কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পঙ্কজকুমার চ্যাটার্জি

 

ওপেনহাইমারের গবেষণা-উপদেষ্টা ম্যাক্স বর্ন এবং সি ভি রমণ 




ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ‘ওপেনহাইমার’ বায়োপিক সারা বিশ্বে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে। এই তথ্য এখন সবারই জানা যে জে রবার্ট ওপেনহাইমার এক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী যিনি আমেরিকার ‘ম্যানহাটান প্রোজেক্ট’কে নেতৃত্ব দিয়ে প্রথম আণবিক বোমা তৈরি করেছিলেন। আর এই বোমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির উপর ফেলা হয়। আমরা জেনে খুশী হবো যে এই ওপেনহাইমারের পিএইচডি গবেষণার গাইড ছিলেন ম্যাক্স বর্ন, যিনি ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত দেশের সেরা বিজ্ঞান-গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটে (আইআইএসসি) অধ্যাপনা করে গেছেন নোবেল পুরস্কার জয়ী ভারতীয় বিজ্ঞানী সি ভি রমণের আমন্ত্রণে।

পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম গতিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে যে সব বিজ্ঞানীর অবদান আছে তাদের মধ্যে ম্যাক্স বর্ন অন্যতম। তিনি তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রের সবচেয়ে সন্তোষজনক ফর্মূলা তৈরি করেন। ১৯২৬ সালে তাঁর ছাত্র ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ নতুন কোয়ান্টার তত্ত্বের প্রথম সূত্র প্রণয়ন করলে তিনি তাঁর সঙ্গে কাজ করে গাণিতিক ফর্মূলাকে আরো উন্নত করেন। এর পরে যখন এরউইন শ্রডিংগার কোয়ান্টাম তাত্ত্বিক তরঙ্গের সমীকরণ প্রণয়ন করেন তখন তিনি দেখান যে তরঙ্গের সমীকরণের সংখ্যাতাত্ত্বিক অর্থের বাস্তব গুরুত্ব। তখন তিনি জার্মানির গটিংজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সেখানে তিনি যেসব বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেন তাঁদের মধ্যে আছেন এনরিকো ফেরমি, রবার্ট ওপেনহাইমার এবং পাস্কাল জর্ডান।

বর্নের জীবনের পেশাগত এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের এক চরম মুহূর্ত ছিল ১৯২৮ সাল যখন আলবার্ট আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করেন। অদ্ভূতভাবে নোবেল কমিটি বর্নের কাজকে পুরস্কারের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেননি, যেখানে এই বিষয়ে তাঁর ছাত্র এবং সহযোগী হাইজেনবার্গ এবং শ্রডিংগার যথাক্রমে ১৯৩২ এবং ১৯৩৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। অবশেষে ১৯৫৩ সালে অবসর গ্রহণের এক বছর পরে ১৯৫৪ সালে তিনি আন্তরাণবিক কণার প্রকৃতির সংখ্যাতাত্ত্বিক ফর্মূলা প্রণয়নের জন্য নোবেল পুরস্কার পান।

১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার পর ইহুদি হওয়ার কারণে বর্ন ২৫ এপ্রিল কর্মচ্যুত হন। তখন তিনি সপরিবারে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজে চলে আসেন। সেখানে তিনি অস্থায়ী লেকচারারের পদ পান। সেই কাজ করাকালীন তিনি রমণের কাছ থেকে চিঠি পান। ১৯৩৩ সালে সি ভি রমণ যখন আইআইএসসি’র ডিরেক্টর পদে নিয়োজিত হন তখন আইআইএসসি’তে রসায়ন বিদ্যার কয়েকটি বিভাগ এবং শিল্পের প্রয়োজনে নিবেদিত বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির বিভাগ ছিল। রমণ প্রথম এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যার বিভাগ খোলেন। এই বিভাগকে বিশ্বমানের পর্যায়ে আনার জন্য তিনি বর্নকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে রমণ বর্নকে কয়েকজন ‘তরুণ এবং দক্ষ’ বিজ্ঞানীর নাম সুপারিশ করতে বলেন। উত্তরে বর্ন লেখেন যে তিনি ব্যাঙ্গালো্র স্থান হিসেবে কেমন না জেনে কাউকে ভারতে আসতে রাজী করাতে পারবেন না। তখন রমণ বর্নকে অনুরোধ করেন যে তিনি নিজে ছয় মাসের জন্য এসে কাজ করতে আগ্রহী কিনা, যাতে তিনি স্থানটির সম্বন্ধে জানতে পারেন। যেহেতু কেম্ব্রিজের অধ্যাপনার কাজ ছিল অস্থায়ী তাই তিনি স্ত্রী হেডির সাথে আলোচনা করে ভারতে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বর্নের রাজী হওয়ার সংবাদ পেয়ে রমণের পক্ষে আইআইএসসি’র পরিচালন সমিতির কাছ থেকে সম্মতি আদায় করতে অসুবিধা হয়নি। বর্নকে মাসিক ১৫০০০ টাকা সান্মানিকে ছয় মাসের জন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিভাগের রীডার পদে নিয়োগ করা হয়।

১৯৩৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে ম্যাক্স বর্ন সস্ত্রীক আইআইএসসি’তে আসেন। রমণের স্ত্রী লোকসুন্দরী আম্মাল তাদের অভ্যর্থনা জানান এবং এক দ্বিতল বাংলোতে তাঁদের নিয়ে আসেন, যেখানে তাঁরা পরবর্তী ছয় মাস কাটাবেন। বর্ন লিখেছেন, “আমাদের সুন্দর গাছ এবং ফুলসমন্বিত বিশাল বাগান ছিল। দু’টো টেনিস কোর্ট ছিল যেগুলি চমৎকার বোগেনভালিয়া গুল্মদ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। রমণের পরিবারও একই রূপ এক বাংলোতে রাস্তার ঠিক ওপাড়ে থাকতেন।”

প্রথম কয়েকদিন রমণ ব্যস্ত থাকায় বর্নের পরিবার তাঁর দেখা পাননি। কিন্তু প্রথম দর্শনেই বর্ন দম্পতি রমণের প্রতি আকৃষ্ট হন। বর্নের স্ত্রী হেডির কথায় পাগড়ি মাথায় ভারতীয় পোষাকে রমণকে ‘আরবিয়ান নাইটস’-এর এক যুবরাজ মনে হচ্ছিল। ব্যাঙ্গালোরে বর্নের সঙ্গে মহীশূরের দেওয়ান মির্জা ইসমাইলের সাথে পরিচয় হয়। বর্ন লিখেছেন, “মহীশূরের বেশির ভাগ মানুষ হিন্দু এবং দেওয়ান মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন সংঘর্ষ ছিল না।” ইসমাইল মহীশূর এস্টেটের নির্মাণ কাজের জন্য ভালো কোন স্থপতির নাম জানতে চাইলে, বর্ন তাঁর ভাইপো অটো কোনিগসবার্গারের নাম প্রস্তাব করেন। ভাইপোও তখন জার্মানি থেকে বিতাড়িত। দেওয়ানের আমন্ত্রণে কোনিগসবার্গার মহীশূর এস্টেটের স্থপতি হিসাবে নিয়োগপত্র পান। তিনি ব্যাঙ্গালোরে আইআইএসসি সহ অনেক বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করেন।

রমণের সাথে আধুনিক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার আলোচনা প্রায়শ উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও বর্ন আইআইএসসি-তে সুখেই ছিলেন। সেই সময় রমণ চেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানে বর্নের জন্য একটি স্থায়ী পদ সৃষ্টি করতে। এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বর্ন দম্পতি এই প্রস্তাব মুক্তমনে গ্রহণ করেন। দুটি গবেষণা কমিটি গঠিত হয় - একটি ব্যাঙ্গালোরে (রমণের অধীনে) এবং দ্বিতীয়টি লন্ডনে (পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের অধীনে)। উভয় কমিটিই বর্নকে একটি স্থায়ী পদ দেওয়ার বিষয়ে সম্মত ছিল এবং নিয়োগ মোটামুটি পাকা হয়ে যায়। কিন্তু, রমণকে প্রতিষ্ঠানের সেনেট এবং কাউন্সিলের কাছে সম্মতি আদায়ের জন্য প্রস্তাব পাঠাতে হয়।



সেনেটে সভা চলাকালীন বর্ন রমণ এবং আইআইএসসি-র পরিচালন সমিতির মধ্যে কুৎসিত বিতর্ক হতে দেখেন। সেই সভায় বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি বিভাগে অধ্যাপক পদে সদ্য নিযুক্ত এক ইংরেজ কেনেথ অ্যাস্টন রমণ এবং বর্ন উভয়কেই আক্রমণ করেন। বর্ন লিখছেন, “ইংরেজ অধ্যাপক উঠে দাঁড়ান এবং রমণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে খুব অপ্রীতিকর ভাবে বক্তব্য রাখেন। তিনি ঘোষণা করেন যে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত এক দ্বিতীয় শ্রেণীর বিদেশী যথেষ্ট উপযুক্ত নন। আমরা অ্যাস্টনের প্রতি সৌহার্দ্রপূর্ণ ব্যবহার করা সত্ত্বেও তাঁর এই ব্যবহার আমাদের কাছে বিশেষ ভাবে হতাশাব্যঞ্জক মনে হয়েছিল। [তাঁদের বাংলো প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত অ্যাস্টন পরিবার বর্নের বাংলোতেই অবস্থান করেছিলেন] আমি এতই ভেঙ্গে পড়ি যে হেডির কাছে ফিরে আসার সময় আমি কেঁদেই ফেলি।”

এইভাবে ম্যাক্স বর্নকে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু, তাঁর লেখা থেকে আর একটি দুঃখজনক ঘটনার কথা জানা যায়। রমণ চেয়েছিলেন খুব দ্রুত আইআইএসসি-র উন্নয়ন ঘটাবেন। তিনি ভৌত রসায়ন বিভাগকে নতুন পদার্থবিদ্যার অধীনে আনতে চান। এই পদক্ষেপে সাধারণ রসায়ন বিভাগের (যে বিভাগের অধীনে ভৌত রসায়ন বিভাগ ছিল) অধ্যাপক এইচ ই ওয়াটসন ক্ষুব্ধ হন এবং প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। বর্ন লিখছেন, “ওয়াটসন এবং তাঁর বন্ধুরা আশা করেছিলেন যে তিনি স্যার মার্টিন ফরস্টার অবসর নেওয়ার পরে নতুন ডিরেক্টর হবেন। নিশ্চিতভাবে ওয়াটসন একজন ভারতীয় ডিরেক্টরের অধীনে কাজ করতে পছন্দ করেননি। ওয়াটসনের কিছু বন্ধুর কাছ থেকে আমি এই তথ্য জেনেছি।”

ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেজের আর্কাইভ থেকে জানা যায় বর্ন নভেম্বর ১৯৩৫ এবং এপ্রিল ১৯৩৬ এর মধ্যে আইআইএসসি’তে অনেক গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। বিজ্ঞানীরা আক্ষেপ করেন যে বর্নের মতো এক বিজ্ঞানীর অবদান ভারত হারিয়েছে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন