কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

চিত্তরঞ্জন হীরা

 

যে ফাঁক থেকে উঁকি দেয় পাখিদের ভূমধ্য




সবটুকুই প্রলাপ অথবা এ জীবন শুধু পাখি পাখি। ডানাহীন উড়ে যাওয়া। গাছগল্পের খই নিয়ে। বোঝা কি গেল! এ জীবনের কতটুকু আর বোঝা যায়! কানে বাজছে ভোরভিখারির খোল করতাল। সকাল থেকে জীবন চললো তার পায়ে পায়ে। আমিও কি ছাই এতো সব বুঝি ! সভ্যতার পালে হাওয়া লাগে। দোল খায় পরিহাস নিয়ে।

তো আমরা আমাদের জীবন-অভিজ্ঞতায় বুঝলাম একজন স্রষ্টা একই সঙ্গে সময় ও প্রতিভার সন্তান। তবু সময় নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তির কোনও শেষ নেই। সে অশেষ। কেউ সময়কে বিচার করেন কোলাহলের বৃত্তে দাঁড়িয়ে। আবার কেউ দেখেন কেন্দ্রের উৎস থেকে। শূন্য থেকে কণা কণা এই চরাচরের পুরো দৃশ্যগুলো আকণ্ঠ হয়। দূর সংকেতের বাঁশি বাজে। তখন বিষয়ের মধ্যের বিষয় বা ঘটনার অন্তরে নিহিত ঘটনাই প্রধান। একটি সরলরেখার কথা ভাবি। চলতে চলতে পায়ের বেগে আবেগ হলো অথৈ। যার এক মুখে বাজছে প্রবল সংযোগের রতি, অন্য মুখে ভরা বিযুক্তি। এই দুটি মুখ যে যার দিকে প্রসারিত। এই চলতা ছন্নছাড়া। তবু সেই-ই সভ্যতার মুখে দেয় বিকাশের বাতি। সৃষ্টির শিখায় নিয়তি হয়ে জ্বলতে থাকে স্রোতস্বিনী ফল্গু হয়ে।

"বৈশ্য লেখকের পক্ষে শূদ্র পাঠকের মনোরঞ্জন করা সঙ্গত। সুতরাং যাই করো না কেন পাঠকের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করো না।" বলেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। সে তো আর আজকের কথা নয়। 'সবুজপত্র' প্রথম প্রকাশ পায় ১৯১৪ সালে। যে পত্রিকা হয়ে উঠেছিল কালের কণ্ঠ। কিন্তু এসব কথার আবার নানা অর্থ হয় ওই যে আমরা বলেছি সরলরেখার দুটি মুখ'বৈশ্য' 'শূদ্র', এরপর আসবে কুলীন লেখক পাঠকদের কথা এভাবে জাত বর্ণ বিভাজন নিয়ে কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। প্রতি কালেই একদল লেখক পাঠকের মনোরঞ্জনের কথা সবার আগে ভেবেছেন  আর আরেক দল লেখক প্রচলিত ধারা বা ভাষাকে অতিক্রমের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এই দুটোর মধ্যে একটা সংযোগ অবশ্য তলে তলে অখণ্ড জলরাশির মতো গড়েই ওঠে । কারণ নতুনধারা সবসময় প্রত্যক্ষে হোক বা পরোক্ষে সে মূলধারাকে পুষ্ট করেই এসেছে।

তবে পাঠকের মনোরঞ্জন করা একটা দুঃসাধ্য কাজ। কারণ পাঠক যে ঠিক কী চায় সে নিজেই জানে না। মধুর তোমার পারাপারখানি। পাড়ে নৌকো বাঁধা আছে। যাবে কি যাবে না তুমি ভাবো। যাহোক উঠে পড়েছো, এবার ভাবো কোন্ ঘাটে ভিড়াবে তোমার নাও ! অর্থাৎ পাঠক হলো নানা রুচির। একজন লেখক বোধহয় সবার আগে ভাববেন –এই ব্রক্ষ্মাণ্ডে তাঁর অবস্থান কোথায় ! এরপর ভাববেন – তিনি যা লিখছেন বা লিখতে চান, সে লেখায় নিজের প্রতি খোঁজ জারি আছে কীনা ! অর্থাৎ আত্মানুসন্ধান। আরও ভাবার হলো তিনি নিজের কাছে সৎ তো ! যে সৃষ্টির মধ্যে সত্যের খোঁজ নেই, ভবিষ্যতের কাছে তার মূল্য কোথায়!

'মূল্য' শব্দটিও বড্ড আপেক্ষিক। জীবন সম্পর্কে এক একজনের মূল্যবোধ এক একরকমের। সমাজ সম্পর্কে ধারণাটাও তাই বদলে যায় ব্যক্তিবিশেষে। কাল এবং কালান্তরে, মন এবং মননে ঘুরে ফিরে জীবন এক পূর্ণতার কথা বলে। কিন্তু পূর্ণ বলে তো কিছু হয় না। এক রহস্য থেকে আরেক রহস্যের দিকে যেতে যেতে পূর্ণতার খোঁজ চলতে থাকে। এক জীবনে কলসটা আর পূর্ণ হয় না। আবার জীবন সেই একটাই। তাহলে উপায়! কোথায় এলাম কোথায় যাবো ভাবতে ভাবতে এক অনির্ণেয়তার মধ্যে দিয়ে এই জীবনযাত্রা। কবিও চলেছেন, পাঠকও চলেছেন। চলাটাই সত্য। ভেতরে অচিন পাখির গান, পালকের ঘ্রাণ, সংসার, অন্তরের অন্তর –এসব নিয়েই চলতে থাকা।

এসব ভাবতে বসলে আবার জীবন মেলে না। আর ওই পাঠক, যিনি সৃষ্টির রহস্য নিয়ে, শব্দের লীলাখেলা নিয়ে বসবেন, তিনি সামাজিক জীবন হারাবেন। এখন ভেবে দেখুন কোন্ পথ আপনার ! লেখক ভাবছেন – কিছুই লিখতে পারিনি আমি, অন্তত সেই লেখাটি যা আমি লিখতে চাই। আর পাঠকও ভাবছেন – এই পৃথিবীর কী অপার বিস্ময়, কিছুই জানা হলো না আমার ! এমনটা হলে সব গেলো, সংসার এলোমেলো। এ জীবন তো এক বিকিকিনির হাট। সব মিলিয়ে কথা হলো লেখক যেমন তাঁর সত্তার আলোড়নটুকু ধরতে চাইবেন, পাঠ যেমন এক অভ্যাস, নিরাকারের খেলার মতো ভেতরে ভেতরে গড়ে তুলতে হয় পাঠক হয়ে ওঠাও অভ্যাসের মধ্যেই পড়ে

আমরা এখনও বিশ্বাস করি সৃষ্টি শুধু বিনোদনের বিষয় বা বস্তু নয়, সে হবে ভবিষ্যতের বার্তাবাহী। কেনাবেচার সারাৎসারে জীবন পড়বে একলা পথের বাঁকে। বনকাপাসির মাঠে তুলো উড়ছে বীজ নিয়ে। তাহলে সৃষ্টিকেও হতে হবে রূপান্তরিত রসের ঘনঘটায় একেবারে কোলাহলমুক্ত। যে সময়ের কোলাহলকে ছিঁড়ে-ছেনে তার গভীরের গূঢ় নির্যাসকে তুলে এনে শব্দে সাজিয়ে দিতে সক্ষম হবে, অন্তত চেষ্টাটা জারি থাকবে। সময়কে টপকে অতিক্রমের ভাষা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে, তার মধ্যেই ভবিষ্যতের বার্তাটুকু। অর্থাৎ সম্ভাবনা। পুরোনোকে বর্জন করে নতুনের খোঁজ হলো তার সচেতন প্রয়াস।

যা কিছু অতীত তার সবটুকু কি ইতিহাস হতে পারে ! বোধহয় নয়। ইতিহাস হয়ে ওঠার জন্যে কিছু উপাদান চাই। ঐতিহ্যের নিহিতে যে গূঢ় ঘটনার সম্ভার তাকে জমিয়ে জমিয়ে কালের ইতিহাস। পায়ে পায়ে এক বিস্তারের খেলা। ক্রমে পেরিয়ে যাওয়া আর পথের বাঁকে ছাপ ফেলে রাখা। এমন এক একটা সময় আসে মনে হয় চারপাশে সব কিছু যেন থেমে আছে। তখন ভেতরের অস্থিরতা বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে রুগ্ন উটের পিঠে চেপে সওয়ার হচ্ছে সময়। তাহলে কি এই উর্বরা মাটি মরুভূমি হলো ! তাতো নয়। এই যে চর্যাপদ থেকে পায়ে পায়ে সময়ের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এতদূর এলো সেতো একই ধারায় আসেনি গতি-প্রকৃতি বদলে, ভাষা-আঙ্গিক বদলে আজ এখানে এসে পৌঁছেছে। এক একটা রাহুগ্রস্ত সময়ের ধোঁয়া-ধুলো বাঁচিয়ে, ঝড়-জল-মরুভূমি, পাহাড়-নদী-সমুদ্র পেরিয়েই এখানে আসা

আসলে এই মুহূর্তে যা অসম্ভব, যা অবাস্তব এবং যা অনির্ণেয় – তাকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলা। মুহূর্তের ব্যর্থতাকে ছড়িয়ে নিয়ে বসা। তার মাঝে যে আনন্দটুকু লুকিয়ে রয়েছে তাকে উদ্ধার করা। যেমন এখন আমাদের সন্ধান করতে চাইছি জীবনানন্দ পরবর্তী কবিতার ভাষাপথ। যে পথে পড়ে আছে আজও সার্বিক গ্রাহ্যতার বাইরে। যেভাবে আমরা পেরিয়ে এসেছি মাইকেলের যুগ, রবীন্দ্রনাথের যুগ তারপর জীবনানন্দের যুগ। গ্রহণ করতেই অনেকটা সময়। এখন বলতে হচ্ছে তাকে অতিক্রমের পথ কেন এতো দীর্ঘ হচ্ছে ! অনেকটা পেরিয়ে আসার পরও কেন এতো পিছুটান ! আমরা আজও কেন পরাবাস্তবতার ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না !

শিল্প-সাহিত্যের মূলধারার একটা শর্ত থাকে, তা হলো, মিডিয়া যা চায় তাকে পুষ্ট করা। আর একটি দিক আমরা জানি, সেটা হলো স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটা। দেখা গেছে আঙ্গিক ও প্রকরণের দিক থেকে কবিতায় যখনই নতুনের অভিমুখটি খুলে যায় তখন ভাষা তাকে পথ দেখায়। তবে এই ভাষাভ্রমণে আমরা লক্ষ্য করেছি এক ধারা থেকে পরবর্তী ধারায় পৌঁছতে পূর্ববর্তী চিহ্নগুলির কখনোই একেবারে বিলুপ্তি ঘটে না। কিছু বৈশিষ্ট্য নতুন নতুন রূপ নিয়ে ফিরে ফিরে আসে।

এক্ষেত্রে বলার কথা হলো শব্দের যেমন নিজস্ব কিছু সত্যতা রয়েছে, তেমনি তার বাস্তবতার রূপ স্থান ও কাল ভেদে ভিন্ন। সূর্য এবং পৃথিবীর অবস্থান, বস্তুর ধারণা, পদার্থের চেতনা যেমন এক একটি বিজ্ঞানদর্শনের হাত ধরে বদলে যেতে সক্ষম হয়েছে তেমনি সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো, সংস্কার, বিশ্বাসও পাল্টে যায় চেতনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। এপথেই ভাষার রূপান্তর, শিল্প-সাহিত্যের রূপান্তর

আগামীর সম্ভাবনা তখনই উজ্জ্বল হতে পারে যখন সমস্ত চলমানতাকে নস্যাৎ করে নতুন ভাবনায় পদার্পণ করা যায়। এটা বুঝতে হবে সীমাহীন কালের দ্যোতনা দিয়ে। যেমন ভাষা নিয়ে ভাবতে বসলে প্রথমেই প্রচলিত শব্দার্থ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ শব্দের নিজস্ব কোনও অর্থ নেই। কোনও বস্তুকে চিনতে শব্দ দিয়ে একদিন তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বস্তুর ধারণা পাল্টে গেলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখন বদলে যাবে চিহ্ন এবং চিহ্নিতের মধ্যে সম্পর্ক। এভাবে বস্তু থেকে বাস্তবতা। বাস্তব হলো কাল্পনিক অভিজ্ঞতা, যা লালিত হয় মস্তিষ্কে

এই প্রসঙ্গে কল্পনাকে যদি অনুভূতি দিয়ে মাপা হয় তাহলে উন্মোচনের আধারটি সামনে প্রকট হতে পারে। কবির চেতনা নিত্য প্রসারিত হতে হতে সামনে এগিয়ে চলে। আমরা জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতার ভাষাপথের সন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম যে লক্ষণগুলো কবিতায় প্রকট হচ্ছে তা বাস্তব নয়, পরাবাস্তবিক, অবচেতনার। জীবনানন্দের মৃত্যুর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসে ১৯৮৮-তে কবি বারীন ঘোষাল একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে বোঝাতে চাইলেন এপথেই অবচেতনার অবসান ঘটুক। তিনি অতিচেতনার কথা বললেন।

এখন কথা হলো কী সেই অতিচেতনা, যা আমাদের অবচেতনার ঘোর থেকে বাইরে এনে দাঁড় করাতে পারে ! তিনি দেখালেন চেতনার ভেতরে যে চেতনার কথা এতদিন আমরা ভেবেছি সেটি হলো অবচেতনা। এখন ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে। আমাদের বহির্মুখী হতে হবে। যেখানে চিন্তার উৎস এক, মাপক এক, শুধু অভিমুখটি বদলে যাবে। এই ভাবনায় জারিত হয়ে কবিতার একটা পালাবদল ঘটলো। তাতে যে লক্ষণগুলো উঠে এলো, তাকে সাজালে মোটামুটি যা আমরা দেখতে পাই

. কবিতায় আমিময়তার প্রভাব কমে নৈরাত্ম কবিতা লেখার প্রয়াস।

. ব্যাকরণসিদ্ধ ছন্দে লেখা থেকে বেরিয়ে কবিতা হলো মুক্ত ও স্বাধীন। শব্দ ব্যবহারের স্বাধীনতা বেড়ে গেলো।

. কবিতা ছন্দোমুক্ত হয়ে তথাকথিত লিরিক্সও বদলে যায়। অর্থাৎ পেলব গীতল কবিতা লেখার প্রবণতা হ্রাস পায়। টানা গদ্যে লেখার প্রবণতা। অনেকেরই কবিতা হয়ে উঠলো গদ্যভাষার কাছাকাছি

. উপমা এবং সাদৃশ্যবাচক শব্দের ব্যবহার কমে গেলো

. বিশেষণ ব্যবহারের পদ্ধতিও বদলে গেলো

  কবিতায় যুক্তিপরম্পরা ও সিদ্ধান্তমুখীনতাকে ভেঙে দেওয়া সম্ভব হলো

. বিষয়কেন্দ্রিকতাও মুক্ত হলো

. উজ্জ্বল একটি পংক্তি রচনার চেয়ে গোটা একটি কবিতা বা টোটাল পোয়েট্রির দিকে ঝোঁক বেড়ে গেলো

. শব্দ ব্যবহারের প্রযুক্তি কবিতাকে করে তুললো জীবনের মতো গতিময়

আরও অনেক বৈশিষ্ট্য উদ্ধার করা যায়। সময় যত বদলাবে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যেরও জন্ম হবে। তবে চলার মধ্যেও একটা নাচলাও থাকে। অর্থাৎ গতানুগতিক। থাকতে থাকতে খোলসের গায়ে শ্যাওলা জমে। সময়ে দাঁড়িয়ে তার খোলস ছাড়িয়ে যদি ভিন্ন এক এককের সামনে দাঁড়ানো সক্ষম হয় তবেই এই বদলগুলো বুঝে ওঠা সম্ভব। যেকোনও  শিল্পের প্রকাশ হলো, যা সামনাসামনি দেখছি সেখান থেকে নয়, ঘটনার ভেতরের ঘটনা থেকে

বারীন ঘোষাল চেয়েছিলেন বাংলা কবিতা সার্বিকভাবে জীবনানন্দ প্রভাবমুক্ত হোক। তিনি বলেছিলেন, পুরোনো কবিতার সমস্ত চিহ্নবর্জিত কবিতাই হয়ে উঠবে নতুন কবিতা। যেমন বুদ্ধদেব বসুরা ভেবেছিলেন কবিতাকে যদি রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত করে তোলা না যায় তাহলে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রতিটি সময়ের নতুন হলো যে অতীতের হাত ছেড়ে আগামীর সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তুলতে চায়।

এখন দেখার, কবিতার ভেতরের পরিবর্তনগুলো আসছে কীভাবে! লক্ষ্য করা গেলো, শব্দ মূলত ধ্বনির সমন্বয়ে সৃষ্টি। তাহলে শব্দের উৎসে যে ধ্বনি তার সংকেতকে উদ্ধার করতে পারলেই শব্দের বোধকে পাল্টে দেওয়া সম্ভব। বস্তুর বোধ থেকে অনুভবে পৌঁছনোটা খুব জরুরি। অনুভবই প্রথম স্পর্শ। বস্তুর একটা তরঙ্গসূত্র রয়েছে। যেখান থেকে কার্যকারণ সম্পর্কের মাধ্যমে পাঠকের পাঠ শুরু হয়। যা অনুভবকে জাগিয়ে তোলে। মূলত সেই ধ্বনি। ধ্বনি থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়, আলো থেকে রঙ, রস, বর্ণ, গন্ধ। সব মিলিয়ে এক একটা চিত্রের গড়ে ওঠা। সেই কাল্পনিক চিত্র স্নায়ুকে জাগায়। এজন্যই বলা হয় কবিতা হলো কাল্পনিক অভিজ্ঞতার ফসল।

আমরা আগেও বলতে চেয়েছি, যেকোনও সৃষ্টির মূলে থাকে তুমুল অস্থিরতা। অস্থিরতার আলোড়ন। সৃষ্টির আগের মুহূর্তে সবকিছু বিশৃঙ্খল হতে থাকে। সেই বিশৃঙ্খলা, অবিন্যস্ততার ভেতর থেকে কবির শব্দরা আসে। তাকে সাজিয়ে তোলাই কবির কাজ। কালিক বাস্তবতায় প্রতিটি সময়ের অস্থিরতা তার ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করে। ফলে শব্দের চলন বদলায়। কবিতার ভাষা বদলায়, আঙ্গিক বদলায়। প্রতি মুহূর্তে কবির সত্তায় এক একটি দৃশ্যের জন্ম হয়। একটি দৃশ্য থেকে আরেকটি দৃশ্যের জন্ম হওয়াকে কবি ধরেন বোধের আলোড়ন দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় দৃশ্য এবং বোধ ক্রমাগত জায়গা বদল করতে চায়। ভাষার নতুন বিন্যাস খোঁজে। প্ররোচিত করে।

যেমন পরাবাস্তব কবিতার যাত্রা পর্যন্ত আমরা লক্ষ্য করেছি কবিতা ক্রমশ আখ্যানের আশ্রয় ছেড়ে খণ্ড খণ্ড অনুভূতির স্ফূরণ হয়ে উঠছে। পাশাপাশি মিথ ভেঙে নতুন মিথ নির্মাণের দিকে একটা প্রবণতার জন্ম হয়েছে। তখন আখ্যানের বদলে দীর্ঘ বা মহাকবিতা লেখার ঝোঁক অনেকের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়া টানা গদ্যে লেখা শুরু হয়েছে এবং অন্ত্যমিলের প্রাধান্য থাকছে না। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগচেতনা  ইতিহাস ছুঁয়ে নতুন সমাজচেতনার উদ্ভাসগুলো ফুটিয়ে তুলতে চাইছে

আমরা এও লক্ষ্য করলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কবিতার চেতনকাঠামো ও প্রযুক্তির বদল ঘটছে। গত শতকের ষাটের দশকের আন্দোলনগুলো আঙ্গিক ও প্রকরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে নিদর্শন দেখিয়েছিলো, বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব অস্বীকার করার নয়। জীবনানন্দ অনুভব করেছিলেন একজন কবির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকাটা বিশেষ জরুরি। স্বাভাবিক জ্ঞানে আমরাও অনুভব করলাম মৌলিক হওয়ার চেতনা ছাড়া পৃথিবীর কেউ নতুন পথ দেখাতে পারেনা। এই চেতনাই বিজ্ঞান। কবিতায় বিজ্ঞান আসে চেতনার মাধ্যমেই। বিজ্ঞান যেহেতু জীবনকে চালিত করে, অধিকাংশ ভাবনাও এগিয়ে যায় বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গী নিয়ে। কবিতায় ভাষার প্রযুক্তিও বিজ্ঞান। যেমন অণু-পরমাণুর গঠন, তাদের সম্পর্ক, বস্তুর অবস্থান – এসব নিয়েই কবিতা এগিয়ে চলে।

আমরা শুরুতেই বলতে চেয়েছি সামাজিক জীবন এবং কবির জীবন –এই দুইয়ে মিলে সৃষ্টির ভুবন। এই দুটিকে মেলানোই এক কঠিন কাজ। সকলেই স্রষ্টা নন। সকলে কবিও নন। তাহলে কবি কে? –এও এক কঠিন প্রশ্ন। বিতর্কিতও বটে। সবার সঙ্গে সবার মতের মিল হবেই সেটা দাবি করা যায় না। এই প্রসঙ্গে গৌরীদেবীর কথা মনে পড়ছে। গৌরী ধর্মপাল। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, কবি তিনিই "যিনি সবার সঙ্গে প্রায়-এক, এবং সর্বমিলনের আনন্দপুলক, পুরোপুরি-মিলতে-পারার বেদনার সঙ্গে মেশামেশি হয়ে, যাঁর হৃদয় থেকে, আত্মার, সত্তার গভীরতম প্রদেশ থেকে এক আশ্চর্য অ-লৌকিক তরঙ্গিত ভাষা হয়ে বেরিয়ে আসে"

লক্ষ্য করার, এই 'প্রায়-এক' শব্দবন্ধ গৌরী দেবী ব্যবহার করেছিলেন এবং পুরোপুরি মিলতে না পারার বেদনার কথাও বলেছেন। এভাবে আশ্চর্য এক অনুভূতির গভীরে তিনি ঠেলে দিলেন। এভাবে সবাই কি দেখতে পান! একজন কবি যখন লিখতে বসেন তখন সৃষ্টির সমস্ত আলোড়ন তাকে একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করায়। প্রথম পংক্তিটি এলো, তারপর ক্রমশ সত্তা তাঁকে টেনে চলেছে আত্মভ্রমণের পথ ধরে অনির্ণেয়তার দিকে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো তিনি যা লিখতে চেয়েছিলেন আর যা লিখলেন তা এক নয়। কোনোদিনই যেন লেখা হয়ে ওঠে না সেই কবিতাটি। ফলে অস্তিত্বের সন্ধানও কখনও শেষ হয় না। যা তিনি লিখে উঠলেন পাঠকও তার সবটুকু উদ্ধার করতে পারেন না বলে প্রতি পাঠে নতুন নতুন রহস্যের দিক উন্মোচিত হয়। কবিতার সার্থকতা সেখানেই। ক্রমাগত রক্তাক্ত হচ্ছে আত্মভ্রমণের পথ। আর আর্ত হয়ে ঝরে পড়ছে 'অ-লৌকিক তরঙ্গিত ভাষা'

যাবতীয় গতানুগতিকতার অতিক্রমণ ঘটে প্রসারিত চেতনার নির্দেশে। ভাবনার পাল্টে যাওয়া থাকে মূল্যবোধের তাড়নার মধ্যে। তাকে সংস্কার দিয়ে বাঁধলে ভাষার প্রসার এবং সম্ভাবনা দুই-ই থেমে থাকতে পারে। অর্থাৎ নতুন ভাষার উদ্ভব সম্ভব নয়। সংস্কৃতি যেহেতু সময়ের দাসত্ব করে না, তাই চেতনার নির্দেশ তার কাছে সবার আগে পৌঁছায়। তারপর অন্তর্জগতের আলোড়ন থেকে প্রকাশিত হয় বিমূর্ত সৌন্দর্য। বিশ্বসংসার তড়িৎ চুম্বকের তরঙ্গে ভাসছে। প্রতিটি ঢেউ অতিক্রম করতে চায় প্রতি মুহূর্তের বর্তমানকে।

অস্তিত্বকে অনুভব করা যায়, কিন্তু বর্ণনা করা যায় না। এই অবর্ণনীয় অস্তিত্বের সন্ধানেই একজন কবিকে হেঁটে যেতে হয় সারাটা জীবন কাঁটা বেছানো পথ ধরে। কারণ সময়কে অতিক্রমের পথ কখনও মসৃণ নয়। বারীন ঘোষাল ভেবেছিলেন, "যে কোন শিল্প মাধ্যমেই অনুভূতি ও কাল্পনিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ গঠিত ও নির্মিত হয়ে থাকে। রূপে গুণে সজ্জিত হয়ে থাকে। নির্মাণ সম্পূর্ণ হবার পর তাতে রূপ গুণ আরোপ করা যায় না। নির্মাণ চলাকালীনই রূপ গুণ মিশতে থাকে তাতে। শিল্পী সচেতনভাবে একাজটা করেন না। তাই মনে হয় শিল্পীর ভেতরেই আছে সেই ছবি যা তিনি বাইরে নিয়ে আসেন, পুনর্গঠন করেন" (কবিতা ধারার মুক্তি)

পাঠক ভেবে দেখতে পারেন। সৃষ্টির আলোড়ন এখানেই। সমাজসত্যের বাইরের রূপটি যেমন তাকে যদি আমরা কার্যকারণ সম্পর্কের ভেতর থেকে না দেখি তাহলে বোঝা যাবে না যে ঘটনা বাহ্যরূপে নেই। নিহিত যে সত্য তাকে উদঘাটনের জন্যেই এতো এতো কথা। এপথে যার প্রথম পদধ্বনি শোনা যায় সে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা। সে নিজেকে আঘাত করে আরও ভেতরকে জাগায়। আমাদের বুঝতে হবে এইমাত্র যে বর্তমান অতীত হলো, তার মধ্যেও বাস্তব রয়েছে। আর সেই বাস্তবতার হাত ধরে আমাদের হেঁটে যেতে হবে আরেক বাস্তবের দিকে যা আগামীর ভবিষ্যৎ। এভাবেই স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ মেলাতে মেলাতে আমাদের নিরাসক্ত হেঁটে যাওয়া। যে চলার কোনও শেষ নেই। অস্তিত্বের স্বজ্ঞার জন্যে নিরাসক্ত হওয়া ছাড়া লেখকের আর কিছু চাওয়া নেই। এতো এতো কলকল্লোলের মধ্যে কবি শুধু নৈঃশব্দ্যকে লেখেন। যে জীবন কবির জীবন। একান্ত তাঁর নিজের। নিজের সত্তার খোঁজে আত্মার নির্দেশে হেঁটে যাওয়া পথ কবির একার।

 

 

 

 


2 কমেন্টস্:

  1. আত্মপাঠের লেখা । দারুণ মন্থন করছে শব্দে

    উত্তরমুছুন
  2. অনেকদিন পর চিত্তদার লেখা পড়লাম। বলা ভাল, অনেক বছর পর। পাঠ অভিজ্ঞতা মনোরম। বিশেষ করে প্রথম অনুচ্ছেদ থেকে পাঠকের মনোরঞ্জনে মসৃন যাত্রা। তবে কয়েকটা কথা বলতে চাই। এক, বারীনদা সেই ‘সৎকার’ থেকে অতিচেতনার কথা যখন বলতে থাকেন, উনি এক নিঃশব্দ বিপ্লব শুরু করেন - যতিচিহ্নহীন কবিতা। ফলে পাঠকের কাছে কবিতার স্পেস অনেক বড় হয়ে যায়। দুই, বারীনদার কবিতায় প্রতি শব্দ, প্রতি ধ্বনি কানের স্বাভাবিক ছন্দে উঠে আসে। এবং আরোপিত সমস্ত শেকল বর্জন হয়ে যায়। বাকি সব কথা চিত্তদা বলে দিয়েছেন। বাংলা কবিতার ব্যাকরণ দিকপালরা বারীনদার এই অবদান মাথা নামিয়ে স্বীকার করবেন কি - কে জানে? অভিজিৎ

    উত্তরমুছুন