ধারাবাহিক
উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৪১)
মামপি বুঝল বাবুলও ঘেঁটে আছে, একটু-আধটু নয় আপাদমস্তক। বারদুই তার ফোন কেটে দিল বাবুল, হয়ত তার নম্বর বাবুলের কাছে ছিল না। আগে হলে অপমানবোধ হত শ্রুতির। এবার মজা লাগল। আবার ফোন করল। অচেনা ফোন বারবার উত্যক্ত করলে যেমন বিরক্ত হয় লোকে, তেমনই কড়কড়ে গলায় বাবুল বলে,
“হর্ষ্ স্পিকিং হিয়ার!”
“মামপি হিয়ার! মে আই টক টু মিস্টার হর্ষ্ ফর আ
হোয়াইল?”
হর্ষ নামটায় বাঙালি
বাদে অন্য প্রদেশীয়রা হসন্ত্ দেয়। হাসি চেপে সেভাবে সে জিজ্ঞেস করেছিল। বাবুল এবারে
বুঝল। খানিক অপ্রস্তুত ও দ্বিধান্বিত স্বরে বলল,
“ও তুই! এখন কোথায় আছিস?”
“হায়দরাবাদেই”।
“গুড! সেম কম্পানি? না বদলেছিস?”
“সেম। তুই?”
টুকটাক, ছোটখাট অতি
সাধারণ প্রশ্নোত্তর। মিনিটকয়েক পরে বাবুল ঈষৎ অধৈর্যভাবে বলল,
“আজ রাখি রে, কাজ আছে।”
মামপিও রেখে দিতে পারত
আগের দিনের মতো। রাখল না, উলটে ছোট্ট একটা তথ্য দিল,
“জানিস ফার্স্ট–টাইম যখন এখানে এলাম, সাম্ অদিতি আমার
রুমমেট ছিল।”
“কী?”
প্রশ্নটা করে চুপ হয়ে
ছিল বাবুল—বেশ কিছুক্ষণ। মামপি ফোনটা দেখল, না কেটে দেয়নি।
বাবুল বলল,
“অদিতি? কে সে? তুই চিনিস কী করে?”
“চিনব কী করে? তুই তো কথাই বলিস না আমার সঙ্গে।
কবে যেন তোকে ফোন করেছিলাম তুই অদিতি ভেবেছিলি—, মনে আছে?”
“হুঁ। বাট্, অদিতি কি ওই একজন নাকি?”
“মোটেই না। ইন ফ্যাক্ট আমি জানিও না সে-ই কিনা।
কিন্তু দিল্লীর মেয়ে বলে ভাবলাম, হলেও হতে পারে। অদিতি শর্মা! পুনে থেকে এখানে এসেছিল,
বাড়ি দিল্লীতে। পঞ্জাবী।”
ফোন নীরব অনেকক্ষণ—কে জানে কী ভাবছে বাবুল। মামপিও সময় দিচ্ছে। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল বাবুল,
“দেখতে কেমন ছিল?”
“একদম বিচ্ছিরি! আমার মতো—!”
“ও!”
“না রে বাবুল, খুব ফর্সা, দারুণ চুল আর ফিগার। তবে—,”
“উঁ?”
“কেমন পেইল, স্যাড ফেস। মাসদেড়েক ছিলাম একরুমে।
ভীষণই সফট স্পোকেন, ডিসেন্ট মেয়ে।”
“তারপর কী হল?”
“চলে গেল। বাবা বা ওই এজ্-এর কে জানিনা, এসে নিয়ে
গেলেন।”
“হুঁ।”
ফোন কাটেনি বাবুল। নিঃশব্দে
কী ভাবছিল কে জানে। সামনে বসে থাকলে মামপি বুঝতে পারত। ভয়-ভয় করছিল তার, ঠিক হল বলাটা?
রেখে দেবে ভাবছিল প্রায়, মিনিটতিনেক পরে কথা ভেসে এল,
“তোর খবর কী?”
“আছে কিছু। শেয়ার করব বলে কল্ করেছি। অবশ্য যদি
তোর টাইম হয়—।”
“আচ্ছা। ও কিছু জানিয়েছিল তোকে?”
“নাঃ। খুব চাপা, ইন্ট্রোভার্ট। একটা কথা জিজ্ঞেস
করব?”
“হুঁ!”
“তোদের কি কোনও কারণে ব্রেক্-আপ হয়ে গেছে?”
“ব্রেক-আপ? রিলেশনশিপ তৈরি করেই উঠতে পারলাম না।
আমি শালা একটা গাণ্ডূ—!”
“অ্যাই মুখ খারাপ করিস না! মাসিমণিকে বললি না কেন?”
“সব বলেছি ইন্ ডিটেইল, সব জানে মা। কিন্তু ততদিনে—!”
“বিয়ে হয়ে গেছে?”
“ইয়েস!”
মামপি সান্ত্বনা দেবে
ভাবে। খারাপ লাগে খুব, না জেনে আলগা খোঁচা দেওয়া ঠিক হয়নি। অবস্থা সামলে নিতে একটু
হেসে বলে,
“ফরগেট ইট্, স্টে হ্যাপ্পি। মুভ অন করে যা। না
অলরেডি ডান্?”
“আগে তোরটা শুনি। রিলেশনশিপে ফেঁসেছিস? বাড়িতে মত
দিচ্ছে না?”
“না রে ভাই, তা নয়! অ্যাকচুয়্যালি কী যে হচ্ছে,
ভেবে পাচ্ছি না।”
মামপি ভাঙে একটু একটু
করে, গোড়া থেকে বলতে থাকে। কত যে কথা বলার আছে! গোটানো সুতোর রীল থেকে সুতো খুলে বেরিয়ে
আসার মতো অবিশ্রাম বলে যায় সে। বাবুল শোনে, একটুও অধৈর্য হয়না। ছোটো-ছোটো মন্তব্য করে
দু-একটা। একএকবার শ্লেষ্মার মতো আবেগ এসে স্বররোধ করে, মামপি থেমে যায়। গলা ঝেড়ে পরিষ্কার
করে, চুপ করে থাকে। বাবুল পিঠে চাপড়ের মতো নরম করে বলে,
“চিল্ চিল্! টেক ইয়োর টাইম। ডিড্ ইউ হ্যাভ এনি—আই মিন্ ওয়্যার ইউ ফিজিক্যাল? বলতে পারিস—!”
মামপি বোঝে বাবুল আগের
চেয়ে অনেক বদলেছে, অনেক পরিণত। তাই যা ঘটেছে, যতটা ঘটেছে নির্দ্বিধায় খুলে বলে ফেলে,
লুকোয় না। হয়ত মুখ দেখা যাচ্ছে না বলেই অস্বস্তি হয়না।
ঘন্টাখানেক পরে ফোন
কেটে যায়। দু-তিন মিনিট পরে বাবুল নিজে থেকে ফোন করে,
“আছিস?”
“বল। তোর কথা—শোনা।”
“ইউ আর ইন লভ! বী ট্রু টু ইয়োরসেলফ মামপি।”
“ইজ্ ইট্?”
“ডোন্ট বী লেট। অদিতি—বুঝিয়ে গেছে—আমাকে।”
ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমেছে। জানালার পর্দা একটু সরিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে শ্রুতি। কেমন যেন লাগছে—ভেজা ঠাণ্ডা বাতাস খেলে যাচ্ছে মনের মধ্যে। সেদিন বাবুলের সঙ্গে বকবক করে সারা দুপুর কেটেছে। দু-জনেরই এতবছরের যা জমা ছিল, পুরো উসুল হয়ে গেছে। একা-একা হাসে সে। বাবুলের অবস্থা তার চেয়েও গোলমেলে। অদিতি-শাম্ভবী-ঊর্বী! শাম্ভবীর প্রতি আকর্ষণ নেই বলছে বাবুল। অথচ কতবার বলল, ‘রিয়েল্লি প্রিটি!’ সৌন্দর্য থাকলে আকর্ষণ থাকবে না, শ্রুতি বিশ্বাস করে না। ঊর্বীর কথা বাড়িতে জানাবে বলল বাবুল।
‘ও বয়সে অনেক ছোটো, বাট্ ভেরি কিউট এন্ স্মার্ট।
মা-র ভালো লাগবে।’
মা-র ভালো লাগবে বলে
ঊর্বীকে বিয়ে করতে রাজি! বাবুলটা একটা গাধা। চিত হয়ে শুয়ে পড়ে শ্রুতি। জীবন যদি সিনেমার মিষ্টি-মিষ্টি লভ স্টোরি হত? দেবার্ঘ্য
এসে নতজানু হয়ে প্রপোজ করত আঙটি আর ফুলের তোড়া দিয়ে? আর সে শৈশবপাঠ সিণ্ডারেলার মতো
চটি ফেলে পালিয়ে আসত? এক অর্থে পালিয়ে তো আছেই। ধৈর্যের পরীক্ষা দিক ছেলেটা।
সে আর বাবুল দু-জনের
বেশ মিল একজায়গায়—অতিরিক্ত ইমোশন্যাল! সেন্টিমেন্টাল!
আকছার সম্পর্ক ভাঙে-গড়ে আজকাল। এক-দুই-তিন-চারজন এক্স-বয়ফ্রেণ্ড বা গার্লফ্রেণ্ড তার
বন্ধু বা সহকর্মীদের অনেকেরই। দু-তিনবছর লিভ-ইন-এর পর আলাদা হওয়ার ঘটনা কম নয়। তারপর
হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়।
অথবা বাইরে থেকে যা
দেখা যায় তা আংশিকমাত্র? আসলে এখনও অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে তার বা বাবুলের মতো—পুরোনোপন্থী। ভাঙতে ভয় পায়, ছিঁড়তে যন্ত্রণা হয়। না হলে দেবার্ঘ্যর
সঙ্গে তার এত কিছুও ঘটেনি যে তাকে বারণ করে দিতে ভেতরটা এরকম কুঁকড়ে যেতে পারে।
মামপি দেবিকার কথা ভাবে।
প্রবল বেপরোয়া ছিল ওই অপরিণত বয়সেই, তার চেয়ে ঢের বেশী। যা ইচ্ছে তাই করেছে। বরং কৌশিক
বেশ ভীতু মানুষ। না হলে কী হত, দেবিকা কী করত? তাকে একা আনার সাহস ছিল দেবিকার? হঠাৎ
সে ভাবে, মা-বাবা কি সত্যি প্রেমে পড়েছিল? পরস্পরকে ভালোবাসত? কোনওদিন মা-কে একথা জিজ্ঞেস
করে উঠতে পারবে না।
শ্রুতি নিজের হাতের
পাতা দেখে। লালচে রঙে আঁকাবাঁকা নানান রেখা ফুটে আছে। উলটোদিক ঘুরিয়ে দেখে। শ্যামবর্ণ
সে, যথেষ্ট কালো। লম্বা লম্বা আঙুল দেখে। এই আঙুলে ছবি আঁকা হয়। দু-তিনবার একজিবিশনও
করেছে মনে পড়ে। আশ্চর্য, এখানে আসার পর থেকে একটা স্কেচ অবধি করা হয়নি। বুকের মধ্যেটায়
তোলপাড় হয়। কলকাতায় গিয়ে মেশোর আঁকা দেখে এসেছে। কী জীবন্ত ছবিগুলো! নিপুণ হাতের নির্ভুল
নিখুঁত আঁকা নয়, কিন্তু—! মামপির গায়ে আবার কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বাবুলকে এই নিয়ে কিচ্ছু বলা হয়নি সেদিন। মেসোর অসুস্থ অবস্থার কতটা বাবুল জেনেছে জিজ্ঞেস
করা হয়নি। মামপি বিছানা ছেড়ে ওঠে। একটা ইলেকট্রিক কেটল আর গ্রিন-টীর ব্যাগ এনে রেখেছে।
টী পয়েন্টে যেতে ইচ্ছে না করলে রুমে বানিয়ে নেয়। চায়ের জল চাপিয়ে কাবার্ড খুলে খাতা
আর রঙ বের করে টেবিলে রাখে। পর্দা সরিয়ে দেয় ভালো করে। জোরে বৃষ্টি নেমেছে—গাড়ির আলো ক্যালাইডোস্কোপএর মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির জলে।
সে মোবাইল-এ হোয়াটস-অ্যাপ-এ
বাংলা মেসেজ করে,
‘অর্ঘ্য আই নো ইউ আর ইন অফিস। আমার ওয়ার্ক ফ্রম
হোম ছিল। আজ পেইন্টিং নিয়ে বসলাম কতমাস পরে।’
‘শেষ করে পাঠিয়ো।’
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন