কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

অচিন্ত্য দাস

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২২


পলাশের দিন

সে আজ অনেকদিনের কথা। এক ছিল তালগাছ। ভাদ্র মাস। তাল পেকেছে। একটা কাক বসেছিল পাকা তালের ওপর। কী জানি কেন উড়ে গেল কাকটা। আর ঠিক তখনই বোঁটা থেকে খসে পাকা তাল মাটিতে পড়ল। দুজন লোক কাছেই ছিল। তারা মূর্খ না পণ্ডিত তা জানা নেই, দুইই হতে পারে। একজন বলল, “উড়ে যাবার সময় কাকের পায়ের ধাক্কায় তালটা পড়ল”, অন্যজন বলল, “না, তালটা পড়ছে বুঝেই কাকটা উড়ে গেল।”

সে তালগাছ আজ আর নেই, কাকও নেই। লোকদুটোও আর নেই। প্রশ্নটা কিন্তু রয়ে গেছে।

যোগসাজশ বলে সত্যি কি কিছু হয়? না সবটাই মনের ভুল! নাকি মাঝেসাঝে অবাক কাণ্ড সত্যিসত্যিই ঘটে যায়? চারিদিকে বিজ্ঞান-টিজ্ঞানের দাপট যতই বাড়ুক, মানুষের মনের এই দ্বিধাটুকু তাতে তেমন নাড়া খায়নি।

পূরণ মাহাতো ভ্যান-গাড়ি নিয়ে হাইওয়ে ধরে পুরুলিয়ার দিকে যাচ্ছিল। প্রায়ই যায় মানে যেতে হয়। গাড়ি ভর্তি গেঞ্জি মোজা এইসব হোশিয়ারি মাল। সে ড্রাইভার। রাঁচির কারখানা থেকে নানা জায়গায় পৌঁছোবার কাজ করে। কদিন খুব শীত পড়েছিল, এখন কমের দিকে। দুপুর বেলায় গরম হাওয়া। ন্যাড়া মাঠঘাট ধূধূ করছে। একটানা চালিয়ে হাতেপায়ে খিল ধরেছে, একটু ছাড়িয়ে না নিলেই নয়।    রাস্তার পাশে চায়ের ঠেকের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো পূরণ। নেমে আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, “ইস্পেশাল চা আর মুড়ি-বাদাম। তাড়াতাড়ি দিবি।”

চেয়ারে বসে সামনের খাটিয়াতে পা তুলে দিল। আর ঠিক তখনই শব্দটা কানে এলো পূরণের।

ঢোল বাজছে। একটু দূরে মাঠের মধ্যে গাছতলায় একটা পাথরের বেদী। কোন মন্ত্রী কবে ‘ভিত্তি-প্রস্তর’ স্থাপন করে গিয়েছিল। কিছুই হয়নি অবশ্য। বছর ষোল-সতেরোর ছেলেটা ওটায় বসে ঢোল বাজাচ্ছে। তালের ঝোঁকে মাথা নড়ছে – যেন ঘোর লেগেছে। বাজাচ্ছে খারাপ না, তবে মাঝেমাঝে বেশি কায়দা করতে গিয়ে তালছুট হয়ে যাচ্ছে। পাশে একটা পলাশ গাছ। এতদূর রাস্তা পেরিয়ে এলো পূরণ, এখনো কোন পলাশ গাছে ফুল আসেনি। কিন্তু অবাক কাণ্ড, এই গাছটায় এক-আধটু ফুল ধরেছে। ফুলগুলো নড়ছে – তা কি ঢোলের তালেতালে, না দুপুরের বাতাসে?

ছেলেটা চা, মুড়ি দিতে এলে পূরণ জিগেস করল, “ঢোল বাজায় কে রে?”

“এখানেই কাজ করে, দুটার থিকে উহার ডিউটি।”

সে তালগাছ নেই, কাক নেই, তর্ক করতে থাকা সে লোকদুটোও কবে মরে গেছে। তবু তাদের ভূতই যেন ‘ঠিক দুক্কুর বেলা’ পূরণের মাথায় এসে ভর করল। চা-এ চুমুক দিয়ে পূরণের মনে হলো – ঢোলের দিড়িম দিড়িম শব্দে কি সময়ের আগেই খুশিতে ফুল ফুটল? নাকি ফুল ফুটেছে বলে ছেলেটা দুপুর রোদ্দুরে ঢোল বাজাচ্ছে!

মুড়িটা বেশ মেখেছে। কাঁচা লঙ্কার ডগাটা দাঁতে কেটে পূরণের মনে হলো – কোনটার জন্য কী হয় তা সে জানে না। তবে কোথাও কিছু একটা ব্যাপার তো আছেই আছে। তা না হলে মাল-ডেলিভারির কাজফাজ ফেলে ঢোলে দুখান বোল তুলে পলাশতলায় নাচতে তার নিজের হাত-পা নিসপিস করবে কেন!

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন