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন, ভোগপ্রসাদ পরিবেশন সবই ছিল অলকার একার হাতে তখন তা ছিল আনন্দের আজ যে পরিবেশন করতে গিয়ে বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে! নাঃ! নিজেকে সামলে নিল অলকা পরিবেশনে ত্রুটি হলে, বিশেষ করে বৌদির বাপের বাড়ির কারো কাছ থেকে কোন অভিযোগ এলে আর রক্ষা নেই অলকার বৌদি, দাদা দুজনেই তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে প্রথম দিকের ভাজা, ডাল, তরকারির পর এল মাছের আইটেম প্রথমে সরষে দিয়ে ছোট মাছের গায়ে গায়ে ঝোল, তারপর কাতলা মাছের কালিয়া খাচ্ছে, খুব খাচ্ছে ওরা দাদা বৌদি দুজনই লেগে গেছে তদারকিতে দু পিস করে খাওয়ার পর দাদা বৌদির কি ঝুলোঝুলি আর এক পিস করে নেবার জন্য! বড় ভায়রা বাদে বাকী সকলে বলে উঠল, ‘উরে বাবা, আর নয়, মাছের পিসগুলো দেখেছেন, দু পিস মানেই চার পিস বড় ভায়রা বলল, আর একখানা ছাড় তো অলকা, কোলের দেখে দাদাবৌদি দুজনই ঝাঁপিয়ে পড়ল, ওই ওই পিসটা দে অলকা দাদার আবদার, ‘আপনাকে আর একটা পিস নিতেই হবে দাদা, এটা আমার রিকোয়েস্টখেতেই হবে? আচ্ছা দাও’! অলকা আর একটি পিস তুলে দিল তার পাতে খাওয়া শেষ এখন সকলে তৃপ্তির উদ্গার তুলছে সবার মুখে সে একই কথা হ্যাঁ, মাছ ছিল বটে শুভ্রশঙ্খের চোখমুখে পরমপ্রাপ্তির উত্তেজনা বড় ভায়রা তার রায়টি দিলেন এবার, ‘সত্যি শুভ্র তোমার দিল আছে বটে, তোমার এই নিয়মভঙ্গের কথা স্মৃতি হয়ে থাকবে ভাই অলকা দেখল, বিনয়ে ভেঙ্গে পড়ল দাদা, বলল, ‘মা, মায়ের ভাগ্যটা কি যে ভাল, তা নইলে আমার সাধ্য কি এমন মাছ জোগার করা’! বড় ভায়রার উক্তি, ‘তুমি আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখোনি, সকলেই খুব তৃপ্তি করে খেয়েছে, মাসীমা নিশ্চিত আশীর্বাদ করছেন তোমাকে স্বর্গ থেকে ধরো, তোমার মাতৃঋণ শোধ হয়ে গেল

পারল না, আর পারল না অলকা নিজেকে ধরে রাখতে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে সকলের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইল সকলের চোখে বিস্ময় শুনতে পেল, অলকার ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল সশব্দে

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন