কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল




 

(১৯)

হর্ষ নিজের মত পালটায়, মাথা থেকে সমস্ত অস্বস্তি ঠেলে সরায়। ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই, অদিতি নিজে থেকে আবার ফোন করলে ভাবা যাবে। ফোনটা পাশে রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সে – অযাচিত টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত হচ্ছে। মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটছে। সে ঘড়ি দেখে। সুমিত গর্গ ফোন করেছিল আধাঘন্টা হয়নি। ইচ্ছে করলে এখনও যাওয়া যায় ওদের দারু-পার্টিতে। মদ খেয়ে এলে তেড়ে ঘুম পায় হর্ষর, টিপসি হয়ে এসে কোনোরকমে ফ্ল্যাটে পৌঁছতে পারলে নিরুপদ্রব নিদ্রা। সরু-মোটা সোজাব্যাঁকা জটিল দাগগুলো কুটকুট করছে। গা-মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে হর্ষ ওঠে। বারমুডার ওপরে লাল-কালো মেলানো রঙের একটা টী-শার্ট পরে। ওয়ার্ড্রোবে-সাঁটা লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কলকাতা থেকে আসার আগে মা কিনে দিয়েছিল। একা গিয়ে পছন্দ করে নিয়ে এসেছিল কোন মল্‌ থেকে - আন্দাজেই দারুণ ফিটিং! হর্ষ নিষ্পলকে আয়নায় জামাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিঃশব্দে মা তাকে ঘিরে আছে সব সময়ে। এবারে কলকাতা গিয়েও মা-র কাছে অদিতির কথা বলতে পারেনি। হর্ষ চমকে ওঠে— ঘুরে-ফিরে একই আবর্তে পাক খাচ্ছে ক্রমাগত! কলকাতা যাওয়ার আগে অদিতি তার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল।

মা তাকে হাল্কাভাবে জিজ্ঞেস করেছে, স্যালারি-হাইক, নিজস্ব পছন্দের কেউ আছে কি না, তিরিশ হয়ে গেছে, আর কত লেট্‌ করবে হর্ষ — ইত্যাদি। মা-র কাছে গোপন করার মতো বলতে ড্রিঙ্ক-করা। বাবা আগে অল্প-বিস্তর করত। মা-র পছন্দ ছিল না, প্রতিবাদ না করে থমথমে মুখে মেনে নিত। ধীরে-ধীরে বাবা ছেড়ে দেয়। হর্ষ সেজন্যে আর জানায় নি। জানলে হয়ত মা বলত,

--তুই আর তোর বউ বুঝবি। আমার কী বলার আছে?

বেশী রেগে গেলে মা-র সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়। সেই অবস্থাটা শিশুবেলা থেকে হর্ষ ভয় পায়, তার বাবাও।

হঠাৎ হর্ষ বোঝে লাল টী-শার্ট দেখার উদ্দেশ্যে আয়নায় দাঁড়িয়ে আধঘন্টা ধরে সে কলকাতার ফ্ল্যাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শক্ত মুঠো পাকিয়ে নিজের গালে বারদুই ঘুষি মারে– শাল্লা, গ্রোন-আপ ইডিয়ট! এখনো হোম-সিকনেস? এতবছর বাইরে থাকার পরেও?

এরকম এককযাপন একঘেয়ে বিরস হয়ে উঠছে! অথবা তার ভয়ানক অগোছালো ওয়ান বি-এচ্‌-কে, ভয়ানকভাবে নিজের মতো বাঁচা, বন্ধুসঙ্গ, যথেচ্ছ মদ্যপান ছেড়ে নরম আঁচল বা ওড়নার আধিপত্যে আত্মসমর্পনের গোপন আকুতি! মা-র কোনো নয়ডাবাসী বান্ধবীর মেয়ের ব্যাপারে আভাস দিচ্ছিল মা। বলছিল, হর্ষ রাজী হলে যোগাযোগ করবে। হর্ষ সব গুলিয়ে ফেলে, কিচ্ছু ভাবতে না পেরে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে,

--মা, বেটার ইউ ডিসাইড!

শীত পড়ছে। লিপিকার হঠাৎ প্রবল ঠাণ্ডা লেগে গেছে। চাপা জ্বর, অনবরত নাক থেকে জলের ধারা। নিজের অসুস্থতায় তার মানসিক দুশ্চিন্তা বেশী হয়। শোভনের উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি থেকে সরে থাকার চেষ্টা করে। ছোঁয়াচে সর্দি-জ্বর, রাতে এক-ঘরে না শোওয়া ভালো। শোভন ইদানিং মোটামুটি ভালো আছে। দুপুরের পরে প্যারাসিটামল চার্জ করে ছটফট করতে করতে ছেলের ঘরে বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে লিপিকা। ঘুম ভেঙে আধো-চোখ খুলে আবছায়াতে দেখে মাথার পাশে চুপ করে শোভন বসে। আরামের নিঃশ্বাস ফেলে আলগোছে শোভনের কোলে হাতটা তুলে দিয়ে বলে,

--কিগো ডাকো নি? ঘুটঘুটে হয়ে গেল! চা-টা খাওয়া হয়নি এখনও।

শোভন অন্ধকারে হাসে,

--শুয়ে থাকো— অসুখ শরীর তোমার, তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারি। চা করব ভাবছিলাম, তুমি বকাবকি করবে তাই—।

--ভালো করেছো। এখন ঠিক লাগছে, মাথাটা ভার ভার। বোসো এখানেই, চা করে আনি।

শোভন কিছু বলে না। লিপিকা বাথরুম থেকে পরিষ্কার হয়ে এসে ঘরের আলোগুলো জ্বেলে দেয়। আদা-তুলসীপাতা দিয়ে মনের মতো করে দু-কাপ চা বানিয়ে এনে চাদরে হাত-পা মুড়ে বসে। গল্প করে টুকিটাকি। এর-ওর বিষয়ে দু-চারটে ছাড়া বিশেষ কোনো কথা থাকেও না। তবু এরকম না ছুঁয়ে পাশাপাশি বসার মধ্যে গরম ভাত মাখন দিয়ে মেখে খাওয়ার উষ্ণতা। শোভন চুমুক দিয়ে বলে,

--আঃ!

--শীতকালটা ভাবছি রাতে রুটি করবো ক-খানা। ঝরঝরে লাগবে। তোমার অসুবিধে হবে?

--না না। সব চলবে।

--সে জানি। তাও সহ্য না হলে বোলো, ভাত করে দেবো।

--জানো আজ ঘুম থেকে উঠে ছবিটা শেষ করলাম। দেখবে?

--নতুন ছবি?

--নতুন? কী জানি! মনে তো হয় খুব পুরোনো কবেকার – কিন্তু রঙপেন্সিল হাতে নিলে ওখানে টেনে নিয়ে যায়।

শোভন চা শেষ করে ঘর থেকে খাতা এনে লিপিকার সামনে মেলে ধরে। বেশ রঙচঙে একটা ছবি স্কেচ করা।

শোভনের সামনে কলোনির ধুলোভরা রোগা পথ। দাদা বিজু সাইকেল হাফ-প্যাডেলে চালাচ্ছে। ডিগডিগে পায়ে তিরবেগে পেছনে দৌড়ে আসছে শোভন। মাথার ওপরে চকচকে আকাশে হাসিমুখ স্বাস্থ্যবান সাদামেঘ সাঁতার। কলোনির ব্যাঁকা রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে সরু বাঁশের সাঁকো, একটু নড়বড়ে। নীচে ক্ষীণাকৃতি খাল।

সাঁকোর ওপরে চড়লে শোভনের বুকের ভেতরে ফুলে ওঠে, উচ্চতা বেড়ে যায়। বিরাট বড়ো হয়ে গেছে বলে মনে হয়। ওরকম হাফ-প্যাডেলে চেষ্টা করে চালাতে সে-ও পারে, দাদা দেয় না। সাইকেলটা বাবার, বাবা এবারে নতুন কিনেছে বলে পুরোনোটা দাদাকে দিয়েছে। দাদা লেখা-পড়ায় খুব ভালো।

দাদার ট্রাই-সাইকেল সে চালিয়েছে, এখন রঞ্জু চালায়। সাঁকোটা পেরিয়ে ওধারে কম্পানির কলোনি শেষ, প্রাইভেট বসতি। অতদূর যাওয়ার অনুমতি নেই। বাঁশের সাঁকোতে চড়ার ব্যাপারেও বাবার বারণ আছে। অতএব সাঁকোর মুখে এসে বিজু নামে, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে সোজা হয়ে গলা উঁচু করে ওধারটা দেখে। ততক্ষণে হাওয়ায় বাঁশপাতা উড়ে আসার মতো করে পেছনে এসেছে শোভন,

--কী দেখছিস রে দাদা?

--কিছু না। চল।

দাদা সাইকেল ঘুরিয়ে নেয়। আশে-পাশের শিউলি, ছাতিমের গন্ধে বাতাস ভারী। আগাছের ঝোপগুলোতে পুটুস আর অজস্র কাশ। বিজু, শোভু দুজনের গায়েই চেক্‌-কাটা জামা, কালো হাফ-প্যান্ট। বিজুর চটিটা চামড়ার। শোভুর পায়ের হাওয়াই চটিটার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যাওয়ার অপেক্ষা। ছিঁড়ে গেলে হাতে নিয়ে খালি-পায়ে ফিরতে হবে। বাবা অফিস-ফেরত বাজার থেকে স্ট্র্যাপ কিনে নিয়ে আসবে। ছেঁড়াটা ফেলে দিয়ে সাবান আর লোহার রড গুঁতিয়ে নিজেই নতুনটা ভরে দেবে। শোভন দৌড়ে এসেছে বলে পা ধুলোয় সাদা। লম্বা ঘাস থেকে প্যাণ্টে চোরকাঁটা আটকে গেছে। বড়ো খোলা মাঠটার সামনে এসে দু-ভাই থামে। শেষপ্রান্তে কম্পানি থেকে বেদী করে দেওয়া আছে। বছরভর পুজো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছোটোদের বসে আঁকো, আবৃত্তি, ক্যারাম প্রতিযোগিতা এখানেই হয়। বেদী লোহার গ্রিলের ঘেরা, গ্রিলবন্দী দুর্গাঠাকুরের খড়ের কাঠামো এখন একমেটে।

স্কুল ছুটি হতে দেরী আছে। কিন্তু দিনের মধ্যে একবার অন্তত এখানে এসে না ঘুরে গেলে ভালো লাগে না।কল্যান, সুদীপ্ত, অসীম, বিমলেন্দুরাও দেখতে এসেছে।

(ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন