কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মৌলীনাথ গোস্বামী

 



সমকালীন ছোটগল্প

বাড়ি

অনেক খোঁজার পরে, ব্রোকারের মাধ্যমে একটা বাড়ির হদিস পেল স্বদেশ। যে বাড়িটায় এখন ভাড়া আছে, সেটার মালিক, একমাস হতে চলল নোটিশ ধরিয়েছে, খালি করে দিতে হবে। মালিকের মেয়ে-জামাই বিদেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরে আসছে আগামী মাসের মাঝামাঝি। স্বদেশ যে অংশটায় ভাড়া থাকে, ওরা সেখানেই এসে উঠবে। সময় বড় কম হাতে, তাই হন্যে হয়ে বাড়ি খুঁজছিল স্বদেশ। এতদিন হয়ে গেল চাকরি করছে, নিজের ভিটে বলা যায় এমন কিছু এখনও করে উঠতে পারল না। নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া বোল্ডারের মতো, কেবল গড়ানো আর গড়ানো। থিতু হওয়া আর হয়ে উঠল না। স্ত্রীর কাছে এই নিয়ে হামেশাই কথা শুনতে হয় স্বদেশকে। ফ্ল্যাট কেনার জন্য জোর করে। কিন্তু ফ্ল্যাট পছন্দ নয় স্বদেশের। ওর বড় সাধ একটা বাড়ি হবে নিজের। ছোট হোক! সঙ্গে এক চিলতে জমি। চারদিকে পাঁচিল থাকবে। ফুলের অল্প বাগান করবে ভেতরে। সস্তায় জমির সন্ধানে আছে স্বদেশ; কিন্তু যতদিন না স্বপ্ন সাকার হচ্ছে, ততদিন ভাড়া বাড়িতেই দিন কাটাতে হবে। একটা জমি নিয়ে কথাবার্তা চলছিলও, তারই মধ্যে এই নোটিশ সব হিসেব ওলোটপালোট করে দিল।

রবিবার ছুটির দিন। বাড়িটা সেদিনই দেখতে যাবে বলে আগেই কথা বলে নেওয়া ছিল। এখন যেখানে ভাড়া থাকে, সেখান থেকে বাইকে আধঘণ্টা। এই বাড়িটার বাড়িওয়ালা বেঙ্গালুরুতে থাকে ওর ছেলের কাছে, সুতরাং নির্ঝঞ্ঝাট বাসস্থান। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের নিত্য খিটিমিটির সম্ভাবনা নেই। ব্রোকার ছেলেটিই বাড়িটার দেখাশোনা করে। নির্ধারিত কথামতো, বড় রাস্তার মোড়ে স্বদেশের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। তখন সকাল। প্রায় পৌনে এগারটা। চারিদিকে ঝমঝম করছে রোদ্দুর।

ছেলেটির স্কুটারের পিছু পিছু উবড়খাবড় রাস্তা দিয়ে, দু'-পাশে ইতঃস্তত দাঁড়িয়ে  থাকা বাড়িঘরের ভিড় চিরে, মোটরসাইকেলের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, স্বদেশ এসে পৌঁছল বাড়িটার সামনে। পাঁচিলঘেরা দেড়তলা বাড়ি। পাঁচিলের লোহার গেটে অবহেলার জং। বাঁকানো শিকের গা থেকে একটা রংচটা টিনের সাইনবোর্ড, সরু তারে কোনরকমে আটকে ঝুলে আছে। সেই টিনের গায়ে অস্পষ্ট হয়ে আসা 'কুকুর হইতে সাবধান' জানান দিচ্ছে, এই বাড়িতে কোনও এককালে কুকুরও ছিল। গেটে একটা তালা নিঃশব্দে স্থির হয়ে ঝুলে আছে।

পাঁচিলের মাথার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বাড়িটাকে দেখছিল স্বদেশ। বৃদ্ধাশ্রমের পরিত্যক্ত স্থবির এক বৃদ্ধের মতো, একা উবু হয়ে বসে আছে বাড়িটি। এরও বয়স হয়েছে। সুজন নাই, স্বজন নাই। বাড়িটার গায়ে যত্নের স্পষ্ট অভাব। যেন বহুদিন গা পরিষ্কার করে দেয়নি কেউ। সারা শরীর জুড়ে ধুলো আর ময়লার স‍্যাঁতাপড়া দাগ। শুকিয়ে যাওয়া শ্যাওলার মামড়ি। ছাদ থেকে দেওয়াল বেয়ে সন্ন্যাসীর সহস্র জটার মতো নেমে এসেছে শুকোনো জলের অসংখ্য কালো ধারা। যেমন ক্রন্দনরত শিশুর গাল বেয়ে চোখের জলের সাথে নেমে আসে কাজলের দাগ, বাড়িটার গায়ে, গালে, সেরকমই কান্নার দাগ লেগে আছে। একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্বদেশের মনে হল, বাড়িটা কি নিজের একাকিত্বে, সবার চোখের অলক্ষ্যে, প্রতিদিন প্রতিরাত গুমরিয়ে গুমরিয়ে কাঁদে? চোখের জল ফেলে? ব্রোকার ছেলেটি তালা খুলে গেটে ঠেলা দিলে, বহুদিনের আটকে থাকা গেটের কলকব্জা বিকট শব্দ করে নড়ে উঠল। স্তব্ধতার মাঝে চমকে উঠে ওদের দিকে তাকাল যেন ঝিমধরা বাড়িটা! যেন কত কতদিনের ঘুমচোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল- কে এলো?

গেট থেকে বাড়ির বারান্দা অবধি একটা সরু সিমেন্ট বাঁধানো পথ ধরে এগিয়ে গেল স্বদেশ। পথটা আর দেখা যায় না। আমরুল শাক, দুব্বো ঘাস আর আরও অনেক বিজিবিজি আগাছায় প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। তাই তো হয়, বাগানের দিকে তাকিয়ে স্বদেশ ভাবে - একদিকে একটা জীবন যখন নিঃশব্দে শেষ হয়ে যায়, তখন অন্যদিকে আপন খেয়ালে নতুন জীবন জেগে ওঠে সদ্যপ্রাপ্ত প্রাণের বেলাগাম উচ্ছ্বলতায়। যেখানে শেষ, সেখানেই শুরু। ব্রোকার ছেলেটি দু'টো চাবি ওর হাতে ধরিয়ে - "আপনি ঘরের তালা খুলে দেখতে থাকুন, আমি আসছি"- বলে, কোথায় কেটে পড়ল। চাবি হাতে বারান্দার দিকে এগোল স্বদেশ। কী দেখতে এসেছে, নিজেকেই প্রশ্ন করছিল সে। বাড়ি তো দেখা হয়েই গেছে। ঠিক যেমনটি চেয়েছিল তেমনই। একফালি জমিও আছে। ঘেরা পাঁচিল আছে। আর কী চাই? আর কী-ই বা দেখার থাকতে পারে! ভেতরে কয়েকটা ঘর থাকবে, এর বেশি তো কিছু নয়। তবু কেন বাড়ি দেখতে আসে মানুষ? কীসের কৌতূহল মেটাতে ঘুরে ঘুরে দেখে? বাড়ির নকশা, কামরার আয়তন, বাস্তু? নাকি অন্য কোন কিছু?

একটা পেতলের তালা ঝুলছে বারান্দার গ্রিলে। বারান্দাটা খুব একটা ছোট নয়। মাটিতে জমাট ধুলোর স্তর, শুকনো পাতা, খড়, ছুঁচোর পায়ের ছাপ, টিকটিকির নাদি। গ্রিল ঠেলে ওপরে উঠে আসতেই, স্বদেশের জুতোর ছাপের নকশা ফুটে উঠল বারান্দার পুরনো ধুলোয়। যেন বাড়ির গৃহস্থ ধুলোরা নিজেদের মাঝে বরণ করে নিল ওকে। ওপাশে একটা দরজা। তালাবন্ধ।

তালা খুলে দরজার পাল্লাটা একটু ঠেলতেই, বাইরের আলোর আঘাতে ভেতরের সব অন্ধকার চুরমার হয়ে ভেঙে ওর দিকে হৈ হৈ করে তেড়ে এল... দরজাটা অল্প ফাঁক করে ঘরের ভেতরে পা রাখতেই, পায়ের তলায় অন্ধকারের ভাঙা টুকরোগুলোর গুঁড়িয়ে যাওয়ার শব্দ হল যেন। খুব মৃদু। কান দিয়ে শোনা যায় না। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুনতে হয়। স্বদেশের মনে হল যেন সহস্র লকলকে কালো জিভ, আলো-আঁধারির আবছায়া গহ্বর থেকে উঠে এসে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছে, আর টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও গাঢ় অন্ধকারের জঠরে। চারিদিকে আলকাতরার মতো চাপ চাপ অন্ধকার। চোখ সয়ে গেলে স্বদেশ দেখতে পেল, বন্ধ জানলার অসংখ্য ফাটলের ফাঁক দিয়ে, তিরের গোছার মতো, ঘরের মেঝেয় তির্যকভাবে নেমে এসেছে সরু মোটা অজস্র আলোর রশ্মি। অন্ধকারের গায়ে সোনালি সুতোর মীনাকারী। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখা যায়, সেই আলোর রেখাদের ঘিরে আপন খেয়ালে সম্মোহিতের মতো, অবিরাম ভেসে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধুলোকণা। কীসের কণিকা এরা? এই বাড়ির ভেতরে, থেকে থেকে ধুলো হয়ে যাওয়া মানুষের নিঃশ্বাসের? কণ্ঠের? স্পর্শের? স্মৃতির? বছর বছর ধরে এ'-বাড়ির প্রতিটি কামরার অভ্যন্তরে জন্ম নেওয়া, অপরিমিত মুহূর্তের অতীতকণা সব! এ যেন এক যাদুজগতে প্রবেশ করেছে সে। বিস্ময়ে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় ভাসমান কণাদের...

জানলা খোলে না স্বদেশ। যেন খুললেই অন্ধকারের গায়ে লিপিবদ্ধ বাড়ির সব ইতিহাস, বর্তমানের সাথে এক হয়ে মিশে যাবে। সামান্য ফাঁক করা সদর দরজার পাশ দিয়ে, বাইরের যতটুকু আলো ভেতরে এসেছে, তাতে বাড়ির অন্দরমহল আন্দাজ করা যায়। কামরাটি বড়। ড্রয়িংরুম। স্বদেশের কানের কাছে গোপন বাতাস ঠাণ্ডা গলায় ফিসফিস করে। ওর গলায় নাকে মুখে নরম আঙুল বোলায়। স্বদেশ শুনতে পায় দেওয়ালঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে বেজে চলেছে। খসখস করছে পায়ের আওয়াজ। খুটখাট শব্দ। দেওয়ালের এক পাশে দাঁড়িয়ে স্বদেশ আবছায়ে দেখতে পায়, অন্ধকারের বুকে জেগে উঠেছে বেতের গোল টেবিল, ঢেউ তোলা রকিং চেয়ার, কাপে চা ঢালার শব্দ। চায়ে চুমুক দেওয়ার হালকা আওয়াজ। চেয়ারটা দোল খাচ্ছে। মৃদু স্বরে একটা কুকুর ডেকে উঠল যেন পাশ থেকে। হাঁটুর নিচে প্যান্টের ওপর কিছু একটা ঘষা দিয়ে চলে গেল। অস্বস্তি হচ্ছিল স্বদেশের। জোরে গলা খাঁকারি দিল একবার। আচমকা সবকিছু কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হল, মুহূর্তকাল আগে অতীতের আয়নায় জেগে ওঠা অন্ধকারগুলো, যেন ভীষণ বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

সংকোচিত হয়ে বাড়ির আরও ভেতরে ঢুকল স্বদেশ। ঘরের ওই প্রান্তে একটা দরজা খোলা অবস্থায় হা-হা করছে। যেন কতকালের আঁধার গহ্বর, স্বদেশকে আহবান জানাচ্ছে। ডাকছে। বলছে - এসো, ভেতরে ঢোকো...

কেমন এক ঘোরের মধ্যে ধীর পায়ে হেঁটে যায় স্বদেশ। ঢুকে মিশে যায় অন্ধকারে। নিজেই অন্ধকার হয়ে যায়। দেখে ঘাপটি মেরে একটা পালঙ্ক অশরীরীর মতন আবছা দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে সোনালি সুতোর সেই আলোগুলো এই ঘরেও নেমে এসেছে। পালঙ্কের একটা দিকে কিছু অস্পষ্ট কারুকাজ আন্দাজ করা যায়। আলোর রেখায় চওড়া কাঠে জায়গায় জায়গায় পালিশ চকচক করছে। একটা গন্ধ ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরের হাওয়ায়। ধূপের গন্ধ। কোথা থেকে আসছে স্বদেশ বুঝতে পারে না। শুধু আলোর সুতোর দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় রেশমের মত একখণ্ড ধোঁয়া, কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরের দিকে অতি ধীরে ভেসে চলেছে। কারা থাকত এই ঘরে? এখনও থাকে? ভাবে স্বদেশ। বর্তমানের কাছে কাদের নিঃশ্বাস আজও ফেরি করে রুদ্ধ বাতাস? হয়ত এই খাটে কারও ফুলশয্যা হয়েছিল কোনদিন। পালঙ্কের বাজু ধরে দাঁড়ায় স্বদেশ। বাঁকানো পাটার ওপরে কী একটা ঝিকিয়ে ওঠে আলোয়। হাতে তুলে নেয় স্বদেশ। আঙুলে ধুলো লাগে। একটা নাকের নথ। পাথর বসানো। কবেকার! কার কে জানে! পাথরটা আজও অতীতের অনির্বাণ আলো জ্বেলে বসে আছে। কার অপেক্ষায়? স্বদেশের মনে হয়, ঘোমটা মাথায় নববিবাহিতার মতো জবুথবু কে যেন পালঙ্ক থেকে চকিত চপলতায় নেমে যায়! চুড়ির গোছার রিনরিনে আওয়াজ কানে আসে। কামরার অন্ধকারে কেউ যেন খিলখিল করে হেসে ওঠে। স্বদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে হাসিটা ঘরময় পাক খেতে থাকে। দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খায়। চূর্ণ হয়। ঘন প্রতিধ্বনির অনুরণন শেষ হয়ে গেলে, পালঙ্কের এককোণ থেকে যেন উঠে আসে, সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া এক নবজাতকের কান্না। মানুষের? বেড়ালের? শকুনের? কান্নাটা ক্রমে বাড়তে বাড়তে এক পরিণত নারীর হাহাকারে রূপান্তরিত হয়ে, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে দেওয়ালের গায়ে... সেই আর্তির অভিঘাতে শিউরে ওঠে স্বদেশ! বুঝতে পারে না কী হচ্ছে ওর চারপাশে! কার এই অনন্ত কান্না? এতকাল ধরে কী ইতিহাস চাপা আছে এই অন্ধকারের অতলে? মৃত্যু? ওই নবজাতকের? সে কি তার মা, যে কাঁদে?

ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় স্বদেশ। মনের ভেতর তোলপাড় হতে থাকে। বন্ধ বাড়ির আত্মা এ কী খেলা খেলছে তার সঙ্গে! কত অব্যক্ত কথা, কৈফিয়ৎ, বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে অবিরাম মাথা কুটে চলেছে! জীবনের আবহমান অববাহিকার পাঁচালী... একটা পরিবার থেকে আর একটা পরিবারের তীর ছুঁয়ে, বয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। বন্ধ কামরার ভেতর কত স্বপ্ন, কত আকাঙ্ক্ষা, কত ভালোবাসার জন্ম ও মৃত্যু মরে পড়ে আছে। থাকে। কেউ টের পায় না। বাড়ির ইট আর দেওয়াল শুধু বোবা সাক্ষী হিসেবে, সব যন্ত্রণা নিজের শরীরের ভেতর শুষে নিয়ে, অবিচল দাঁড়িয়ে থাকে, রোমন্থনের অপেক্ষায়। কাকে শোনাবে বলে? কার অপেক্ষায়?

নাকে ভাতের নরম গন্ধ এসে লাগে। গা ছমছম করে ওঠে স্বদেশের। কোথা থেকে আসে এই সুবাস? গন্ধের সূত্র ধরে আলো-আঁধারিতে হেঁটে যায় সে। আবছায়া আর একটা ঘর। ছোট। ভাতের গন্ধটা এখানে জমাট বেঁধে ঘরটির অন্ধকারে স্থির হয়ে থেমে আছে। যেন কেউ রান্না করছে। আবছা মূর্তি এক। পৃথুলা রমণী। স্বদেশের নিঃশব্দ পায়ের আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। সামান্য হাসে। কিছু একটা বলে। গাঢ় আঁধারির সুদূর গভীর থেকে উঠে আসে, অস্পষ্ট সুরেলা এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর- একটু অপেক্ষা করো...

গা ছমছম করে ওঠে স্বদেশের! কীসের অপেক্ষা? কাকে বলল এ'কথা এই ছায়ামানুষী? নিজের অজান্তেই আশেপাশে তাকায় স্বদেশ। পাথরের মতো কঠিন অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। টের পায়, ভাতের গন্ধ আরও ঘনিয়ে উঠেছে। যুগ যুগ ধরে জীবনের উনুনে রান্না হয়ে চলেছে, সংসারের অনন্ত অন্ন। সেই মোহিনী ঘ্রাণ ওকে কুয়াশার মতো ঘিরে ধরে। ওর স্নায়ুর ভেতরে চেপে বসে ধ্বনিত হয় দু'টো শব্দ- অপেক্ষা করো...

কে আজও অনাদি অনিঃশেষ অপেক্ষা করে আছে? শব্দ দু'টো, আর বলার ভঙ্গিমা খুব চেনা মনে হয় স্বদেশের, কিন্তু মনে করতে পারে না। কেবল চুড়ির মিহি শব্দ ওর আশেপাশের হাওয়ায় খেলে বেড়ায়। স্বদেশের মনে হয়, যেন এই গলার স্বরের জন্যই কত শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করে আছে সে। তার কান তৃষিত হয়ে আছে সেই কোন কবে থেকে এইটুকু শোনার জন্য। বিস্মৃত দু'টো শব্দ, আর তাদের শরীর থেকে বৃষ্টির মতো গলে গলে প'ড়ে, চোখের কিনার ভিজিয়ে দেওয়া ভালোবাসা, মায়া, মমতা...

হতবাক স্বদেশ সরে আসে। দেখা হয়ে গেছে তার। কিন্তু যেন শেষ দেখা হয়নি। গোটা বাড়িটার অন্দরমহল শাশ্বত ইতিহাসের মতো, একের পর এক দৃশ‍্যাবলি নিয়ে ঘটে চলেছে ওর সামনে। কত জন্ম, কত মৃত্যু এই ঘরের কামরায় ঘটে গেছে। স্বদেশ দেখতে পাচ্ছে, দোলনায় শুয়ে দোল খাচ্ছে এক মুখহীন শিশু। তার দেয়ালার দুর্বোধ্য শব্দের সাথে, ঘরের বাতাসে ছলকে উঠছে পায়ের মলের ছুমছুম। দেখতে পাচ্ছে, বাইরের ঘরের মেঝেতে শায়িত সাদা কাপড়ে মোড়া এক মুখহীন শবদেহ। তাকে ছায়ার মতন ঘিরে আছে অনেক মানুষের অবয়ব। তাদের জটলা থেকে কান্নার কণ্ঠরুদ্ধ গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। স্বদেশের গন্ধ পেয়ে মানুষগুলো একে একে নিঃশব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। কান্নার দমকে তাদের সকলের শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। ওদের সকলের চোখে এক অন্তহীন অপেক্ষার ক্লান্তি। সে অপেক্ষা জীবনের অতৃপ্তির, অপ্রাপ্তির, অসফলতার যবনিকা পতনের। সে অপেক্ষা, চিরন্তন ইতিহাসের শ্লাঘা আর পাপ স্খালনের অসমাপ্ত কাহিনী ব্যক্ত করার। স্বদেশ টের পায় লোকগুলো ধীরে ধীরে ভেসে ভেসে ওর দিকে আসছে। বৃত্তের মতন গোল হয়ে ওকে ঘিরে ধরছে মানবশৃঙ্খল। বৃত্ত ক্রমশ ছোট হচ্ছে। আরও কাছে আসছে অস্পষ্ট মানুষগুলো। মুখগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সকলের মুখে এক একটা অসমাপ্ত গল্প লেখা আছে। বিস্ফারিত চোখে স্বদেশ দেখছে, সব মুখগুলো অবিকল ওর মুখের মতো দেখতে। ওকে ঢেকে দিচ্ছে। ও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অতীতের প্রচুর ভিড়ে... একটুও আলো আসছে না আর... অন্ধকার... বড় অন্ধকার... চারিদিকে শুধু ভাসমান আঁধারকণা...

অনেক অপেক্ষার পর, স্বদেশ নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে...

 

 





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন