কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(১০)

আগ্নেয় কিছুদিন ধরেই হৃদয়ের কাছে নানা ছুতোয় মেহুলীর কথা তুলত। তার নানা গুণের কথা বলত। তার শরীরটি যে অসাধারণ সে কথাও বিশদভাবে জানাত। শুধু হৃদয়কে নয়, বন্ধুদের সবাইকেই। এতে কেন জানি বিশ্রুত বিশেষভাবে বিচলিত হয়ে পড়ত। কারণটা পরে সে বলেছিল হৃদয়কে।

হৃদয় শুধু বলেছিল, কিন্তু ওর সঙ্গে তো নির্মাল্যের...

ওসব কবে চুকেবুকে গেছে। তাছাড়া নির্মাল্য একটু বেশী রটিয়েছিল।

হৃদয়ের মনে পড়ছিল কিছুদিন আগের একটা ঘটনা। নির্মাল্য বিদেশ যাওয়ার আগে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে একদিন ওর কাছে এসেছিল। নির্মাল্য এনেছিল মেহুলীকে। মেহুলী সমিধাকে। যদিও ফুল নিয়ে মেহুলীর মধ্যে কোনো উৎসাহ ছিল না। পাকেচক্রে সে জুটে গেছিল।

নির্মাল্যর মুখটা সেদিন ছায়ায় ঢাকা। হৃদয়কে বলল, তুই জানিস আগ্নেয় কী করেছে?

কী করেছে?

তাহলে সবটা শোন। কী করিনি আমি আগ্নেয়র জন্য! সেই ছোটোবেলা থেকে হাজার হাজার টাকা ধার দিয়েছি, এক পয়সা শোধ দেবে না জেনেও। যখন যা চেয়েছে, বই ক্যাসেট, সিডি পেইন্টিং দিয়ে দিয়েছি, ফেরত পাবো না জেনেও। যতরকমের ফুল চেয়েছে যেখান থেকে পারি এনে দিয়েছি। দিনের পর দিন বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে খাইয়েছি, গাড়ি ভাড়া দিয়েছি, যতরকমভাবে পারে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে গেছে। মেহুলীকে আমি ভালোবাসি সেই ছোটোবেলা থেকেই, ও সবই জানত। মেহুলীকে ও নাকি বলেছে, এসবই ও করেছে শুধু মেহুলীর জন্য, মেহুলী কাছাকাছি আসতে চেয়েছে বলেই। আমি কোনো ব্যাপারই নই। আমাকে ও ঠকিয়েছে। আর মেহুলীকে...

হৃদয় চুপ করে থাকে। কী বলবে সে? তবু জানতে চাইল, মেহুলী কী বলছে...

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ওকে। খুব রহস্যময় আচরণ করছে ও। আগ্নেয়কে নিয়ে ওর খুব উৎসাহ। আমাকে নিয়ে নাকি বোর হয়ে গেছে।

হৃদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আগ্নেয় ঠিক এটাই চাইছিল। মেহুলীর ব্যাপারে সে হৃদয়ের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। এবারে আসল প্রস্তাবটি দেওয়া যেতেই পারে। সে বলল, তোর মা তো কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছেন। আমি মেহুলীকে নিয়ে এলে তোর ঘরটা একটু ব্যবহার করতে দিবি?

হৃদয় রাজি হয়ে গেছিল। আগ্নেয় সেই কয়েকটা দিন মেহুলীকে নিয়ে রোজই আসত। বেশ কিছুটা সময় ওরা একসঙ্গে কাটাত। ঢোকার বা বেরোনোর সময় মেহুলীকে খুব নির্বিকার দেখাত। যেন যান্ত্রিক, অনুভূতিহীন এক মানুষ। হৃদর ওকে নানারকম প্রশ্ন করত। মেহুলী কথা প্রায় বলতই না। শুধু অল্প অল্প হেসে এড়িয়ে যেত। যেন যে কাজটি করতে এসেছে, সেটা ছাড়া অন্য কিছুতেই তার কোনও আগ্রহ নেই। উষ্ণতার নিতান্তই অভাব ওর মধ্যে। তখনও হৃদয় বুঝতে পারে নি, মেহুলী যা করছে, আগ্নেয়র পরামর্শেই করছে। এই চুপ থাকাটা ওর নিজের ইচ্ছেয় নয়।

হৃদয়ের মা ফিরে এলে ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে যায়।

কয়েক মাস পরে আবারও একই প্রস্তাব নিয়ে এল আগ্নেয়। তবে এবার আর মেহুলী নয়, মেয়েটির নাম উপমা। মেয়েটি নাকি বিহানের দুঃসম্পর্কের বোন।

হৃদয় খুব অবাক হয়ে বলল, কিন্তু মেহুলী কোথায় গেল?

রোজ সেই একটাই মেয়ে। একই শরীর। একই কথা। ওঃ কী ভয়ানক একঘেয়ে!

কিন্তু মেহুলী তোর জনন্যই নির্মাল্যের কাছ থেকে সরে গেছে। এখনও সময় আছে, চেষ্টা করে দেখ, ঠিক পারবি...

না রে আর হয় না। আমার ভেতর থেকেই আর আসছে না, জোর করে এসব ব্যাপার হয় না...

হৃদয় উপমাকেও মেনে নিল। কিন্তু সে-ও সাময়িক। কিছুদিন পর থেকে দু-জনকে আর একসঙ্গে দেখা গেল না। আগ্নেয়র এই বিচিত্র খেলাটাকে হৃদয় সমর্থন করতে পারল না। তার চোখ খুলে গেল। আগ্নেয়ও বুঝতে পেরে গেল, হৃদয়ের কাছ থেকে এব্যাপারে আর কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না!

কিন্তু এরপরও আগ্নেয় রয়ে গেল হৃদয়ের জীবনে, পরীক্ষা দিতে গিয়ে উত্তরপত্রের প্রতিটা পৃষ্ঠায় একটার পর একটা ফুলের কার্টুন এঁকে এল। অন্তত সেই রকমই রটিয়ে এল সর্বত্র। আর এই ঘটনাই ওকে সবার চোখে আবার রাতারাতি নায়ক বানিয়ে দিল। আগ্নেয়র চারপাশে ভীড় বাড়তে শুরু করেছিল। এক অদ্ভুত রহস্যময় জগতের কথা বলত আগ্নেয়। সেই জগতের কথা একমাত্র সে-ই জানত। তার কথাগুলো হৃদয়কে খুব ছুঁয়ে যেত। মহাকাশবিজ্ঞানের সঙ্গে সে অনায়াসে মিশিয়ে দিত বৌদ্ধ দর্শনকে, মার্শাল আর্টের সঙ্গে সাসপেন্স থ্রিলারকে। সত্যিই, এক বিস্ময়কর মেধার অধিকারী ছিল সে।

হৃদয় একদিন অনুতপ্ত হয়ে বলেছিল, আমি ডেকেছিলাম বলেই ও ফুলের বাগান করতে এসেছিল। আর তখন থেকেই ওর মাথা বিগরোতে শুরু করে। যা কিছু স্বাভাবিক, তাকেই ও প্রশ্ন করতে শুরু করে। আর শেষ পর্যন্ত পড়াশুনোটাই ছেড়ে দিল। নিজেকে আমার সম্পূর্ণ নির্দোষ মনে হচ্ছে না। ও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হতে পারত। সেই মেধা ওর ছিল...

সাঁঝ বলছিল, ও তোর বন্ধু সেজে থাকত। কিন্তু আসলে ছিল তোর প্রতিপক্ষ। তোকে শুধু ছাপিয়ে যেতে চাইত। নিজেকে নিয়ে নানারকম মিথ তৈরি করতে চাইত। মজার ব্যাপার হলো, ওর মেধার সবচেয়ে বড়ো সমর্থক ছিলি তুই। নানা জায়গায় ওর মেধা ও প্রতিভার কথা বলতি। সাহিত্য, বিজ্ঞান, পেইন্টিং, মিউজিক, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা এই সমস্ত নিয়ে ওর মধ্যে যে প্রবল জানার আগ্রহ তাকে নিরন্তর প্রেরণা ও উৎসাহ জোগাতি। ওর ভাবনাগুলোকে অতি যাত্নে সংরক্ষণ করতি তুই। ওর সমস্ত টুকরো কাগজ, প্রতিটি কার্টুন ফাইলে গুছিয়ে রাখতি। তোর নিজের বহু কিছু হারিয়ে গেছে, কিন্তু ওর ফাইলটাকে কখনও তুই চোখের আড়াল করতি না, ওর ব্যাপারে এতটাই যত্ন ছিল তোর! তুই ওকে প্রথম চিহ্নিত করলি আর ও তোকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করল। একদিকে তোর নিরন্তর প্রশস্তি ও যত্ন, অন্যদিকে জ্ঞানগর্ভ, মেধাবী কথার জাদু, নিজের চারদিকে একটু একটু করে তৈরি করে নিচ্ছিল একটা বৃত্ত। সে হবে এমন এক বৃত্ত, যার কেন্দ্রে থাকবে শুধু ও নিজে। তোর ফুলের বগান নিয়ে ওর কোনও মাথাব্যথা ছিল না। তোর ফুলের বাগান নিয়ে যাদের মাথাব্যথা রয়েছে তাদের ও চতুরভাবে নিজের বৃত্ত থেকে বাদ দিয়েছিল। ও মনে করত, তোর ফুলের বাগান শুধু তোর জন্যই ফুলের মুকুট আনতে পারে। সেখানে ও কখনই প্রাধান্য পাবে না, তোর প্রভাবেই ওকে থাকতে হবে। নিজেকে সবার চেয়ে উচ্চাসনে দেখার এই লোভ আর মোহই ওর পতনের কারণ। এখানে তোর কোনও ভূমিকাই নেই! তুই শুধু শুধু অনুতপ্ত হচ্ছিস কেন? ফুলের বাগানটা হয়েছিল বলেই ওর মুখোশের আড়ালে থাকা মুখটা বেরিয়ে এসেছে। ওটা ছিল একটা পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটা হয়েছিল বলেই ও যে আসলে তোর প্রতিপক্ষ, সেটা আর গোপন রাখতে পারে নি। নিজের লোভ আর মোহকে প্রকাশ করে ফেলেছিল...

হৃদয় অবাক হয়ে শুনছিল সাঁঝের কথা। পাশে বসে শ্রমণ তখন উদাস চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল।

(ক্রমশঃ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন