কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সুকান্ত দেবনাথ

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

           

দূরত্ব




 

(আট)

এমন আরও বহু কিছু অর্থবহ মনে হয়েছে আমার কাছে। কখনও কখনও আমার মা’কেও কঠোর মনে হয়েছে। হৃদয়হীন মনে হয়েছে। অর্থবহ মনে হয়েছে অনেক  ইঙ্গিত। সেই মেয়েটি যে আমাদের বাড়িতে কাপড় দিতে আসতো, যাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন আমি এক দখলি কলোনিতে পৌঁছেছিলাম, দেখেছিলাম ঠাকুমার বলা সবকটি ট্রাজেডির মতো সেও মিলে গেছে অক্ষরে অক্ষরে। সে মেয়েটি ছোট একটি ভিত নিচু ঘরের অল্প আলোর মধ্যে শুয়ে আছে। আমি নিজের পরিচয় দিতেই উঠে আসে, বলে - ও সেই ঠাকুমার বাড়ি তো! বলি - হ্যাঁ, আমি  এসেছি, অনেক দিন হল আর আপনি আসেননি, তাই মা আমাকে পাঠাল।  মেয়েটি উঠে এসে খুলে দিল ঘরের জানালার পাল্লা। দেখলাম তার গলার কাছে পোড়া দাগ। গলার চামড়া কুঁচকে মুখটাকেও নিচের দিকে টেনে রেখেছে। আর কিছু বিশেষ জিজ্ঞেস করার ছিল না আমার। সে মেয়েরও কিছুই প্রায় বলার ছিল না। আমাকে বলেছিল একটি চেয়ার দেখিয়ে ওখানে বসুন। আমি বসেছিলাম এতটাই দূরে যে শুধু কিছুটা অনুমান করা যাচ্ছিল। আমাদের কুশল জানতে চাইল, বললাম। কিন্তু আপনি কেমন আছেন তা আর জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। বসে রইলাম কিছুই না বলে। অনেক অনেক স্তব্ধতার পরে সে নিজেই বলল, আগুন লেগে গেছিল বুঝলেন, বাবার গায়ে, আমি ------

আমি ভাবলাম বলি, থাক আর কিছু জানার মতো ইচ্ছে হচ্ছে না। আর ঠাকুমার উপর রাগ হচ্ছে খুব। কেন তার সব কটি গল্প মিলে যাবে বাস্তবের সাথে! কোনো একটি গল্পে কি কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে না? কোথাও কি কোনো একটি চরিত্র খানিকটা অন্তত সামান্য ভাত কাপড়ে বাঁচতে পারে না? সবাইকেই কি  তার ট্রাজেডি নাটকের চরিত্র হতে হবে? রাগ হচ্ছিল আমার বাস্তবে ঠাকুমার  উপরে। তাঁর বার বার জিতে যাওয়া বা আমার হেরে যাওয়া নয়। এই মেয়েটির এই বাস্তবের উপরে। মনে হচ্ছিল সে যদি আমাদের বাড়ি না আসতো বা আমাদের সাথে দেখা না হত, তবে হয়তো তার আজকের এই দিন আসতো না। আমাদের সাথে দেখা হয়েই বা আমার ঠাকুমার সাথে দেখা হয়েই এ অবস্থা হয়েছে। আমরাই অপয়া খুব, যেখানেই যাই শুধু মৃতের স্তূপ রেখে যাই। পিছনে থেকে কেউ ডেকে ওঠে। তাহলে কী ভবিষ্যৎ আছে এই আধপোড়া মেয়েটির! সে তো চেয়েছিল নিজের ঘরের কিছুটা সাহারা হতে।  

কোনো কিছুই আর বলার বাকি থাকে না যখন আমি ভাবি নেমে আসার সময় এসেছে, অথচ যে ঘরের ভিতই রাস্তা থেকে নিচু সেখানে নেমে যাওয়ার জন্য কোনো জায়গাই থাকে না। তাই নিজেকে বাস্তবে সব থেকে নিচু মনে হয়। পালানোর রাস্তা খুঁজে পেতে যখন দেরি হয় তখন মানুষ সত্যি নিজের ভিতর থেকে পালানোর রাস্তা খুঁজতে শুরু করে। যা একদিক থেকে আত্মহত্যার সামিল। আর আত্মহত্যার মতো কোনো পরিকল্পনার সূত্রপাত বাস্তবে হয় তেমনই নিঃশব্দের মধ্যে। এর পরবর্তী কালে, অনেক পরে আমি যখন কস্তূরীর সাথে বাস্তবিক এই নৈঃশব্দ ভাগ করতে শুরু করেছি, তখন মনে হয়েছিল হঠাৎ করে  যেন আমি নিজের দিকে তাক করে ধরেছি বন্দুক। যদিও আমার কোনো ব্যক্তিগত দুঃখ নেই, তবু। এমন কি হতে পারে কেউ অন্যের দুঃখে দুখী হয়ে শুরু করেছে নিজেকে ক্ষয় করা।   

এখন যে মুহূর্তে আমি ভাবতে শুরু করি, আমি সাথীর সামনে সেই রাতের  অন্ধকারে বসে আছি। আর যখন আমার ভিতরে তার নিঃসঙ্গতার কথা বিষাদের অনুভূতি তৈরি করছে, সে মুহূর্তে সাথীর সাথে এই আধপোড়া মেয়েটির মুখ উঠে  আসে। যারা নিজেও এক জায়গা থেকে উঠে এসে অন্য জায়গায় নিজেদের আস্তানা বসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। দুজনেই তো নিঃসঙ্গ, সাথীর বর আমাকে তার রূপ দিয়ে চলে গেছে দূরে। সাথী দেখতে পাচ্ছে আমাকে তার বুকের সামনে,  কিন্তু জড়াতে পারছে না। আর এই মেয়েটি যার গলায় এমন পোড়াদাগ, তার সামনেও তো আমি তেমনই বসেছিলাম। সেও তো দেখছিল আমাকে দূর থেকে। বসিয়ে ছিল কিছুটা দূরে যাতে তাকে ভালো ভাবে দেখতে না পারি। এক আবছা আলো আর কিছুটা অন্ধকার। টেবিলের উপর সাথী খুলে রেখেছে প্লাস্টিকের শাঁখা পলা। অনেকটা আমার গিলোটিনের মতো মনে হচ্ছে তবু। আমি নিজেকে না সরিয়ে মাথা দিতে যেন ভালোবাসি। আমার আগের কোম্পানির এক কলিগের কথা এখানে মনে আসে। সে খুব ঝুঁকি নিতে ভালবাসত। মানে অত্যাধিক রিক্স নিয়ে কাজ করতে পারতো সে। যেখানে তেমন প্রয়োজন নেই সেখানেও সে একাই ঢুকে যেত। অফিসার অবাক, আমরা বাইরে থেকে চিন্তিত, কেউ কেউ ওকে গালাগালি দিয়ে ডেকে যাচ্ছে। সে তাও কাজ না করে বেরিয়ে আসবে না। এখন মনে হয় তার কি মৃত্যু ভয় ছিল না? না কি সে চাইতো মৃত্যু তাকে কোলে তুলে নিক? এও কি কোনো আত্মহত্যার অভিলাষ বা কোনো অ্যাকসিডেন্টের  প্রতীক্ষা করা? হয়তো কোনো একদিন, কোনোভাবে এমনই কিছু একটা বড়সড়  হবে যেখানে আমাকে সবাই দেখতে আসবে। বা আমাকে একটা লম্বা ছুটি দেবে আর আমি ঘরে যেতে পারবো, পুরনো বন্ধুদের সাথে কাটাতে পারবো পুরনো কিছু দিন। ছেলেটিকে আমি অনেক জিজ্ঞাসা করেছি, কেন সে এভাবে রিক্স নেয়। সে কিন্তু কোনো উত্তরই দিত না আমাকে, শুধু আমার চোখের থেকে দূরে তাকিয়ে থাকতো। আরও অনেক কিছু ছিল তার চরিত্রে লুকনো দিক যা আমি পরে জানতে পারি। এক নারী থেকে অন্য নারীতে চলে যাওয়া ছিল তার স্বভাব, যাকে সে অতটা গুরুত্ব না দিলেও আমার মনে হত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। যারহোক তার কথা না হয় পরে বলা যাবে।   

এখন এই মুহূর্তে আমিও কি বিষণ্ণ হয়ে পড়ছি? নিঃসঙ্গ একটি ঘরের মাঝে,  চারটি দেয়াল আর টিনের চালার মাঝে, এক আবছা অন্ধকারের মাঝে, একটি কম বয়সী বৌ আর একটি শান্ত বিছানার কথা কল্পনা করা আর লেখা। সাথী আমাকে যেন ইশারায় বলেছে, আমি যেন ঘুম থেকে উঠে তোমাকে দেখতে পাই। তুমি ওখানে বসে থাকো। তবে আমার পাওনা। সে কি সেই দূর থেকে দেখা, সূর্যাস্তের পরে ঠিক যখন সব দিক থেকে মানুষ নিজেকে অসহায় পায়।      

কস্তূরী পিছন থেকে ডেকে উঠল, যাবে না?

বললাম কোথায়?

সে বলল, মায়ের যে আজ বার্ষিকী ছিল। তুমি তো বলেছিলে তোমার ‘অফ ডে  বলে ভালই হয়েছে।

বললাম যাব, কিন্তু কি করা হবে সেখানে, তোমরা তো হিন্দু কোনো রীতিনীতি মানো না। শুধু তো সবাই একসাথে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু হয় না।

কস্তূরী বলল, সেটাই তো চাই। বছরে অন্তত একটা দিন মাকে স্মরণ করা।  

বললাম, এ না স্মরণ না কোনো রীতি উৎযাপন। ঐ সবাই মিলে কিছুটা ‘গেট  টুগেদার’। তাও আবার একেবারে ন্যাতানো। আমার ঠিক কি মনে হয় জানো?

কস্তূরী তাকিয়ে আমার দিকে - বললাম, মনে হয় যে সব পুরুষদের পেনিস আর দাঁড়ায় না, তারা নিজেদের ঝোলা ঝোলা অস্তিত্ব নিয়ে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়েছে  মুখোমুখি। 

কস্তূরীর আগুন ঝলসানো চোখ আমার দিকে ছড়াল ফুলঝুরি, কিন্তু মুখে বলল, পুরুষগুলি কারা?  

বললাম, যে সকল মানুষকে তুমি পুরুষ বলে দেখো তারা।

বলল, নিজেকে বাদ দিলে! ভালো।   

বললাম, সেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ নিজের জন্য কিছুটা স্পেস সবাই রাখতে  চায়।

কস্তূরী রাগ করে উঠে গেল অথচ তার চলে যাওয়ার কোনো শব্দ পেলাম না। মেয়েদের মনের সাথে তার চলা ফেরার এক সম্পর্ক থাকে। তা চলা ফেরায় বোঝা যায় ভালো। যখন তাদের হাতের চুড়ি বা পায়ের মল বেজে ওঠে খন-খনিয়ে। কস্তূরীর হাত খালি, সে খালি রাখতে ভালোবাসে। তাই তার দু’হাত যখন  তার পাছার আঘাতে এদিক ওদিক ছলকেও যায়, তখনও কোনো শব্দ বেরোয় না। তার প্রতিবাদ বা রাগ যেন কথাহীন। কিন্তু যত সে আঘাতে গরম হয় তত  তার শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে ওঠে। বুক দুটি ঠেলে ওঠে সামনের দিকে। এমনিতেই তার দাঁড়ানো কিছুটা ‘এক্সপোশ’। সে বুক ঠেলে দাঁড়াতে ভালোবাসে। যখন তার  ছেলের বয়স দশ, তখনও সে দেখায় তারটা কোনো কুমারীর থেকে কোনো  অংশে কম নয়। এখন সে তার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর আমার দিকে ফিরিয়ে দেয়েছে তার পিঠ। কিন্তু সেও জানে মেয়েরা পিঠ দেখালে বাস্তবে তারা তাদের কোমর আর পাছাই দেখায়। আর ঠিক এই মুহূর্তে আমার ভিতর জেগে ওঠে সংগ্রাম।

 আমি উঠে পড়লাম। আমাকে অনেক দূর হাঁটতে হবে। কস্তূরীর কাছে আমার অবয়ব পড়ে থাক। মায়ের কাছে পড়ে থাক আমার ছায়া। কস্তূরীর মায়ের কাছে থাক তার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। শেষকালে তার স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে এসেছিল। হয়তো শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভুলে গিয়েছিল নিজেরই পরিচয়। মাঝে মাঝে ফিরে আসতো, আবার মাঝে মাঝে হারিয়ে যেত অন্য কোথাও। আমাকে দেখতে পেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতো মুখের দিকে। হয়তো ছেলেকে খুঁজত, তারপর যখন দেখত আমি শৈলেশ নই, ফিরিয়ে নিত মুখ। মুখে কথা বলতো না। যেদিন মারা যায় সেদিনও তেমনই হয়েছিল। তাকিয়েছিল আমার দিকে আর ছেলেকে খুঁজে যাচ্ছিল। শৈলেশ তখনও রাস্তায়, তার আসতে আর বেশি দেরি নেই। আমি বললাম, আসছে, শৈলেশ আসছে। আর একটু  অপেক্ষা করুন। তাকিয়ে থাকলো আরও কিছুটা সময়, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। আমি কস্তূরীকে বললাম, মাকে আরও একটা কম্বল দাও, ঠাণ্ডা লাগছে মনে  হচ্ছে। যদিও আমি জানতাম তার ঠাণ্ডা লাগছে না। কিন্তু কেন যে বলেছিলাম জানি না। কস্তূরী উঠে যেতেই চোখের ভাব সামান্য কিছুটা পালটে গেল। ঠিক যেমন কেউ কিছু বলার চেষ্টা করছে অথচ পারছে না। চাইছে কেউ তার মনের কথা বুঝে নিক। আমি এগিয়ে গেলাম তার দিকে, তিনি মুখ খুললেন কিছুটা। কস্তূরীর বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন পিছনে। এক মুহূর্তে মনে হল হয়তো তাঁকে কিছু বলতে চান। আমি নিজেকে সরালাম যাতে তিনি এগিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু কস্তূরীর মা হাত ধরলেন আমার। অর্থাৎ তিনি এই শেষ মুহূর্তে তাঁর স্বামী নয় চাইছেন আমাকে। কিন্তু তিনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? যাইহোক এ স্বল্প জীবনে যে কটি অভিজ্ঞতা হয়েছে এটি সম্ভবত তার মধ্যে সব থেকে মূল্যবান। আমি এগিয়ে গেলাম।

অথচ অস্পষ্টতা কি স্বাধীনতা, না কি কোনো বন্ধন? আমাকে বেঁধে রাখে কখনও, আবার ঠেলে দেয় অচেনা অন্ধকারের মধ্যে। এবং আমি তাকে টিকিয়ে রাখি নিজের ভিতরে চিরকালের মতো। সচেতন ভাবে এই মুহূর্তে আমি অত্যন্ত সংবেদনশীল। আবার আমার মধ্যেই এক বেপরোয়া রূপ ফুটে ওঠে। হয়তো কিছুই বলার নেই কারোর। শুধু এক কথা বলার অভিনয় করা। কেননা সব কথা বহুদিন সগেই শেষ হয়ে গেছে। যেটুকু কথা ছিল বা আছে সেটুকু কেউই চায় না যে বলা হোক। আর এই সবকিছুর মধ্যে একমাত্র যা ভালো তা হয়তো কস্তূরীর সেখানে অনুপস্থিতি। যখন সে ফিরে এসেছে তখন শেষ হয়ে গেছে কথা বলার চেষ্টা করা। আমরা সকলেই ফিরে এসেছি অনেকবার সেই ঘর থেকে। সেই দুয়োর থেকে। কিন্তু কিছু কথা যা বলতে চেয়েছিলেন। 

এর পরে আমাদের মাঝের সংলাপগুলি অবশ্য তেমন বিশেষ কিছুই নয়। খাঁটি কমিউনিস্ট যেভাবে মৃতের সৎকার করে সেভাবেই হয়েছিল সব কিছু। যাকে আমি অন্তত সবকিছু বলে থাকি। আমি আগে থেকেই জানতাম এভাবেই হবে সবকিছু। তাও যখন আমার মতো নাস্তিকের কাছে খুলে দেখান হল, আমার মনে হল, ঈশ্বর বিরোধিতা। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে ঝুলে থাকা এক অহং যে নিজের বাবাকে অস্বীকার করছে। যদিও আমি নিজেকে কস্তূরীর বাবার থেকে কখনওই স্বল্প শিক্ষিত পাইনি। কিন্তু বিদ্রোহ করা হয়তো আমার স্বভাব বিরুদ্ধ, তাই শৈলেশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি।

(ক্রমশ)

 


2 কমেন্টস্:

  1. একটি সচেতন এবং পারদর্শী কলমের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণের পরম্পরা চলে আসছে প্রতিটি পর্ব বয়ে বয়ে।

    উত্তরমুছুন