কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


শাশ্বত

ল্যাপটপটা খোলা। কোঁচকানো সাদা বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা একটা ছয় ফুটের শরীর। কড়াপড়া আঙুলে আধ খাওয়া সিগারেট। সিলিংএর দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ জোড়ায় ভাঙাচোরা মুখের ছবি। পেলব মুখটা মনে পড়ে না আর। যেন জ্ঞান হওয়া থেকেই ওই ভেঙে যাওয়া মুখটাই দেখে যাচ্ছে। মধ্যরাতের এই ঘর গিলে খেতে আসে।

সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে পর্দা সরানো ব্যালকনিতে চোখ রাখে। তেরোতলা থেকে আকাশ অনেক কাছে। আজ মেঘ নেই। তারাদের মিছিল। আশ্চর্য! আকাশের মাঝে ভাঙাচোরা মুখটা হাসছে। চাঁদের জ্যোৎস্নার মতো।

আধখাওয়া সিগারেট আ্যশট্রেতে গুঁজে ল্যাপটপ বন্ধ করে ছয় ফুটের সুঠাম শরীর ওঠে। পাশের টেবিলে রাখা বোতল থেকে জল খায়। মনে পড়ে, রাতের খাবার খায়নি সে। ফ্রিজ খুলে দ্যাখে, আঢাকা পায়েসের বাটিটায় খানিকটা পায়েস রয়েছে। বাটিটা বের করে, একটা চামচ নিয়ে ব্যালকনিতে যায়। গোটা শহর ঘুমিয়ে? না কী তার মতোই জেগে অনেকেই?

'মাঝরাতে পায়েস খাস না'

'কেন?'

'হজম হবে না'

' ছাড়ো, এখন রাত আর দিনের কোনো তফাৎ নেই'

'আছে। আলো আর অন্ধকারের মতোই আছে। তোরা মানতে চাস না। সেটা আলাদা ব্যাপার। '

'মানতে চাই না নয়। মানতে পারি না'

'তর্কটা বাবার থেকেই শিখেছিস'

'কেউ কারুর থেকে কিছু শেখে না। পরিস্থিতি শিখিয়ে নেয়'

'বাবাকে আজও সম্মান দিতে জানলি না'

'ভুল ধারণা। তোমার মতো অন্ধ আবেগটা নেই'

পায়েসটা শেষ হলো। আকাশের গায়ে পেলব মুখটায় কি মিটিমিটি হাসি? আবেগ মেরে ফেলা ছয় ফুটের শরীরটা এবার ব্যালকনির চেয়ারে বসে। বাটিটা রাখতে গিয়ে দেখে টগর গাছে ফুল ফুটেছে। জল কে দয়! বীণাদি! বীণাদি আজ আসেনি। মনে পড়ল হঠাৎ। রাতের খাবার আসলে ছিলই না কিছু।

পায়েসটা গত সপ্তাহের। বসিরহাট গিয়েছিল দিন সাতেক হলো। চলে আসার সময় খানিক এসে পিছন ফিরতে বাড়ির গেটে ভাঙাচোরা মুখের ছবি। অশরীরীর মতো। কেমন ছলাৎ করে উঠেছিল ছয়ফুট শরীরের বুক। আবেগ হাত বুলিয়েছিল নরম ছোঁয়ায়। ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে সিগারেট ধরিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেছিল। স্পীড সেদিন একশো কুড়ির ওপর। স্পীড, স্পীড, স্পীড, জীবনের মূলমন্ত্র।

চেয়ার ছেড়ে উঠল এবার দীর্ঘ শরীর। অনর্গল স্পীডে কাজ শেষ করতে হবে। এই প্রজেক্ট শেষ করলে তবে দুদিনের ছুটি।

ফোন বাজছে।

'শাশ্বত?'

'হ্যাঁ। আমাকেই তো ফোন করেছ'

'সকালে চলে এসো বসিরহাট'

'আমি দিন দুয়েক বাদে যেতে পারব'

'ঠিক আছে, তাহলে মায়ের শেষ যাত্রায় সঙ্গে থাকতে পারবে না। রাখি'

বাবার আবেগহীন গলার স্বরে কুঁকড়ে গেল শাশ্বতর ছয়ফুট শরীর।

ল্যাপটপ বন্ধ করে ধীরে। পায়েসের বাটিটা ধীরে ধীরে জল দিয়ে ধুয়ে উপুড় করে। গাড়ির চাবিটা নেয়। ধীরে সুস্থে দরজায় লক করে। গাড়ি বের করে খুব ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকার ভেদ করে চলতে থাকে। ভোরের আলোয় পৌঁছে যাবে ভাঙাচোরা মুখের কাছে। দুদিন ধরে যে মুখের দুটি চোখ হাসপাতালে খুঁজেছে তাকে।

যে মুখ বারবার বলেছে, 'ধীরে চল ধীরে। আবেগ আর আনন্দ নিয়ে ধীরেসুস্থে দিন কাটা। রাতে তবে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন আসবে'

শাশ্বত ধীরে অস্ফুটে ডাকে, 'মা'

ভাঙাচোরা মুখটা পেলব হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন