কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(১০)

ছোটো কঞ্চির গেট ঠেলে ঢুকলে ইঁটপাতা সরু রাস্তার দুপাশে রজনীগন্ধা গাছ ও বেঁটে ঝাউ গাছের সারি শেষে একটি লম্বা করবীগাছ। বাগানের ধার বরাবর কলাগাছ, টগরগাছ পাতাবাহারি নানা ধরনের গাছগাছালি। একদিকে একটা অন্তর একটা নারকোল আর ডাব গাছ। মাঝের চৌকো জমিতে স্কুলের আলাদা শ্রেণীর সারির মতো পৃথক লাইনে চাষ করা হয়েছে টমেটো, কপি, মুলো, কাঁচালঙ্কা প্রভৃতি।

একতলা ছোট্ট বাড়িটির ছাদে লাউকুমড়োর লতা জাল বিছিয়েছে। বাগানেও ছোটো একটি মাচায় সিম, বেগুন।

পৌষ ফাল্গুন চলে যেত। কালো মেঘ আর শরৎ আসতো। পিঠে কুঁজ তাপি দাদা বাগানে কাজ করত সারাদিন খুটুর খুটুর করে। দুপুরে বড়ো কাঁসিতে ভাত ঢেলে দিতেন। ডাল একটুকরো মাছ। গোগ্রাসে খেত তাপিদাদা। আমি অবাক হতাম। আমার শৈশবে খিদে কাকে বলে তা জানতে হয়নি। খিদে পাওয়ার আগেই দুধটা, মাছটা, মাংসটা এসে যেত। খেতে ইচ্ছে করত না। বরং ভর দুপুরে কাঁচা তেঁতুল, গাছে বসে কষটে পেয়ারা বেশি ভালো লাগত। মা অবশ্য বলতেন পৃথিবীর খরা আর বন্যার কথা। কত মানুষ না খেয়ে থাকেন সেই কথা।

তাপিদাদা মরে গেল একবার।

আমি কিশোরী যখন তাপির বউ ফলিডল খেলো।

এসবে আমার তেমন কৌতূহল ছিলো না। আমি একটা স্বপ্নের জগত রচনা করে আপন মনে তার মধ্যেই ব্যস্ত থাকতাম। ওই ঝাউগাছগুলো হয়ে যেত মানুষের মতো। কী বলতাম তা মনে নেই তবে অনেক কথা বলতাম তাদের সঙ্গে। এমনকি কাঠবিড়ালও ভয় পেত না আমাকে। সাপ আমার খুব পছন্দের প্রাণী তখন থেকেই।

মোটা সোটা দাঁড়াশ সাপটা বাগানে ঘাসে এঁকে বেঁকে ঘুরে বেড়াতো। একটি চন্দ্রবোরা ও গোখরো ছিলো। গাছ বেয়ে উঠত।কখনো বাগানের শেষ প্রান্তে ওদের দেখতাম। মা কে বলিনি। সেটাই বোধহয় বড় হবার প্রথম পর্যায় সব কথা আর মাকে বলতাম না। মনে হতো বললে যদি তাড়িয়ে দেয় ওদের। বাবার ফিরতে রাত হতো। আমার এক সম্পর্কিত মামা আসতেন কখনো সখনো। মায়ের সমবয়সী। সেদিন এসেছিলেন। আমি বারান্দায় বসে খেলছিলাম। গ্রিলের ওপারে বড় গন্ধরাজ গাছটা অন্ধকার সন্ধ্যায় সাদা ফুলে ঢাকা। চারিদিকে সুগন্ধ। বারান্দায় আলো ছিলো না।  শোবার ঘরের আলোর ক্ষীণ আভায় বসে দেখলাম লোহার গ্রিল টপকে নিঃশব্দে কুচকুচে কালো বেশ সরু লম্বা একটি সাপ ঢুকে গেল শোবার ঘরে একদম আমার কোল ঘেঁষে। ওটা কেউটে ছিল। তবু মা কে বলিনি। আমাদের ঘরে এসেছে এটাই ভালো লেগেছিল। সেদিন খুব দুঃখ হয়েছিল। সেই মামা নিরাপত্তার জন্য সাপটি মেরে বাগানে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। মা খুব ভয় পাচ্ছিলেন। শুনেছিলাম পুকুরে ফেলে দিলে ওরা পুনর্জীবিত হয়ে ওঠে তাই দাহ। সেই রাতে কেঁদেছিলাম।

চন্দ্রবোরা ও গোখরো, কৃষ্ণ রাধিকা। দুজনেই ভীষণ সুন্দর দেখতে। কিন্তু  সে সুখ সইলো না। একদিন ওরকম একা বাগানে আমি। দুটি লোক এলো। বলল, "খুকি খবর আছে এখানে গোখরো আছে।"

আমি ঘাড় কাত করি। একজন বেড়ার গেট ঠেলে ঢুকে মাটিতে বসে আরেকজন চলে গেল বাড়ির পেছনে আগাছার বিস্তীর্ণ জঙ্গলে।

ছোট্টভাই আর ঘরের কাজে মা সেসময় ব্যস্ত।

লোকটি তার ঝোলা থেকে একটি একটি করে বিভিন্ন জিনিস বার করতে লাগল। ইতিপূর্বে শুনেছিলাম এই জগত ছেলেধরায় পরিপূর্ণ। আমাদের মতো পথে ঘাটে খেলে বেড়ানো বাচ্চাদের টপাস করে ঝোলায় পুরে নিয়ে যায় তারপর হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নুলো করে পথে বসিয়ে ভিক্ষা করায়। এখন ঝোলার অন্য কার্যকারিতা দেখলাম। একটি ছোটো আয়নায় সিঁদুর মাখিয়ে কী সব বিড় বিড় করতে লাগল একটু পরে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে অব্যর্থভাবে দিক নির্দেশ করতে লাগল আর ম্যাজিকের মতো দ্বিতীয় লোকটি ঝোপ থেকে প্রায় মাথা এক এক করে গোখরো, দাঁরাশ, চন্দ্রবোরা তুলে ফেলতে লাগল।

প্রথমজন স্থির তাকিয়ে আয়নায়,মন্ত্র পড়ছে। তার মধ্যেই আমি শিখে নিচ্ছিলাম সাপ ধরার টেকনিকটা। পরে আমার এক গ্রামতুতো বন্ধু শিখিয়ে দিয়েছিল হাতে কলমে। মা জানেন না। এমন অনেক কথাই মা জানেন না।

ততক্ষণে মাঠের ওপারে কামারপাড়া থেকে ছেলেদের দল হুলুস্থুল শুরু করে দিয়েছে। মা এসে একঝটকায় আমাকে টেনে ঘরের মধ্যে। আমার ভয়ডর চিরকালই কম। কিন্তু আমার মা ও ওই কাবুলিওয়ালার মিনুর মায়মায়েরই মনে করতেন বোধহয় পৃথিবীটা ছেলেধরায় ভর্তি।

একবার পাশের বাড়ির তিনতলায় মাধবীলতা বেয়ে একটি লাউডগা সাপ আলোর বাল্বে জড়িয়ে ছিলো সারারাত। পরদিন সকালে গ্রামের ছেলেরা এসে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ওনারা ওদের অপাঙ্ক্তেয় মনে করতেন। নীচু জাত বলতেন। তবে বিপদে পড়লে আপনি বাঁচলে...ইত্যাদি। গ্রামের ছেলেরা বাদুরের মাংস খেতো। আমাদের বাগান থেকেও ধরে নিয়ে যেতো।

সাপ মারতে নেই। গ্রামের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে যেত শহুরে বাবুরা সাপ মারলে। পাশের টিনের চালের বাড়ির বাঁশের ফাঁক দিয়ে সাপের অবারিত যাতায়াত ছিল এবং আমারও। হয়ত সাপ দেখে কখনো ভয় পাইনি ভালোবেসেছি ওই ওদের সঙ্গেই ছোটো থেকে মিশে।

হাঁসের বাচ্চারা তুলোর বলের মতো কত সময় বাবার বা আমার হাতে খবরের কাগজে লাফিয়ে চলে আসতো। বেলা হলে বলের মতো ওদের ধরে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলত গান্ধারী মাসি।

ওরা ঠিক সাঁতরে চলে আসতো।

হাঁস-মুরগি পরে আর ছিলো না। ভাম আর গন্ধগোকুলের উৎপাতে।

অঝোর বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে বাটি ভর্তি করে শিল কুড়োনোর মজা হারিয়ে গেল একদিন। মা কখনও বারণ করেননি। গান্ধারী মাসি কাজ করতো সে বকাঝকা করত।

এই সময় একদিন এক সম্পূর্ণ অনাত্মীয় মানুষ মারা গেলেন। সারা পাড়ার মা কাকিমা, আমার মাসি, জেঠিমা সকলেই কাঁদতে লাগলেন। তাঁরা সে বেলা উপোস করে রইলেন।

শুনলাম যিনি সকলের বুক খালি করে শোকে ভাসিয়ে চলে গেলেন তাঁর নাম উত্তমকুমার।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন