কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


নীল পালক

 

মানস হেঁটে যাচ্ছে সোজা পিচ পথ ধরে।বৃষ্টি হচ্ছে টিপ টিপ করে চারিদিকে অন্ধকার, আর অন্ধকার ফুঁড়ে গাড়ির তীব্র আলোয় রাস্তার জমা জল থেকে ঠিকরে উঠছে হীরে। বাজার ছাড়িয়ে একে একে কমে আসে দোকান-পাট, একপাশে টিলার মতো উঁচু জংলা জমি তার ওপর দিয়ে সমস্ত নির্জন পটভূমি চিরে চলে যাচ্ছে কতদূর। মানস অবশ্য এসব কিছুই দেখছে না। তার মন ভারাক্রান্ত, দুশ্চিন্তায় মন কালো হয়ে আছে। কোনোদিকেই দেখছে না সে। দুটো টিউশন একসঙ্গে চলে গেছে তার। দুই ভাইবোন। খুড়তুতো জাঠতুতো। তারা এবার থেকে শহরের কোচিং সেন্টারে যাবে পড়তে। দুটো টিউশন পেতে অনেক দিন সময় লাগবে। দুটো টিউশন মানে অনেকটা টাকা তার কাছে। অঙ্কে এম.এস.সি করে এখান ওখান চাকরির চেষ্টা। দাদা বৌদি আলাদা, বাবা শয্যায়, মা বিরক্ত। নিম্নবিত্ত বাঙাল পরিবারের ছবিটা দেশ এখনও মৃণাল সেনের সিনেমা যেন।

একটুখানি হেঁটে এলেই সামনে ঝিল। সন্ধ্যাবেলা স্থির জলে আবছা গাছের ছায়া আর পথের আলো মুখ দেখে জলে। ছেলেটা আর মেয়েটা ওখান দিয়েই আসে যায়। দু একটা ছড়ানো ছিটানো দোকান পেরিরে সুড়িপথ উঠে গেছে প্ল্যাটফর্মে। স্টেশন শেষে নিয়ন আলোর পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ একটা দুটো, চায়ের দোকান। ছেলেটি আর মেয়েটি সব শেষে এসে চা খাবে। ছেলেটা চলে যাবার জন্য মন শক্ত করে। মেয়েটি আঙুলে জড়িয়ে নেয় ওর আঙুল। পাঞ্জাবীর কোণা চেপে ধরে থাকে। ট্রেন চলে গেলে শূন্য হয়ে যায় সব। মেয়েটি ফিরে আসে।

মানস এই পথেই যায়। একা। আজ বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে মাথা, সার্ট চোখ। পাশ থেকে একটা ফুলকাটা অটো তুলে নিলো ওকে।

প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন সে ওকে  নামিয়ে দিল নদীর পাড়ে। যখন চোখ মেলল মানস দেখলো ওকে ঘিরে আছে পরমাসুন্দরী অনেক মেয়ে। ওদের পিঠে প্রজাপতির মতো ডানা। আর ওদের হাতে কোনো চুড়ি নেই, গলা বা পায়ে নেই শেকল গয়না। মেয়েরা গান গাইতে গাইতে ওকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো তটভূমিতে। ও তাকিয়ে দেখলো সামনে অনন্ত সমুদ্র আর বালুরাশি। ও দাঁড়িয়ে আছে একটা দ্বীপে। অচেনা দ্বীপ।

-এই দ্বীপটা কোথায়? কোন দেশ?

মেয়েগুলো সমস্বরে বলে উঠল, এই দ্বীপ আমাদের। আমরাই শাসন করি এই দ্বীপ। এই দ্বীপের নাম নেই। আমাদেরও নাম নেই।

-তবে তোমাদের চিনব কী করে?

-যার যা প্রিয় তাকে সেই নামে ডেকো।

এসব বলতে বলতে মানস সমুদ্রের সামনে এসে দেখল আকাশে রামধনু থেকে ঝরে পড়ছে গান। আসলে গানটা কোথায় বাজছে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করল নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। মাথার ভেতর একটা ঘাস ফড়িং উড়ছে। একটি মেয়ে যার একঢাল কালো চুল উড়ছে হাওয়ায় নরম নীল ঝালর দেওয়া স্কার্ট আর হলদে পাতা বুকে আটকে দুলে দুলে নাচছে। এলোকেশী তার হাত ধরে ইশারা করল নাচতে।

মানস কখনো নাচেনি। মেয়েটি বলে -

-আমার সঙ্গে পা মেলালেই নাচ। নাচলে মন ভালো হয়, শরীরের রক্ত তাজা হয়।

মানস দেখল সে সত্যি সত্যি নাচছে। দুলে দুলে  ঘুরে ঘুরে নাচছে। যত নাচছে ততই হালকা হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। মেয়েগুলো হেসে লুটিয়ে পড়ছে এর ওর গায়ে।

হঠাৎ টের পেলো ওর মনটা ফুরফুরে, আর কোনো দুঃখ নেই। মানস হাসছে।

এলোকেশী ওর কাছে সরে এসে বলল, এই দ্বীপে দুঃখ নিষেধ, শুধু আনন্দ।

চারদিকে গাছপালা। পাতাগুলো নীল লাল ম্যাজেন্টা রং। ফুলগুলো ইস্কুলের ঘন্টার মতো দুলছে ডাল থেকে। একটা চাতাল মতো জায়গায় অনেক ফল আর নানা খাবার সাজানো। একটা বুড়ি মাথায়  সবুজ পালক গোঁজা লাল রঙের  ফ্রিল দেওয়া ঘাঘড়া পড়া হাতে আর গলায় বকফুলের মালা পরে হেসে বলল,

-এসো খাও।

ওরা সবাই খাচ্ছে। ওদের সঙ্গে কিছু খরগোশ আর শঙ্খচিল এসে মুখে নিয়ে যাচ্ছে খাবার। কেউ ভয় পাচ্ছে না। অরণ্যনিভা নামের মেয়েটি যার নগ্ন শরীরে কেবল পাতার আবরণ তার গাল বেয়ে নামছে কাঁচপোকা,  আর মাথায় অনেক হলুদ প্রজাপতি জটলা করছে। সে মানসের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে যেখানে আগুনে ঝলসে নিচ্ছে মেয়েরা হরিণের মাংস। ইন্টারনেট ছাড়াই সারা দ্বীপে খবর যাতায়াত করছে গাছের এই ডাল থেকে ওই ডাল।

অরণ্যনিভার স্তন দুটো থেকে আলো, নিটোল কালো বৃন্ত থেকে এক্ষুনি যেন উপচে পড়বে দুধ।

মানসের ইচ্ছে করছে ওকে আদর করতে।

-চলো রানিদের কাছে যাই, ওখানে অনেক আদর।

-তোমাদের রাজা নেই?

বিধুমুখীর পানপানা যার মুখ আর মাথায় ভর্তি জ্যোৎস্না। ও বলল,

-আমাদের কোনো রাজার প্রয়োজন নেই। আমাদের সবার কাজ সবাই করি আনন্দে। আমরা সবাই এক, কোনো ভেদ বিভেদ নেই তোমাদের মতো। একেক দিন একেক জন রাজা সাজা হয়, চলো আজ তুমি রাজা হবে। বলে বিদ্যৎপ্রভা।

টানা টানা চোখ, খাড়া নাক আর গভীর একটা নাভি।

ওরা দল বেঁধে চলে ফুল ঝরা জঙ্গলের পথে।

একটা টিলার ওপর ফুলের সাজে বসে আছে পান্তাবুড়ি আর বড়াই বুড়ি। দ্বীপের রানি ওরা।

রানী বলতেই তার মনে হলো খয়রাতি, মনে হলো চেরা কন্ঠের আর্তস্বর আর বঞ্চনার কথা। কিন্তু পান্তাবুড়ি ভারি নরম। সে কাউকে বকছে না। সকলে নিজে থেকেই কত কাজ করবে দেখাতে ব্যস্ত। পান্তা বুড়ি লাঠি হাতে হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গুনগুন গাইছে। কোথাও নিজেই বসে পড়ে মাটি খুঁড়ছে, কাউকে বিশ্রাম করতে বলে নিজেই নিকিয়ে দিচ্ছে মাটির ঘর। পান্তাবুড়ির কোলে পিঠে খানকয়েক  শিশু। মানসের খুব ভালো লাগছে। সে বলে,

-হ্যঁগো তোমাদের আজকের রাজা কৈ? বড়াই বুড়ি হেসে জিজ্ঞেস করল।

-রাজা কৈ রাজা কৈ?

সবাই মিলে সমস্বরে বলে ওঠে।

-রাজা ঐ, ওই যে রাজা!  

মানস কিছু বোঝার আগেই তাকে পরিয়ে দেওয়া হলো পাখির পালকের মুকুট। একটা টিলার ওপর বসতেই শুরু হলো অনুষ্ঠান। কেউ বলছে কবিতা, কেউ গান গাইছে। কাঠের ট্রেতে করে আসছে শুশুকের তরকারি। কী সুস্বাদু খেতে।

পাথরের গেলাসে গেলাসে এলো পানীয়। সুগন্ধি মিষ্টি জল। একটি মেয়ে তাকে আদর করছে, চারিদিকে রঙিন জ্যোৎস্না।

মানসের ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।

সভা চলছে তখনও।

আবছা দেখতে পেলো, মেয়েরা তাকে শুইয়ে দিচ্ছে ভেলায়।

-আবার এসো গো রাজা!

কে যেন মিহি স্বরে বলছে, কোনো রাজা নেই কোনো প্রজা নেই, এসো গান হোক এসো নাচ হোক। মানস মুঠো খুলে দেখল একটা লম্বা নীলচে পালক। ঝিলের পাড়ে মাঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করল মানস, আমি রাজা!

হাওয়া দিতেই মুঠো থেকে নীল পালকটা উড়ে গেলো আকাশে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন