সমকালীন ছোটগল্প |
ভগবানের আধার বিড়ম্বনা
প্রতিমাসের এক কিম্বা দুই তারিখে
আমাদের বাড়িতে ভগবান আবির্ভুত হন। একদম সকালে সকালে। আমরা আগে থেকেই আড়াইশো টাকা
নিয়ে রেডি থাকি। ভগবান তার নীল রং-এর মোটা রেজিস্টারে আমাদের বাড়ির নাম্বার লেখা পাতাটা খুঁজে বের করেন।
সেখানে আগে থেকেই মাসের নাম লেখা খোপ কাটা আছে। তিনি আমাদের প্রণামির আড়াইশো টাকা
গ্রহন করে মাস মিলিয়ে নির্দিষ্ট খোপে টিক চিন্হ লাগিয়ে দেন। এই টাকাটা মান্থলি চার্জ।
আমাদের ঘরের রোজের ময়লা নিয়ে যাওয়ার কাজটা করে ভগবানের লোকজনেরা। সে কাজে আমাদের
বাড়িতে তাদের রোজ রোজ আসার কথা। কিন্তু আসে না। অনেকদিনই তারা অনুপস্থিত থাকে। আমরা
টাকাটা দেওয়ার সময় প্রতিমাসে সেই অনুপস্থিতির প্রসঙ্গটা তুলি। অনুপস্থিতির দিনের
সংখ্যা জানিয়ে ভগবানের কাছে অভিযোগ জানাই। ভগবান পরিস্কার ইংরেজিতে অত্যন্ত বিনয়ের
সঙ্গে প্রতিবারই বলেন - সরি। ভেরি সরি। এক্সট্রিমলি সরি। ইত্যাদি ইত্যাদি। রাগ দেখিয়ে
তার এই সাফাই কর্মীর দল যে হারামি, নেশাখোর এবং ফাঁকিবাজ সেটাও বলেন। তারপর প্রতিবারই
বেশ জোর দিয়ে বলেন আগে সে বিলকুল নেহি হোগা। মেরা গ্যারান্টি। পাক্কা গ্যারান্টি।
কিন্তু ভগবানের সে গ্যারান্টি যুক্ত প্রতিশ্রুতি কখনো পালিত হয় না। আমরাও জেনে গেছি
সেটা। তবু আমাদের অভিযোগ করা আর ভগবানের গ্যারান্টি যুক্ত প্রতিশ্রুতি দেওয়া একই রকম
ভাবে চলতেই থাকে।
নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছেন
আমাদের এই কলোনির সাফ সাফাই করার ঠিকাদার হচ্ছেন এই ভগবান। তিনি তার সাফাই কর্মীদের দিয়ে কাজটা করান।
এবং মাসে মাসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার বাবদে প্রদেয় টাকাটা সংগ্রহ করেন। কাজের ক্ষেত্রে
তার দলবলের আবির্ভাব প্রায়ই বাদ গেলেও, ভগবানের এই মাসিক আবির্ভাব কখনো বাদ যায় না।
নেভার। তবে ঐ মাসে একবারই। অন্যদিন তার টিকির দেখা পাওয়া যায় না।
এবার হঠাৎ নিয়ম ভেঙ্গে মাসের মাঝখানে আমাদের বাড়িতে ভগবানের আবির্ভাব হোলো। দরজা খুলে দেখি তার পাশে এক মহিলা। ভগবান পরিচয় করে দিলেন - মেরি বিবি। অর্থাৎ ভগবানের সাথে সাথে ভগবানের বিবিরও দর্শন হয়ে গেলো আমার।
আমাকে ভয়ানক বিব্রত করে ভগবান
এবং ভগবানের বিবি এক যোগে আমাকে নমস্তে জানালেন। তারপর ভগবান আমাকে তাঁর আর তাঁর বিবির
আধার কার্ড দুটি দিলেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভগবানের আধার কার্ড নিয়ে আমি কি করবো?
ভগবান বিনীত ভাবে জানালেন
- ইস মে সুধার চাহিয়ে।
আমি ওনাদের দুজনকে ঘরের ভেতরে আহ্বান করে নিয়ে এলাম। বসতে বললাম। আধারকার্ডে ভুল কোনো নুতন কথা নয়। কার্ড দুটো হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কিস চিজ কা সুধার?
ভগবান বললেন মেরা জনম তিথিমে গড়বড়।
দেখলাম আধার কার্ডে ভগবানের ডেট
অফ বার্থ দেওয়া আছে ১২.১০.২০৭৮. আর্থাৎ সেটা মানলে ভগবানের এখনো জন্মই হয়নি। ভগবান
প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। তিনি তার ভোটার আইডি কার্ডটি আমায় দিলেন। সেখানে ডেট অফ
বার্থ মেনশন আছে ১২.১০.৭৮. বোঝা গেলো এই ৭৮ টাই ভুল করে ১৯৭৮ এর বদলে ২০৭৮ হয়ে গেছে।
বোললাম ভগবানজী ইসকা তো সুধার হো জায়গা।
এবার ঘোমটা সরিয়ে ভগবানের বিবি
মুখ খুললেন। দেখিয়ে না মেরি কার্ডমে হারামি লোগ মেরা পিতা কে নাম কে জগহমে উনকা নাম
লিখ দিয়া।
কার্ডটা হাতে নিয়ে আমি দেখলাম
ভগবানের বিবির আধার কার্ডে তার নিজের নাম লেখা আছে উর্বশী। আর পিতাকা নাম এর জায়গায়
জ্বলজ্বল করছে পরিষ্কার অক্ষরে : ভগবান।
- ম্যায় ক্যা উনকা বেটি হু?
আপনা বেটি সে শাদী কিয়া হ্যায়
বো?
তারপর রাগে উত্তেজনায় যে গালাগালগুলো
তার মুখ থেকে বের হয়ে এলো। তা ছাপার অযোগ্য। আমিও মনে মনে এরকম একটা জটিল পরিস্থিতি
সৃষ্টি করার জন্য আধার কতৃপক্ষের মুন্ডপাত করে, কথা দিলাম ইসকা ভি সুধার হো জায়গা।
কার্ড দুটো রেখে যেতে বোললাম। আজকাল অনলাইনে আধারের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করানো যায়
সেটাই চেষ্টা কোরবো কথা দিলাম। কয়েকটা ডকুমেন্ট লাগবে। স্কান করে তাদের কপি এ্যাটাচ
করে দিতে হবে। সেগুলো নিয়ে আসতে বললাম। সেসব ভগবান খানিক পরেই নিয়ে এলেন। আমি গুছিয়ে
আমার ল্যাপটপ থেকে আধার সংশোধনের আবেদনটা আপলোড করে দিলাম।
দিন পনেরো পরে আবার বেজে উঠলো আমার ঘরের ডোরবেল। আবার সস্ত্রীক ভগবানের আবির্ভাব। দুজনেই এদিন খুব সেজেগুজে এসেছেন। ভগবানের বিবির তো রীতিমতো বিয়ের কনের মতো সাজ। আমার চোখে প্রশ্ন দেখে ভগবানের বিবি লাজুক হেসে জানালেন। হাম লোগ মন্দির হোকে আ রহা হুঁ।
দেখতে পেলাম একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে
ফুলের মালা, আর একটাতে প্রসাদের প্যাকেট। একটা প্রসাদের প্যাকেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে
উনি জানালেন।
হম লোগ কা সংশোধিত আধারকার্ড আ
গয়া। উনকা উম্র বড় গয়া ঔর মৈ উনকা বিবি হো গই।
বিড়ম্বনা মুক্ত ভগবানও হাসছিলেন পাশে দাঁড়িয়ে। ভগবান ও ভগবানের স্ত্রীর এই উপকারটি করতে পেরে যার পর নাই প্রসন্ন হোয়েছিলাম আমিও। খালি একটা খটকা মনের মধ্যে খচখচ করছিলো। ভগবানের বউ হিসেবে উর্বশী কি শাস্ত্রসম্মত?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন