কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


অসম্ভব স্বপ্ন সম্ভব

বিখ্যাত সায়কিয়াট্রিস্ট শর্মিষ্ঠা সান্যাল তার এই নতুন পেসেন্টের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। মধ্য চল্লিশের ভদ্রলোকের চেহারা চমৎকার, শরীর স্বাস্থ্য ও ভালো। কেবল তার চোখদুটো বিভ্রান্ত। অদ্ভুত এক দিশেহারা দৃষ্টি তাতে। তবে সেটা নতুন কিছু নয়। সাধারণত তার কাছে এরকম দৃষ্টি নিয়েই মনোরোগীরা হাজির হয়।

তার চিকিৎসার পর সেই দৃষ্টি সংশোধিত হয়। রোগীর ভালো হয়ে ওঠার লক্ষণ সেটা।

তিনি ভালোভাবে এই পেসেন্টকে জরিপ করে নিয়ে বল্লেন-

- বলুন আপনার কি সমস্যা?

- আমি খুব স্বপ্ন দেখি।

- দ্যাটস নট এনি সমস্যা। ওহো! আপনি বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখেন? ভয়ের কিম্বা কষ্টের?

- না না। সেরকম স্বপ্ন না। আমি মোটের উপর ভালো ভালো স্বপ্নই দেখি।

- তবে? ভালো স্বপ্ন তো যতো খুশি দেখা যায়। সেটা কেন সমস্যা হবে?

- কারণ আমি কখনোই গোটা স্বপ্ন দেখি না‌। সব সময় টুকরো টুকরো ভাঙ্গা স্বপ্ন দেখি। আর একটা নয় একসাথে বেশকটা স্বপ্ন দেখি আমি। কিন্তু একটার সঙ্গে একটার কোনো যোগাযোগ বা কন্টিনিউটি নেই।

- স্ট্রেন্জ। ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন?

- এই যেমন গত রাতেই পরপর তিনটে স্বপ্ন দেখেছি আমি।

- কেমন স্বপ্ন? বলুন শুনি।

মনোবিদদের প্রথম কাজ মন দিয়ে শোনা। রোগীর কথা শুনে তার বিশ্লেষণ করা। বিকলনের উৎস খুঁজে বের করা।

ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন-

- তিনটে স্বপ্ন পরপর দেখেছি। একটাতে আমি গঙ্গায় নৌকো বাইছি। গলুয়ের মধ্যে বসে আছে কপিলা।

এই কপিলাকে নিশ্চয় আপনি চেনেন। পদ্মানদীর মাঝির কপিলা। সে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে। নদীর জল বইছে ধীর গতিতে। মাথার উপর মেঘহীন নীল আকাশ। তার মাঝখানে ঝকঝকে সূর্যটা হাসছে। কিন্তু সূর্যের হাসি কখনো শীতল হয় না। দারুন উষ্ণ হয়। সেই উষ্ণতায় আমি পুড়ে যাচ্ছি। আমার সারা গা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। কপালের ঘাম ভুরু টপকে নেমে আসছে আমার চোখে।

সেই ঘামের নোনা জলের উপস্থিতিতে আমার দৃষ্টি বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাকে দুই হাতে দুটো দাঁড় বাইতে হচ্ছে। তাই দাঁড় ছেড়ে হাত তুলতে পারছি না। চোখের উপর বেয়ে নামা ঘামও মুছতে পারছি না। কপিলা বসে বসে দেখছিলো সবই। তবে আমার সমস্যাটা বুঝতে তার খানিকটা দেরী হলো। যখন বুঝলো তখন ও উঠে দাঁড়ালো। সাবধানে পা ফেলে ফেলে চলে এলো একদম আমার সামনে। তারপর বুকের আঁচলটা সরিয়ে নিজের হাতে জড়িয়ে নিলো। তারপর সেই হাতে জড়ানো আঁচল দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দেওয়ার জন্য হাতটা তুললো। দেখলাম তার দুটো নিটোল বুক ঘামে ভেজা ব্লাউজের মধ্য থেকে  ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সেই তাকানোতে মাঝ আকাশের সূর্যের চেয়েও অধিক উষ্ণতা। আমি আর দাঁড় মুঠোয় রাখতে পারলাম না। দুটো দাঁড়ই হাত থেকে খসে জলে পড়ে গেলো। আমি টলমল নৌকার মধ্যেই উঠে দাঁড়ালাম। দুই হাতে কপিলাকে জড়িয়ে ধরে ভাসমান নৌকার মধ্যে দাঁড়িয়ে সবাই টলমল করতে লাগলাম। মাঝ দরিয়ায় এক জোড়া নারী পুরুষ আর একটা ভাসমান দাঁড়হীন নৌকো। সবাই ভারসাম্যহীন। অদ্ভুত অবস্থা। তখনই হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। টের পেলাম আমি আমার ঘরে বিছানায় শুয়ে আছি। মাথার উপর পাখা ঘুরছে বন বন করে। তবু এখানেও নৌকোয় যেমন ছিলাম আমার অবস্থা সেরকম। আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবে। নৌকো নেই কপিলাও নেই। ঘর অন্ধকার।

- বাহ্। খুব ইন্টেরেস্টিং তো আপনার স্বপ্ন। তো এতে সমস্যাটা কোথায়? পদ্মানদীর মাঝি নিশ্চয় আপনার প্রিয় উপন্যাস। তার কাহিনী আর চরিত্র আপনাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। ছাপ ফেলেছে আপনার অবচেতন মনে। তাই এমন স্বপ্ন দেখেছেন। এ তো স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছু নয়।

- কিন্তু স্বপ্নটা তো ইনকমপ্লিট। মাঝ দরিয়ায় দাঁড়হীন নৌকোটা তারপর আমাদের নিয়ে কোথায় গেলো? ভেসে ভেসে নতুন দ্বীপ পৌঁছে গেলো? না ডুবে তলিয়ে গেলো গাঙ্গের গভীর জলে? সেটা তো জানা গেলো না।

- সেটাও তো তেমন কোনো সমস্যা নয়। আর সব স্বপ্ন তো গল্পের মতো যথাযথ পরিসমাপ্তি নিয়ে শেষ হয় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রলোক বললেন।

- তাহলে এবার আমার পরবর্তী স্বপ্নটার কথা বলি।

তার পরের স্বপ্নটাতে তো গাং, নৌকো, কপিলা কোনো কিছুই নেই।

- আচ্ছা। সেটা তবে কি?

- সেটা একটা পুরনো ব্রিটিশ আমলের বিলিতি গাড়ি। সেই গাড়িতে চেপে আমরা চলেছি শিলংএর পাহাড়ি পথে। স্টিয়ারিং এ বসে লাবণ্য। পেছনের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে শোভনলাল। আছে তবে প্রথম দেখায় অমিত রে’কে দেখা যাচ্ছে না। পথের পাশে রডোড্রেনডন গাছগুলো ফুল বোঝাই। বেশ কিছু ফুল ঝড়ে পড়ে  আছে পথের উপর আর বেশ কিছু পথের আশেপাশে। পথের একপাশে একটানা গভীর খাদ। অন্যপাশে খাড়া পাহাড়। পাইন আর ঝাউ গাছে ঢাকা সবুজ পাহাড়। তবে আগাগোড়া সবুজ নয়। মাঝেমধ্যে মাথা উঁচিয়ে আছে ন্যাড়া পাথরের চট্টান। তারা যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে। এতো এতো সব সবুজের কোমোলতা এসব মোটেই এবসিউল্যুট নয়। সে সব পাহাড়ের পাথুরে শরীরের বাহ্যিক পোশাক মাত্র। পাহাড়ের অভ্যন্তর আসলে কঠিন কঠোর পাথর। আঁকাবাঁকা পথের মাথায় চোখ তুলে চেয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে যে আকাশের ফালিটা, সেটাও দিগন্ত বিস্তৃত নয় খন্ডিত ও আঁকাবাঁকা। সেই আকাশটা কখনো নীল। কখনো তার নীল গায়ে তুলোর মতো সাদা সাদা ছেঁড়া মেঘ মাখানো। পাহাড়ের বুক পাথরের হলেও হঠাৎ হঠাৎ সেই পাথর শরীর চিরে রোগা রোগা ঝোরা গড়িয়ে নামছে। নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে পথটাকে। সেই ভেজা পথে আছাড় খেয়ে পড়তেই, অমিত রে অর্থাৎ আমাকে দেখতে পেলাম আমি। আমি পেছন থেকে ঐ নীল লম্বা বিলিতি গাড়িটাকে ঠেলছিলাম। গাড়িটা বিকল হয়েছে। আচমকাই স্টার্ট বন্ধ হয়ে থেমে গেছে সেটা। তাই তাকে ঠেলতে হচ্ছে । গাড়িটার পেছনে আমার অস্তিত্ব ঢাকা পড়ে ছিলো। এবার প্রকাশ্যে এলো। গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম। টলমল করে পা ফেলছিলাম। তাই হঠাৎ ভেজা রাস্তায় পা পিছলে আছাড় খেলাম। সেই মুহূর্তেই গাড়িটার ইন্জিনও আচমকা ঘড় ঘড় শব্দ করে জেগে উঠলো। খুশিতে চরাচরের নীরবতা ভগ্ন করে লাবণ্য হেসে উঠলো খিল খিল করে। বন্ধ গাড়ির ইঞ্জিন জেগে ওঠায় সে আনন্দিত হয়েছে। এবার তাদের যাত্রা অবাধ হবে। তার হাসির শব্দে চমকে উঠে কটা পাহাড়ি হিমালয়ান পিজিয়ন পাইন গাছের মধ্য থেকে ডানা ঝাপটে ডাকতে ডাকতে আকাশের দিকে উড়ে চলে গেলো। এরকম ভীত পাখিরা কাকে ডাকে? সে ডাকে কেউ কি সাড়া দেয়? কে জানে। আমি অমিত রে ভেজা পাহাড়ি পথের উপর বসে বসে সবকিছু দেখতে থাকলাম। আমার দিকে হাত নাড়াতে নাড়াতে লাবণ্য আর শোভনলাল গাড়ি সমেত আমার দৃষ্টি সীমা ছাড়িয়ে হারিয়ে গেলো। হারিয়ে গেল সামনে পথের ব্লাইন্ড টার্নটাতে‌। পাহাড়ি পথে এরকম ব্লাইন্ড টার্ন থাকে রাশি রাশি। তাই খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। লাবণ্য কি সেটা পারবে? হঠাৎ সেদিক থেকে একটা লাল ওড়না উড়তে উড়তে এসে একটা গোত্তা খেয়ে নেমে যেতে থাকলো নীচে গভীর খিদের মধ্যে। অন্ধকার বলে নীচের সে দৃশ্য এখান থেকে অদৃশ্য। ওড়নাটা কি আসলে লাবণ্যর রেশমের স্কার্ফটা? লাবণ্য সেটা আমার উদ্দেশ্যে উড়িয়ে দিয়েছে? আমি অর্থাৎ অমিত রে আগু পিছু না ভেবে সেই লাল স্কার্ফের দিকে ছুটে গেলাম। গভীর খাদের কালো ব্যাক ড্রপের মধ্যে স্কার্ফটা যেন একটা উড়ন্ত লাল পাখী। উড়তে উড়তে নেমে যাচ্ছে গভীর অন্ধকরে। আমি অর্থাৎ অমিত রে সেটাকে ধরার জন্য ঝাঁপ দিলাম। আর তখনই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দেখলাম এখন আমি আর ঘামে ভিজে নেই। বরং ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি।

- ওয়াও। এটাও দারুন। আপনি নিশ্চয়ই সাহিত্য রসিক। এ তো রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’। এ স্বপ্নেরও একই ব্যাখ্যা। আপনার অবচেতন মনে উপন্যাস শেষের কবিতার গভীর প্রভাব রয়েছে। সেই প্রভাবই আপনাকে এই স্বপ্নটা দেখিয়েছে।

- তা হতে পারে। তবে এ স্বপ্নটাও তো ইনকমপ্লিট।

- কেন?

কারণ অতঃপর কি হলো আমার? লাবণ্যর? শোভনলালের?

জানা গেলো না তো। মোর ওভার একই রাতে পর পর দেখা হলেও। দুটোই ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন। তাদের মধ্যে কোনো ইন্টার কানেকশন নেই। কেন নেই?

- সেটা অবশ্যি বিশ্লেষণের বিষয়। সেটা আমার মতো মনোবিদের কাজ। সে সব পরে করা হবে। কিন্তু তার আগে তৃতীয় স্বপ্নটা বলুন তো।

- এটাতে আমি রাম। রামায়নের শ্রীরামচন্দ্র। লঙ্কায় আছি। কিছুক্ষণ আগেই রাবণের সাথে ধমাসান  লড়াইটা শেষ হয়ে গেছে। অশোকবন থেকে বন্দিনী সীতাকে মুক্ত করে নিয়ে আসা হয়েছে। সীতা আমাকে দেখা মাত্র ভাব বিহ্বল হয়ে গেছে। হেসে উঠেছে, কেঁদেছে, ছুটে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে। কিন্তু না। আমি শ্রীরামচন্দ্র। আমি নিজেকে ভাবাবেগে বয়ে যেতে দিইনি। আমি সীতার অগ্নিপরীক্ষার নিদান দিয়েছি। আমার বানর সেনারা অত্যন্ত আজ্ঞাকারী। তারা সর্বদা বিনা প্রশ্নে আদেশ পালন করে থাকে। এখানেও করছে। বিষণ্ণ বদনে তারা অশোবনের ডালপালা ভেঙ্গে এনে সমুদ্রতীরে স্তুপাকার করে রাখছে। তবে সমুদ্রের নীল জল মাথায় ক্রোধের ফেনা নিয়ে হাহাকার করে সৈকতে মাথা কুটছে। তার ফলে ছিটকে  যাচ্ছে সাদা ফেনার সাথে সাথে ভেজা সোনালী বালি। শনৈ শনৈ সমুদ্রের ঢেউ এগোচ্ছে কাঠের স্তুপের দিকে। যেন তার ইচ্ছে আগুন জ্বলে ওঠার আগেই কাঠের স্তুপটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিছুতেই সীতার অগ্নিপরীক্ষা হতে দেবে না সে। আমি অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্র সমুদ্রের সেই দুরভিসন্ধিটা টের পেয়ে গেছি। হাজার হলেও আমি অন্তর্যামী। আমি ভগবান। আমি ধনুকে বান জুড়ে সমুদ্রের দিকে তাক করলাম। আর গর্জে উঠলাম।

- সম্বর হে সাগর। সম্বর। না হলে এই শোষক বান ছুঁড়ে তোমার সমস্ত জল শুষে নেবো।

সাগর জানে আমি রাজ্যচ্যুত হলেও মহাশক্তিধর শ্রীরামচন্দ্র অক্ষম বিদেশি রাজা ক্যানুইট নই। যার আদেশ সমুদ্র শোনে না। আমার আদেশ সমুদ্রকে মানতেই হবে। সমুদ্র তার ঢেউ সম্বরণ করে নিলো। সীতা মৃদু পায়ে এসে সেই কাঠকুটের স্তুপে আরোহণ করল। আমি রাম, ধনুকে অগ্নিবাণ সংযোগ করলাম। ধনুক আর তীরের অগ্রভাগ সহ মুষ্টিবদ্ধ বামহস্ত সামনের দিকে যত দূর সম্ভব প্রসারিত করে দিলাম। ডানহাত দিয়ে বাণের পশ্চাৎ ভাগ সহ ধনুকের ছিলাটাকেও আকর্ণ টেনে আনলাম। দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো তীরের মাথায়। সেটাই অগ্নিবানের চরিত্র। এবার এই কাঠের স্তুপের দিকে এই বান ছুটে গেলে তাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে। তার উপরে উপবিষ্টা সীতা অগ্নিশুদ্ধা হবেন। এমন সময়...

- এমন সময় কি?

- এমন সময় জলপথ দিয়ে একটা নৌকা এবং সৈকত দিয়ে একটা নীল বিদেশি গাড়ি ছুটে এলো। নৌকোটাতে দাঁড় নেই, হালও নেই, কিন্তু কপিলা দাঁড়িয়ে আছে সটান মাথা উঁচু করে। তার হাতটাও সামনের দিকে প্রসারিত। যেন নৌকটাকে দিশা নির্দেশ দিচ্ছে।

বিদেশি নীল গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে লাবণ্য। তার দৃষ্টিও লক্ষ্যে স্থির। সৈকতের সোনালী বালুর উপর চাকার গভীর দাগ কেটে। মরুঝড়ের মতো বালু ছিটিয়ে ছিটিয়ে গাড়িটা তীব্র গতিতে ছুটে আসছে। তারপর।

হ্যাঁ তারপর একই সঙ্গে সেই নৌকো আর গাড়িটা প্রবল ভাবে আছড়ে পড়লো সেই স্তুপিকৃত কাঠ কুঠের সাজানো চিতায়। তছনছ করে দিলো সেটাকে। হাতের অগ্নিবান হাতেই থেকে গেলো আমার। আর সেই সময়েই আকাশ থেকে নেমে এলো একটা রথ। রথটা খুব চেনা। এটা রাবণের পুষ্পক রথ। সীতা লাবণ্য  আর কপিলা লাফ দিয়ে তাতে উঠে পড়লো। পুষ্পক রথ আকাশে উড়ে গেলো। চার চারটা বামা কন্ঠের হাসি চরাচরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো। হ্যাঁ। তিনটে নয় চারটে বামা কন্ঠ। কারণ রাবণের পুষ্পকরথ রাবণ নয়, চালাচ্ছিলেন রাণী মন্দোদরী। সীতা কপিলা লাবণ্যের সাথে সাথে হাসছিলেন তিনিও।

- বাহ্। এ তো দারুন স্বপ্ন। আর এইতো তিনটে স্বপ্নের যোগসুত্র পাওয়া গেলো। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা এতো ইনকম্প্লিট নয় এই স্বপ্নের প্রপার এন্ডিং আছে। মানে লিটেরারি প্রপার এন্ডিং। সোসাইটি হয়তো এ এন্ডিংকে ইমপ্রপার বলবে। ফরগেট দ্যাট। নাও টেল মি, এজ এ সাইকিক পেশেন্ট, আপনি আমার কাছে ঠিক কি চান? শ্যুড আই স্টপ অলৎদিস ড্রিম?

- না না। আমি চাই তিনটে স্বপ্ন টুকরো টুকরো আলাদা ভাবে না দেখে একসাথে দেখতে। শুধু এ তিনটে নয়। প্রতি রাতে আমি যে টুকরো টুকরো ভাঙ্গা স্বপ্নগুলো দেখি, আমি তাদের দেখতে চাই একদম  একসাথে। এজ এ এমালগামেটেড ওয়ান ড্রিম। স্বপ্ন দেখা বন্ধ হোক আমি কিন্তু সেটা চাইছি না।

পেসেন্টের মুখে এই দাবি শুনে সাইক্রিয়াটিস্ট শর্মিষ্ঠা সান্যাল অবাক হয়ে তাঁর এই অদ্ভুত পেসেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

মনে মনে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতে থাকলেন তার বলা স্বপ্নগুলোকে। মনোবিদ হিসেবে অনেক দিনের অভিজ্ঞতা তার। তাই দিয়ে গভীর ভাবে বুঝতে চেষ্টা করলেন বিষয়টাকে।

- ম্যাডাম বাড়ি যাবেন না?

আচমকা ড্রাইভার সুরেশ্বরের আওয়াজে সচেতন হয়ে উঠলেন শর্মিষ্ঠা সান্যাল।

চমকে উঠে দেখলেন নিজের চেম্বারে সম্পূর্ণ একা একা বসে আছেন তিনি। সেই ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখা মানুষটা কখন তার সামনে থেকে উঠে চলে গেছে।

হঠাৎ তার মনে হলো সত্যি সত্যি কেউ এসেছিলো কি?

নাকি এটা ছিল তার নিজেরই জটিল একটা স্বপ্ন?

তবে কি অসংখ্য মনোরোগী ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি নিজেই হয়ে গেছেন মনোরোগী?


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন