কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(৩২)               

বহু পরে বিশ্রুত ওকে বলেছিল, আসলে সবটাই স্বার্থ। স্বার্থের জন্যই ও উঁচুতে ওঠে। স্বার্থের জন্যই নীচে নামে। এই ধরনের মানুষের কোনও নীতি থাকে না। দুর্নীতিই এদের জীবনের একমাত্র নীতি। বরং এরা রাজনীতিতে গেলেই ভালো করত। ওটাই ওদের আসল জায়গা।

বিদেশ থেকে মেহুলী যখন ফিরে আসে, ততদিনে দিশারী বাইরে চলে গেছে। এরপরই মেহুলী জড়িয়ে যায় বিশ্রুতর সঙ্গে।

অতলান্ত এখন আর মোবাইল ধরে না। বাড়িতে ফোন করেও তাকে পাওয়া যায় না। কিছুদিন আগেও ওর বাবা বা মা বিশ্রুতকে দেখলে গলে গলে পড়তেন। কথা বলতেন তোষামোদের সুরে। স্তাবকতার নিখুঁত অভিনয় করতেন। এখনফোন বেজে বেজে কেটে যায়। কখনও কদাচিৎ অতলান্তের বাবা ফোন ধরেন। গলার স্বর ভারী। একবাক্যেই কথা শেষ করে দেন। ও বাড়ি নেই। তারপ আর কোনও সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দেন।

হৃদয়ের জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা নতুন। হকচকিয়ে যায় সে। বিশ্রুতকে বলে, ব্যাপারটা কী বল তো? খুব সকালে ফোন করলেও বলে বাড়ি নেই! রাত করে ফোন করলে বলে বাড়ি নেই। আমি এতদিন ধরে ওকে দেখছি। কখনও তো এই সময়গুলোতে বাড়ির বাইরে দেখিনি।

ও বাড়িতেই থাকে। বিশ্রুত শান্ত গম্ভীর স্বরে বলে। কিন্তু আমাদের এড়িয়ে যেতে চায়।

কেন? আমরা ওর কী ক্ষতি করেছি?

আমরা ওর অনেক উপকার করেছি। বিশেষ করে তুই না থাকলে ও কোথায় থাকত আজ?

তাহলে ও এরকম করছে কেন?

আরে সেই কারণেই তো ও এরকম করছে।

এরপর আর কোনও কথা বলা চলে না। হৃদয় চুপ করে যায়। এ এক শিক্ষাই বটে তার জীবনে। মানুষের উপকার করলে উপকৃত মানুষটি উপকারীকে এড়িয়ে যায়।

ফুলের বাগানের সাংস্কৃতিক উৎসবের দিন চলে আসে। অতলান্ত আসে না। বাকি সবাই অংশ নেয়। রাতের দিকে একটা ঘটনা ঘটে। শ্রমণ কী একটা কাজে সমুদ্রের দিকে গিয়েছিল। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় অতলান্তের। সঙ্গে ছিল সাঁঝ। সমুদ্রের ধারে ওরা দাঁড়িয়ে ছিল। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছিল। তাই কিছুটা অন্যমনস্কও ছিল। হঠাৎ ওরা শ্রমণকে দেখতে পায়।

ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে খুবই খুশী হয় শ্রমণ। ভাবে, দেরী করে হলেও অতলান্ত শেষ পর্যন্ত এসেছে। ফুলের বাগানের দিকেই যাচ্ছে সে। উৎসবের কথা ভোলেনি। কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম ঘটে।

সাঁঝ হঠাৎ বলে ওঠে, শ্রমণ, কেমন চলছে তোদের উৎসব?

বিন্দাস! শ্রমণ বলে ওঠে। তা তোরা এখানে কেন? ফুলের বাগানে চ। ওখানেই সবাই আছে।

আমার তো খুবই ইচ্ছা করছে যেতে। সাঁঝ বলে ওঠে।  দূরে আবছাভাবে ক্যাথিড্র্যালটা দেখা যায়।

অতলান্ত এতক্ষণ কিছুই বলে নি। এবার সে বলে ওঠে, না আর সময় নেই।

মানে? চমকে ওঠে শ্রমণ। তারপর বলে অন্তত বইটা দেখবি তো! তোরও তো জোকস আছে...

লেখাটা সময়মতো ঠিকই পাঠিয়ে দিয়েছিল অতলান্ত। ও জানত বইটা প্রাইভেট সেক্রেটারির চোখে পড়বে। ম্যানেজিং ডিরেক্টরও নেড়েচেড়ে দেখবেন। ওর নাম না থাকলে সেটা ওদের চোখে পড়বেই।

অতলান্ত অত্যন্ত শান্তভাবে জবাব দেয়, লেখাটা আমার ডায়েরিতে আছে।

সাঁঝ একটু নাছোড়ভাবেই বলে, চল না অতলান্ত, বইটা তো দেখে আসি...

অতলান্ত এবার স্পষ্ট নিষেধ করে, না।

সাঁঝ চুপ করে যায়। কিন্তু শ্রমণ হাল ছাড়ে না। অতলান্তকে সে অন্যভাবেই দেখতে অভ্যস্ত। এই নতুন অতলান্তকে সে চেনে না। কিন্তু অতলান্তকে টলানো যায় না। একটু পরেই ওরা উলটোদিকে হাঁটতে শুরু করে। অন্ধকারেও মিলিয়ে যায়। শ্রমণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওর পা দুটো যেন সীসের মতো ভারী হয়ে উঠেছে। কেউ যেন বালির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে সেগুলো। সাঁঝ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রমণকে দেখে। একবার হোঁচট খেয়ে পড়েও যায়। তারপর আবার যখন এগোতে থাকে, খুব ক্লান্ত মনে হয় ওকে।

কয়েকদিন পর আগ্নেয়র সঙ্গে দেখা হয় অতলান্তের। সমুদ্রের ধারে একটা নিরিবিলি পার্কে। দুজনে দুজনকে দেখে এগিয়ে আসে। তারপর একটা সবুজ বেঞ্চে গিয়ে বসে। ওদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় একঝাঁক পাখী।

অতলান্ত জানতে চায়, ডেকেছিস কেন?

আগ্নেয়কে এবার একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখায়। ভুরু কুঁচকে বলে ওঠে, মনে হচ্ছে ফুলের বাগান এবার ছাড়তে হবে। এভাবে চলতে পারে না।

নাঃ! এভাবে সত্যিই চলতে পারে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতলান্ত। এই দীর্ঘশ্বাস আগ্নেয়কে খুব প্রভাবিত করে।

তুইও তাই মনে করিস? আগ্নেয় জানতে চায়।

না মনে করে উপায় কী? হৃদয় অসম্ভব একগুঁয়ে। ওর কথামতো সবাইকে চলতে হবে। আরে, আর কারো কোনও মত নেই নাকি?

আগ্নেয়র মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অতলান্ত ওর মনের কথাগুলো পড়ে ফেলেছে। ও কিছু বলার আগেই। অথচ এই কথাগুলো রোজ ও শোনায় সমিধা আর বিহানকে। রোজ একবার করে ওদের মনে করিয়ে দিতে হয়।

সে বলে, হৃদয়কে আমি জানিয়ে দিয়েছি। আমি মাসের চাঁদা আগের মতোই দেব। কিন্তু ফুলের বাগানের কাজ আর করতে পারব না।

আমি চাঁদাও দেব না, কাজও করব না। চাইলে ওরা আমার নামটা ওদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে।

অতলান্তের কাছ থেকে একটা মানসিক সমর্থন চাইছিল আগ্নেয়। সেটা ও পেয়ে গেছে। ওরা দুজনে দুদিকে চলে যায়। অতলান্ত সমুদ্রের ধারে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অসম্ভব হাসি পাচ্ছে ওর। কিন্তু সেটা প্রকাশ করা চলবে না। আগ্নেয় সরে যেতই। একটা শেষ কোপের দরকার ছিল। সেই কোপটাই ও দিয়ে এসেছে। হৃদয় আরও দুর্বল হল। এবার বুঝবে কত ধানে কত চাল!

কয়েকদিন পর হৃদয়কে ফোন করল অনির্বেদ। বলল, জানিস, অতলান্ত বিদেশ যাচ্ছে?

ফুল নিয়ে বলতে নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ। স্বয়ং ম্যানেজিং ডিরেক্টর...

জানি, জানি, সবই বুঝেছি।

অনির্বেদকে খুব খুশী দেখায়। কয়েকদিন পর ফুলের সবচেয়ে বড়ো মেলায় মঞ্চে দেখতে পায় অতলান্তকে। প্রধান অতিথি হিসাবে সে আমন্ত্রিত। খুব মিষ্টি করে কথা বলছিল অতলান্ত। শ্রোতারা একদম মন্ত্রমুগ্ধ। কিন্তু ঠিক কী বলতে চায় ও? অনেক চেষ্টা করেও অনির্বেদ ঠিক বুঝতে পারল না। কোনও সারমর্মই উদ্ধার করতে পারল না সে। শুধু কয়েকটি শব্দের মধুবর্ষণ ছাড়া আর কোনও রেশই রইল না ওর মনে।

অনির্বেদের সঙ্গে ছিল শ্রমণ। সে বলল, ওর ভেতরটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে। অনির্বেদ কোনও মন্তব্য করল না।

মঞ্চ থেকে নেমে এল অতলান্ত। ওর পিছনেই দাঁড়িয়েছিল বিহান। দুজনে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। অনির্বেদ আর শ্রমণকে দেখে হঠাৎ চুপ করে গেল। অতলান্ত শ্রমণকে যেন ঠিক চিনতে পারল না। কিন্তু অনির্বেদকে দেখে হাসিমুখেই এগিয়ে এল। অনির্বেদও যেন কৃতার্থ হয়ে গেল।

অনির্বেদ বলল, তোর কাছে একটা জিনিস চাইব অতলান্ত। দিবি?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

তুই ফুল নিয়ে নতুন যে জোকসের বইটা লিখেছিস, তোদের কম্পানি ছাপিয়েছে, সেটাই...

অতলান্ত চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল, দেখি...

ওরা সবাই যখন ফুলের বাগানে আড্ডায় বসত, তখন মনে হত একে অপরের জন্য নিজেদের প্রাণটাও দিয়ে দিতে পারে। কথায় কথায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরত। প্রশংসা বাহবায় ভরিয়ে দিত। সবাই সবাইকে উৎসাহ দিত, প্রেরণা দিত। একে অপরের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। খুব বেশী কিছু চায় নি তো অনির্বেদ। একটা বইয়ের সামান্য একটা কপি। এ তো ওর প্রাপ্যই। শুধু ওর কেন? ওদের প্রত্যেকেরই। অতলান্তের তো নিজেরই ফোন করে জানানো উচিত ছিল। বন্ধুদের একটা করে কপি দেওয়া উচিত ছিল। বন্ধুদের মধ্যে ওরই প্রথম বই বেরিয়েছে। ওর মুখের ঐ ছোট্ট ‘দেখি’ অনির্বেদকে কেমন থমকে দিল। অতলান্ত যেন ঠিক ইচ্ছুক নয়। অনিচ্ছুক ব্যক্তির কাছে কিছু দাবী করা কি ঠিক?

অনির্বেদ বলল, তোর অসুবিধে থাকলে থাক বরং।

আসলে বইটা তো আমি নিজের পয়সায় করি নি। কম্পানি করেছে। কম্পানির স্টলে গিয়ে দেখি একবার। চল যাওয়া যাক...

(ক্রমশঃ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন