সমকালীন ছোটগল্প |
খাঁদু মোড়লের এ জয়, গণতন্ত্রের জয় (দ্বিতীয়
পর্ব)
[এটি আদ্যন্ত একটি কল্পকাহিনী। লেখাটির কোনও চরিত্র বা কোনও ঘটনার ক্ষুদ্র অংশের সহিত বাস্তবের কোনও চরিত্র বা কোনও ঘটনার সাযুজ্য চোখে পড়ে, সেটা নিতান্তই কাকতালীয় বলেই বিবেচিত হবে। - লেখক]
‘ফাদার অফ মডার্ন থিয়েটার’ যাকে বলা হয় সেই সুইডিশ নাট্যকার তার ‘এনিমিজ অফ পিউপিল’ নাটকে লিখেছিলেন, কমন পিউপিলস আর ইডিয়ট। আমাদের ঘরের পাগলা ঠাকুর তিনি ইবসেন পড়েননি বা পড়ারও কথা নয়, তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত, প্রায় একই কথা অন্যভাবে বলেছিলেন, লোক নয় পোক। কিন্তু এযুগে বসে রম্য রচনায় সিদ্ধহস্ত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তার ‘ছাগল’ গল্পে মানুষকে দেখবার নিমিত্ত এক অসাধারণ দিকদর্শন দিলেন। চমৎকৃত হয়েছিলাম সেই পাঠে। তিনি সোজাসাপটা বলে দিলেন, "মানুষকে মানুষ ভাববি না শ্লা, ভাববি টার্গেট"। আহা, এ জ্ঞান যেন একেবার হাতেগরম মোক্ষলাভ। "মানুষকে মানুষ ভাববি না শ্লা, ভাববি টার্গেট"। ভাবা যায়! কেবল ভারতবর্ষেই খুবই কম খরচে বা একেবারেই বিনা খরচে (কারও ক্রয় করা বই বা পত্র-পুস্তিকা চেয়েচিন্তে পড়ে নিলে) জ্ঞানের এমন উজ্জ্বল মণিমুক্ত পকেট ভর্তি করে নিয়ে গিয়ে আবলুশ করা আলমারিতে গুছিয়ে রাখা যায়।... যাই হোক, এবার সরাসরি গল্পে ঢুকে যাই। দেশের স্বাধীনতা লাভের তিন-চার দশক পরের এক সীমান্তবর্তী গ্রাম। সে গ্রামের এক মোড়লকে নিয়েই এ গল্প।
(দ্বিতীয় পর্ব)
(১)
অবশেষে সরকারী আপিসে গিয়ে নাম জমা দেয়ার দিন চলে এলো। পাঁচদিনের প্রথম দিনেই মোড়লের নাম জমা পড়বে ঠিক হলো। সেইমতো আয়োজন করে ফেললো গালকাটা। সকাল এগারোটার মধ্যেই দেখা গেলো মোড়লের বাড়ির সামনে গাঁয়ের লোক যেন হামলে পড়েছে। এমন কেউ নেই যে আসেনি। ছেলে বুড়ো বাচ্চা মেয়ে বউ বুড়ি যে যেখানে আছে মোড়লের বাড়ির সামনে এসে লাইন করে দাঁড়িয়েছে। মোড়ল সেজেগুজে তার বউদের হাত ধরে বাইরে এলো, আর বাইরে পথে এসে দাঁড়াতেই গাঁয়ের সব মার্কামারা ক্রিমিন্যালগুলো কোথা থেকে আবির্ভূত হয়ে মোড়লের চারপাশে ঘিরে দাঁড়ালো। সকলের মুখের দিকে তাকাতেই কেমন ভয়ে কেঁপে ওঠে মোড়লের বুক। অনেক ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে টরিয়ে মিছিল শুরু হলো। চললো নাম জমা দিতে। হঠাৎই কে যেন এসে খবর দিলো হাবলা জোতদারও আজ ভোটের নাম জমা দেবে, তারাও আসছে। তারাও নাকি অনেক লোকজন জোগাড় করে নিয়ে আসছে। গালকাটা খবরটা পেতেই তার টিমের সেই দাগীদের মধ্যেও চাউড় হয়ে গেলো খবরটা, আর মুহূর্তের মধ্যে তাদের মধ্যে কি কথা চালাচালি হলো কে জানে, হঠাৎই দেখা গেলো সেই দাগীগুলোর অনেকেই গালকাটার সঙ্গে কোথায় চলে গিয়েছে।
যাইহোক মোড়লের মিছিল এগিয়েই চলেছে, একজন এগিয়ে এসে মোড়লকে
বলে গেলো হাবলা জোতদারের মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছে গালকাটার এক সাগরেদ। সেই নাকি কোথা
থেকে লোক ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। চলতে চলতেই দূর থেকে ভেসে এলো বাজীর শব্দ। তার কিছু
পরেই কে একজন ছুটতে ছুটতে এসে মোড়লকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুপিচুপি বললো, ওগুলো
বাজীর শব্দ নয়। হাবলা জোতদারের মিছিলে বোমা পড়েছে, গুলিতে ওর দলের দু-একজন লোক মারাও
গেছে। মিছিল থেকে মানুষ সব দুদ্দাড় কোরে পালিয়ে গিয়েছে। হাবলার মিছিল একেবারে ভেস্তে
গিয়েছে। ভয় পেয়ে পাশের কলাবাগানে হাবলা পালিয়ে বসেছিলো। পরে পুলিশ আসতে দেখে সেখান
থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর পুলিশই ধরে, ভয়ে কাঁপতে থাকা হাবলা জোতদারকে পাহারা দিয়ে নিয়ে
নাম জমা দেয়ার আপিসে পৌঁছে দিয়েছে। এ ঘটনা যেহেতু মোড়লের মিছিলের অন্য কেউই জানে না,
মোড়লের মিছিল ঠিকঠাক আপিসের দিকে এগিয়ে চললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো গালকাটা
এবং অন্য সব ডাকসাইটে খুনী বদমাশগুলো আবার একজায়গায় হয়ে খাঁদু মোড়লের পাশে পাশে হাঁটছে।
এবার আপিসের কাছাকাছি আসতেই পুলিশ বললো তিনজনের বেশি কেউ ভেতরে যেতে পারবে না। হঠাৎই
খাঁদু মোড়ল আবিষ্কার করলো, কোথা থেকে সেই রঙ-পার্টির নেতা এক উকিলকে নিয়ে তার পাশে
এসে দাঁড়িয়েছে। মোড়লের বুক জোর পেয়ে ফুলে একেবারে ৫৭ ইঞ্চি হয়ে গেলো। গালকাটা তবু বললো,
আমিও ভেতরে যাবো। পুলিশ আর তেমন বাধা দিলো না। তারা ভেতরে যাবার মুখেই দেখা গেলো হাবলা
জোতদার বেরিয়ে আসছে কেমন ভয় পাওয়া ফ্যাকাশে মুখ, গালকাটাকে দেখেই কেমন কাঁপতে শুরু
করেছে। পুলিশ কোনমতে ধরে তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে বাড়ির দিকে নিয়ে যায়। খাঁদু মোড়ল নিশ্চিত
হলো তার ভোটে জেতা আর কেউ আটকাতে পারবে না।
সেখানে কাজটাজ শেষ কোরে আবার বাড়ি ফিরে গালকাটার হাতে সেদিনের জন্য টাকাপয়সা
বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে এসে বসতেই, রঙ-পার্টির নেতা মোড়লকে জানিয়ে দিলো, হাবলা জোতদারের টিমটাকে
যারা লীড করছিলো তারা গালকাটা আর বিল্লার দুই সাগরেদ, দুজনাই আজ মিছিলের গণ্ডগোলে গুলি
খেয়ে মরেছে। পুলিশ জানতে পারেনি কারা তাদের গুলি করেছে। মোড়ল বুঝতে পারলো, গালকাটা
সত্যিই খুব বিশ্বস্ত। গালকাটা সাথে থাকলেই সে ভোটে জিতে যাবে। সেদিনের পর থেকে হাবলা
জোতদারকে আর তেমন বাইরে দেখা যায়নি, এমনকি ভোটের জন্য মিছিল মিটিঙ করতেও তাকে কারো
চোখে পড়েনি।
(২)
নাম জমা দেবার দিন যেদিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, দুপুর বারোটা/সাড়ে বারোটার দিকে সাইকেল নিয়ে গালকাটা এসে খাঁদু মোড়লকে ডেকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললো, আজ নাকি পাল পাড়ার এক শহরে লেখাপড়া করা ছেলে এসে অন্য এক রঙ পার্টি হয়ে নাম জমা দিয়েছে। তাকে সঙ্গে করে যারা নিয়ে গিয়েছে, গাঁয়ের লোক বলছে, তারা সব ভিন রাজ্য, ভিন গাঁ থেকে এসেছে। সব নাকি মার্কামারা ক্রিমিনাল। হাবলা জোতদারের নাম জমা দেবার দিন গণ্ডগোল হয়েছিলো শুনে, এরা আজকেই প্রকাশ্যে বড় বড় তলোয়ার, কাঁধে বন্দুক, পাইপ গান এইসব নিয়ে মিছিল করেছে। খবর পেয়ে পুলিশ আসতেই তারা অস্ত্রশস্ত্র এক ট্রলি ভ্যানের মধ্যে বিচুলির গাদায় লুকিয়ে ফেলেছে। গাঁয়ের অনেকেই সে সব দেখেছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম এরকম শ-দুয়েক লোক নাকি পালপাড়াতেই এর তার বাড়িতে কাল সকাল থেকেই ব্যবস্থা করে নিয়েছে ভোট পর্যন্ত থেকে যাওয়ার। কথাগুলো শুনে খাঁদু মোড়লের কপালে ভাঁজ পড়লো। সে বললো--
-- হাঁরে গালকাটা, ওরা যদি এমন যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে বুথে
ভীড় কোরে নিজেরাই সব ব্যালটে ছাপ মেরে চলে যায়, তাহলে আমার কি হবে?
-- শোনো, ওরা যত বড় ডাকাত মাস্তানই হোক, এ গাঁকে শাসন
করি আমরাই, এখানে ডাল গলাতে এলে ওদের একটাকেও আর ফিরে যেতে হবে না। গাঁয়ের নদী পাড়েই
গত্ত কোরে নুন ছড়িয়ে পুঁতে রেখে দেব, শেয়াল কুকুরও টের পাবে না। যাকগে, কাল তোমায় একটা
কাজ করতে হবে।
-- কি কাজ, বল।
-- আমাদের এ গাঁয়ের পুলিশের বড়বাবুর খুব নেশাদোষ আছে।
আজ রাতে আমি তোমাকে এনে একটা বড় বিলাতী মালের বোতল দিয়ে যাব, তুমি সেটা কাল ঝোলায় ভরে
নিয়ে গিয়ে বড়বাবুর সঙ্গে দেখা কোরে, কথাবলার মাঝখানে সেটা তার হাতে গুঁজে দেবার ব্যবস্থা
করবা।
-- এই সেরেছে, যদি রেগেটেগে গিয়ে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়,
আমার নামে কেস দিয়ে দেয়, তাহলে কি হবে?
-- কিচ্ছু হবে না। ঘরে যখন কেউ থাকবে না, সেই ফাঁকে বোতলটা
ঝোলা থেকে বার কোরে বলবা, দেখেন তো স্যার, ভোটে দাঁড়িয়েছি শুনে কতজন কতকিছু উপহার দিচ্ছে,
কাল একজন এসে এই বোতলটাও খুশি মনে দিয়ে গেলো। আরে আমি তো এসব খাইনে, এটা নিয়ে এখন কি
করি?== ব্যাস, তোমার কাজ শেষ। বাকি যা করবার থানাবাবু নিজেই করে নেবে।
-- হাঁরে, এসব করতে গিয়ে কোন বিপদ হবে না তো?
-- থামো তো, আমরা শালা এর মধ্যেই তোমার জন্যে দু-দুটো
লাশ ফেলে দিলাম, আর তুমি এটুকু করতে পারবা না!
-- না না, ঠিকই বলেছিস তুই, তোরা এত বড় বড় ব্যাপার করছিস,
আর আমি এটুকু করবো না! তাছাড়া তোদেরও তো আমার বাঁচাতে হবে, না কী? তুই যেভাবে বলছিস
আমি সেভাবেই করবো।
-- এবার আসল কথাটা শোনো। এসব ভেট দেয়ার কাজ মিটে গেলে,
তোমাকে ঘ্যাচাৎ কোরে আসল কথাটা এবার বলে ফেলতে হবে বা থানাবাবুর মাথায় ঢুকিয়ে দিতে
হবে। -- সেটা আবার কি কথা?
-- চুপ কোরে শোনো, আমরা পারলে এ কাজটা আমরাই করে নিতাম।
কিন্তু তুমি একটা হিল্লি-দিল্লি মার্কা বড় রঙ পার্টির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছো। তোমার রঙও
তাই আলাদা। থেকে থেকেই পুলিশকে দিয়ে তোমার কাজ করিয়ে নিতে হবে। যেমন, কালকের পালপাড়ার
ছেলেটির নাম জমা দিতে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করা লোকগুলোর কথা বড়বাবুকে
শুনিয়েই দাবি করতে হবে, ওইসব বাইরের থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা ডাকাতগুলো শুনলাম পালপাড়াতেই
সব ডেঁড়া গেড়েছে, ভোট পর্যন্ত থাকবে। ওই শ-দুয়েক লোকের যাবতীয় খরচ-খরচা প্রার্থীর রঙ
পার্টীই নাকি বহন করছে। আমাদের গাঁয়ের লোক, এমনকি পালপাড়া থেকেও লোক এসে আমার কাছে
মোড়ল হিসেবে নালিশ জানিয়ে যাচ্ছে। সবাই নিরাপত্তার খুব অভাব বোধ করছে। তাই স্যার, আপনাদের
পুলিশের ওপর তলায় জানিয়ে, জেলাসদর থেকে আরও বেশি পুলিশ নিয়ে এসে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে,
রেড করে, বাইরের সব লোকগুলোকে অস্ত্রশস্ত্র সমেত গ্রেপ্তার কোরে আমাদের ভোট-প্রক্রিয়াকে
নির্বিঘ্ন করতে হবে। আমার পার্টিও এটাই চাইছে।--
ব্যাস মোড়ল, এই কথাগুলো বলে দিলেই তোমার কাজ শেষ। বাকি
কথা হয় বড়বাবু বলবে, কিম্বা বলবে না। চলে আসবার আগে শুধু বলে আসবে, দিনদুয়েকের মধ্যেই
এর সুরাহা না হলে, গাঁয়ের পথ কিন্তু রক্তে ভেসে যাবে, আমাদের গাঁয়ের লোকেরাও খুব ক্ষেপে
আছে।
গালকাটার কথামতো খাঁদু মোড়ল বোতল ঝোলায় নিয়ে থানায় গেছে এবং বড়বাবুর সঙ্গে সাধারণ কথাবার্তার মাঝখানেই বড় বোতলটা ঘচাং কোরে বার কোরে টেবিলে রেখেই বলে ওঠে, পাগল লোকেদের কাণ্ড দেখেছেন! ভোটে দাঁড়িয়েছি শুনে কতজন কতরকম উপহার পাঠাচ্ছে। একজন কাল এই বোতলটাও পাঠিয়েছে। আমি তো খাই না, এটা যে কাকে দিই?
থানাবাবু কোনও কথা না বলে বোতলটা নিজে হাতেই টেনে নিয়ে
বলে ওঠে, কাউকে দিতে হবে না, সোজা আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমরা এত চাপের কাজ করি,
এসব একটু-আধটু না খেলে হবে! আপনাকেও আসতে হবে না, আমিই আপনার কাছে লোক পাঠিয়ে দেব,
এসব বোতল-টোতল পেলেই তার হাতে দিয়ে দেবেন।
গালকাটার কথা অনুযায়ী প্রথম চালটা লেগে গিয়েছে দেখে, এবার
কায়দা কোরে পরের কথাগুলোও বলে ফেলে খাঁদু মোড়ল। যখন ঘর থেকে বেরোতে যাবে, বড়বাবু চেয়ার
থেকে উঠে এসে খাঁদু মোড়লের হাতটা ধরে একবার ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেছে, কোনো চিন্তা নেই মোড়লবাবু,
ভোটে যাতে আপনিই জেতেন তার সব রকম সাহায্য আমরা করবো। কথাটা শেষ করেই বড়বাবু এ কথাও জুড়ে দেয়, আপনার কথামতো
দিনদুয়েকের মধ্যেই দেখবেন পালপাড়ার বাইরের লোকেদের সব গলতায় ফেলে দেবো। প্রার্থী ছোকড়া
নিজেও হয় ঘরে দরজা বন্ধ কোরে বসে থাকবে, নাহয় এ গাঁ ছেড়ে পালাবে। আপনি নিশ্চিত থাকুন।
পালপাড়ার সব ভোট আপনার ছবিতেই লটকে থাকবে। ঠিক আছে, আমি একটু বেরোব। আর শুনুন, কাল
আমার লোককে একবার পাঠিয়ে দেব, দেখবেন যদি কেউ আবার ওই বোতল-টোতল উপহার দেয় তার হাত
দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। পাঠাব নাকি?
-- কালকেই! ঠিক আছে, ভোটের বাজার, কিছুই বলা যায় না। দেবেন,
পাঠিয়ে দেবেন।
খাঁদু মোড়ল থানা থেকে বেরোতে বেরোতেই মনে মনে ভাবে গালকাটা লোকটা খুনী হোক, ডাকাত হোক যাই হোক না কেন, তার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারা যাবে না। লোকচরিত্র সম্বন্ধে তার ধারণা প্রায় একশ শতাংশ সঠিক। তার সেই ট্রলি বাহন সুদামা এতক্ষণ পুলিশ ফাঁড়ির পাশেই ট্রলি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো, চেপে বসে বাড়ির দিকে এগোতে এগোতেই সুদামাকে বলে দিলো, সকাল সকাল এসে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়ে বড় এক বোতল বিলিতি মদ এনে দিবি তো, একজনকে ভেট দিতে হবে। সুদামা বললো, ঠিক আছে। সুদামা এও বললো, এই ফাঁড়ির বড়বাবু খুব মদ খায়, আমি জানি। মোড়ল তাকে আর বেশি ঘাঁটালো না। পরদিন সুদামা এসে টাকা নিয়ে গিয়ে মদের বোতল এনে দিলো। বেলা বাড়তে গালকাটা এলো, থানাবাবুর সাথে খাঁদু মোড়লের কি কি কথা হয়েছে, খুঁটিনাটি সব বিস্তারিত শুনে বললো, তুমি লিখে রেখে দাও, ভোটে তুমি জিতে গিয়েছো। থানা যদি তোমার সঙ্গে থাকে, আমাদের তবে শক্তি তিনগুণ বেড়ে যাবে। কাউকে আর ভিড়তে দেব না আমাদের এই গাঁ-গঞ্জে।
বিকেলের দিকে খ্যাংড়াকাটিং এক খোচর গোছের লোক সাইকেল চালিয়ে
এসে খাঁদু মোড়লের সঙ্গে দেখা করে বললো, থানার বড়বাবু পাঠিয়ে দিলেন। বাবু বললেন, আপনার
কাছে দেবার মত কিছু থাকলে, দিয়ে দিতে। খাঁদু মোড়ল বেশি আর কোন কথা না বলে মদের বোতলটা
ভেতর থেকে নিয়ে এসে সেই খোচরের হাতে দিয়ে শুধু বললো, তোমার ব্যাগে ঢুকিয়ে এটা নিয়ে
যাও, কেউ দেখলে আমার কিম্বা তোমার বাবুর বদনাম হবে। সেই লোকটাও সাইকেল থেকে বাজারের
ব্যাগের মত একটা থলি এনে বোতলটা তাতে ঢুকিয়ে ফেললো। খাঁদুবাবু শুধু বললো, কালকেও একবার
এসে খবর নিয়ে যেও, যদি কিছু পাই দিয়ে দেব। লোকটা চলে যেতেই মোড়ল হিসেব কষে নিলো ভোটের
ফল বেরোনোর আগে পর্যন্ত প্রতিদিনের এই থানা খরচটাও তার ভোটের খরচ হিসেবেই যুক্ত হবে।
(৩)
খাঁদু মোড়ল পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বড়বাবুর সঙ্গে আলোচনা কোরে ফিরে আসবার দিন তিনেক পরে একদিন সকালবেলা বাইরে অনেক মানুষের ছোটাছুটি হৈচৈ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যেতেই বাইরে এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, পালপাড়ার কাছে একশ দুশো ডাকাত আমাদের গাঁয়ে ডাকাতির জন্যে নাকি জড়ো হয়ে পাটক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে ছিলো। ফাঁড়ির পুলিশ সে খবর জানতে পেরেই জেলা সদরে তাদের বড়বাবুদের সব জানায়, তারপর জেলা থেকে দু-তিন গাড়ি পুলিশ এসে নাকি পুরো পা্লপাড়া সহ আশপাশের পাটক্ষেত টাতক্ষেতও পুলিশ ঘিরে ফেলে। পুলিশ আসার খবর পেয়ে নাকি আশপাশ পাড়া থেকেও প্রচুর লোক এসে জুটে যায় আর পুলিশ আসবার খবর পেয়েই সেই ডাকাতেরা নাকি পুলিশের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকে, পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। তাতে নাকি জনা আষ্টেক ডাকাত ওখানে সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। গাঁয়ের মানুষের হাতে ধরা পড়ে আরও জনা পনেরো ডাকাত মারধোর খেয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলো, পুলিশ তাদের তুলে হাসপাতালে দিয়ে এসেছে। আর বাকি ডাকাতদের অস্ত্রশস্ত্র সমেত ধরে পুলিশের গাড়িতে তুলে সদরে নিয়ে গিয়েছে। মাঝরাতে এসব হয়েছে, সকালে খবর ছড়িয়ে পড়তেই গাঁয়ের লোক ভীড় কোরে হামলে পড়েছে পালপাড়ার দিকে। একজন বললো, এইমাত্র দেখে এলাম, মাঠের মধ্যে এখনও চাপ চাপ রক্ত পড়ে আছে।
এসব শুনে খাঁদু মোড়ল ঘরে ঢুকে যায়, কারণ তার যা জানবার
জানা হয়ে গেছে। ফাঁড়ির বড়বাবু তার কথা রেখেছে। তবুও মনের মধ্যে একটু খিচখিচ লেগে থাকে--
খালি মনে হয়, ভোটে জেতার জন্য এত মানুষের লাশ দরকার হয় কেন? অঙ্কটা খাঁদু মোড়ল মেলাতে
পারে না।
যাই হোক বেলা একটু তেতে উঠতেই হাসিহাসি মুখ নিয়ে গালকাটা
এসে মোড়লকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে পুনর্বার পালপাড়ায় মাঝরাতে পুলিশের অপারেশনের
খুঁটিনাটি জানিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে আরও একটা নতুন কথা শুনিয়ে দেয়। পালপাড়া থেকে অন্য
রঙের প্রার্থী যে ছেলেটি ভোটে দাঁড়িয়েছিলো, ফাঁড়ির বড়বাবু তাকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।
কারণ সে তার বাড়ীতে সশস্ত্র কিছু বাইরের লোককে আশ্রয় দিয়েছিলো। কিন্তু ফাঁড়িতে গিয়েই
বড়বাবুর হাতেপায়ে ধরে সে অনেক কান্নাকাটি কোরে থানাবাবুকে লিখে দিয়েছে সে আর কখনও ভোটে
দাঁড়াবে না, এবারের ভোটেও সে আর গ্রামে থাকবে না। থানাবাবুও তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে
আজকেই সে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে, ভোটের আগে বা পরে সে এ গ্রামের ধারেকাছেও আর ভিড়বে না।
কথামতো আজ ভোর ভোরেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। গালকাটা হাসতে
হাসতে বলে, এবার কিছু টাকা ছাড়ো তো সবাই মিলে একটু ফুর্তি করতে হবে।
বিকেলের দিকে তার সেই রঙ পার্টির নেতা এসে, আবারও লাখ
দশেক টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে যায়, আর বলে, কাল বিকেলে গাঁয়ের খেলা-মেলার মাঠে একটা
মিটিঙ ডাকতে হবে, সেখানে তার রঙ পার্টির নেতারা এসে খাঁদু মোড়লকে মঞ্চে বসিয়ে মিটিঙ
করবে। মাইক শহর থেকে ভাড়া কোরে নিয়ে এসে, একটা রিক্সায় বেঁধে গোটা গ্রামের রাস্তায়
সেই মিটিঙের কথা চাউড় কোরে দিতে হবে। নেতার কথা মতোই গালকাটা তার লোকজনকে কাজে লাগিয়ে
সেই মিটিঙের আয়োজন করলো আর নেতারা দেখে অবাক হয়ে গেলো যে, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্দিষ্ট
সময়ের অনেক আগেই এসে মাঠ কাণায় কাণায় ভরিয়ে দিয়েছে। খাঁদু মোড়লের রঙ পার্টির নেতারা
মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রায় সবাই একবাক্যে বলে গেলো, ভগবান এ গ্রামের মানুষদের খুবই ভালোবাসে্ন
বলেই খাঁদু মোড়লের মতো এমন একজন মানুষকে এ গাঁয়ের লোকেরা মোড়ল হিসেব পেয়েছে। ভগবানই
মোড়ল বানিয়ে তাকে এ গ্রামে পাঠিয়েছে। সুতরাং সবাই যেন খাঁদু মোড়লকেই ভোট দিয়ে গ্রামের
প্রধান বানাবার চেষ্টা করে। মাঠ উপচে পড়া মানুষেরা একযোগে তীব্র জোরে হাততালি দিয়ে
নেতাদের কথায় তাদের সম্মতি জানিয়ে দিয়ে যায়।
(৪)
এর পরের কাহিনী খুবই সংক্ষিপ্ত। গোটা গ্রামজুড়ে খাঁদু মোড়লের রঙ পার্টি ভোটের আগে মোট চারটি মিটিঙ করে, মিছিলও হয় চারটি। সে এক বর্ণময় ধামাকা। যেমন খরচা তেমন চোখধাঁধানো চটকা। ফুলের পাঁপড়িতে ঢেকে যায় খাঁদু মোড়লের মুখ। রঙ পার্টির নেতাদের সবার গলাতেই একবিশেষ রঙের চাদর, কপালে লম্বা টিপ। নাচ গান মাইক ফাটিয়ে দেশ বাঁচানোর গরম চিৎকারে আকাশ বাতাস ঝমঝম করে। পুরো খোলা ময়দান খাঁদু মোড়লের। তার বিরুদ্ধে যারা নাম জমা দিয়ে ভোটে দাঁড়াতে গিয়েছিলো, তাদের একজন মানে হাবলা জোতদার সেদিনের পরে সেই যে দরজা-জানালা বন্ধ কোরে ঘরে ঢুকে বসে আছে, বাড়ির লোকজনকে বলে দিয়েছে, ভোট পেরিয়ে গেলে তবে বাইরে বেরোবে। তার ধানজমি, গরুবাছুর, ধানকল চালকল, পুকুরের মাছ-- সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব বাড়ীর অন্য লোকেদের। আর দ্বিতীয় জন অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রার্থী তো ডাকাত ধরার রাত পেরিয়েই ধাঁ হয়ে গেছে। সুতরাং ফাঁকা মাঠে খাঁদু মোড়ল তার রঙপার্টির নেতা আর গালকাটাদের টিমের হয়ে একাই যে ১০০ গোল দেবে সেটা নিশ্চিত হলেও কেউ বসে নেই, গালকাটাদের সাগরেদরা এলাকা ভাগ কোরে নিয়ে গাঁয়ের প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিটি ভোটারকে বুঝিয়ে এসেছে এ গাঁয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তিতে বেঁচে থাকতে হলে খাঁদু মোড়লের নামেই যেন ভোট পড়ে। নাহলে বাড়িঘর ফেলে রেখে অন্য গাঁয়ে গিয়ে ঘর ছাইতে হবে। আর এসবের সাথেই হাতে হাতে কয়েকটা কড়কড়ে ব্যাঙ্কনোট ভোট দিতে যাবার খরচ-খরচা হিসেবে ভোটারদের হাত টেনে নিয়ে গুঁজে দিয়ে আসে।
ভোটের দিন চকচকে সকাল থেকেই বুথে বুথে লম্বা লাইন। সাগরেদরাই
পুলিশকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে নিজেরাই লাইন ম্যানেজ কোরে সবাইকে ভোটের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
ঘরের ভেতর একজনই মাত্র খাঁদু মোড়লের এজেন্ট। কোথাও গালকাটা, কোথাও ব্যাঁকা থোবড়া, কোথাও
গজু খাজা, কোথাও হেঁসোমোল্লা ইত্যাদী। ঠান্ডা ছুরির মতো চোখা চোখ নিয়ে ক্রিমিন্যালগুলোর
একেকজন একেকটা বুথের ভেতর মোড়লের ভোটের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে, যাদের দেখলেই গাঁয়ের
মানুষের হাড় ঠান্ডা হয়ে যায়। আর বাইরে ত্যাড়া, ন্যাড়া, ক্যাওড়া সাগরেদরা।
নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ভোট প্রায় ১০০ শতাংশ বাক্সে ঢুকে
গেলো। টাকা এবং পেশী নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মহান উৎসবে ভোট গণনার ফল বেরোলে দেখা গেলো
ভোটবাক্সে যত ভোট ঢুকেছে তার ১০০ শতাংশ ভোটই পেয়েছে খাঁদু মোড়ল। হাবলা মোড়লের বাড়ির
সবভোটই যেমন খাঁদু মোড়লের খোদলে ঢুকেছে, তেমনই পালপাড়ার ছোকড়া প্রার্থীর বাড়ীর ভোটগুলোও।
আর খাঁদুমোড়লের রঙপার্টীর সেই নেতা, বিরাট এক বাঁশের ডগায় বিরাট এক রঙ-পতাকা গুঁজে
গোটা গ্রামের মাঝখানে এসে মাটি খুঁড়ে সেই পতাকা টাঙিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে মাইক ছাড়াই
চেঁচিয়ে উঠলেন, "খাঁদু মোড়লের এই জয়, গণতন্ত্রের জয়", আজ থেকে এ গ্রামের
সবাই আমাদের এই রঙপার্টির লোক বলেই পরিচিত হবে। চারিদিকে আমাদের একটাই দেশ, এই গ্রামটিও
আমাদের রঙপার্টির গ্রাম।... ধাঁইধাঁই তালে ঢাক-কাঁসি, ডগর-কড়ার তালে নাচতে নাচতে, সবাই
কাঁধ থেকে কাঁধ পাল্টাতে পাল্টাতে খাঁদুমোড়লকে টেনে নিয়ে চললো গ্রামের পথে পথে। আর
এসবের ফাঁকে ফাঁকেই, শুধু একবার নিজের ঘরে ফিরে যাবার জন্য খাঁদু মোড়লের মন কেমন ছটফট
করতে থাকে...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন