কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

শতাব্দী দাশ

 


কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০০


শূন্যপুর ৮


বুলি আজ রাতের আকাশ দেখবে। আজ কি জোছনা ঢালবে চাঁদ? পুন্নিমা কবে, মাগো? আসমানে প্রশ্নচিহ্নটা থাকবে আজ?

বাইরে দাঁড়িয়ে উমিদ মিঞা, যাকে বুলি বাপ বলে জানে। আর বইমামু। বইমামু অ-য় অজগর বই দিয়েছিল। তারপর যোগ-বিয়োগের বই। বলেছিল, আকাশে প্রশ্নচিহ্ন খুঁজে বের করতে। সাত-তারার প্রশ্নচিহ্ন। আকাশ দেখতে চাইলে মা  কাঁদত। ক্যামনে দেখাবে আট-ছয় ঘরে? ছাত আছে। সিঁড়ি চড়া মানা।  

বাপও কাঁদত যখন-তখন। গরাদের শিকে মা আর বাপের আঙুল ছোঁয়াছুঁয়ি  করত, যেন দুইপোকা চুমো খাচ্ছে আশ্লেষে। জ্ঞান হওয়া ইস্তক এ-কান্না, ছোঁয়াছুঁয়ি দেখেছে বুলি অবরে সবরে। মা বলত, মাসিক দেখতে আসবে, অত পয়সা কই বাপের? তাবলে বুলি যেন না ভোলে, বাপ ভালোবাসে তারে।

বরং প্রায়ই আসত বইমামু। কখনও সখনও কালো কোট উকিল। উকিল টিপছাপ নিত। নানা কথা বোঝাত মা’কে। বইমামু গল্প করত বুলির সাথে।  জোছনারাতের কথা। তারাদের খেলাধুলো। তারা-রা নাকি নানা আকার নেয়। কিংবা আসলে নেয় না। মানুষ ভেবে নেয় নানারূপ, বাঁধে নানাগল্প। ভাবনা বেঁচে-বর্তে থাকলে, এমনকি বুলিও স্বাধীন। ভাবা যায়?

জন্মে ইস্তক ক্যাম্পের বাহির দেখেনি যে বুলি। মা বলে, টলমল হাঁটত ক্যাম্পের চৌহদ্দিতে। চাচা-ফুফু জুটেছিল অনেক। তারাদের গল্প শোনাত আধো-উচ্চারণে।   না-দেখা তারারা। সন্ধে বাজলে  আট-বাই-ছয়ে সেঁধুতে হত।

রাতের আকাশ চেয়ে হাত-পা ছুঁড়ত বুলি। তারা দিয়ে আকাশের গায়ে ইচ্ছে  মতো আঁকতে চাইত কুকুর-পাখি-বাড়ি। খুঁজতে চাইত প্রশ্নচিহ্নটাকে। কী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সে?

ওয়ার্ডেন মাসিকে মা রাজি করিয়েছিল। এক সন্ধ্যায় ছাতের বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়য়েছিল তারা। মাসি বলেছিল, চাঁদ উঠলে দরজা খুলে দেবে। এখনই কেন নয়? তারা-রা তো আছে! আহা, চাঁদ উঠলে চাঁদ-তারা একসঙ্গে দেখা যাবে  যে! সময় পাঁচ মিনিট বৈ তো নয়। মেঘ গরজাচ্ছিল। মাসির দীর্ঘশ্বাস ঘনঘন। আজ বোধহয় হল না। দরজার ফাঁক দিয়ে বিদ্যুতের বিদ্রুপ। ঘন ঘন পায়ের আওয়াজ সিঁড়ির তলায়। মাসি অস্থির হচ্ছিল। এ আকাশ কি চোরাইমাল? এ আকাশ কি অন্য দেশের? লুকিয়ে ভাগ বসাচ্ছে বুলি? উত্তেজনা থিতিয়ে আসছিল। লজ্জা হচ্ছিল। শেষপর্যন্ত নেমে এসেছিল বন্দী ও সান্ত্রী।

আজ আকাশ দেখবে বুলবুলি। তারাদের দেখবে। বাপ মাঠে নিয়ে যাবে তারে। অটোয় ফিরতে ফিরতে বাপের গায়ে এলিয়ে তারাদের গল্প শুনছে বুলি। অটোর পর বাস। তারপর আবার বাস। তারপর মাইলটাক হেঁটে বাড়ি। যে বাড়ি বুলি দেখেনি কখনো। পোয়াতি মা গিয়েছিল ডিটেনশন ক্যাম্পে কাগজের ফেরে। সাতবছর পর। একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ... সাতে ঋষি, সাতে সপ্তর্ষিমণ্ডল, সাত বছরে জামিন। সাতটি তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় কাকে? কী প্রশ্ন?

বইমামু তখন বলছে মাকে অনর্গল, সাতবছর জেলে নষ্ট! বলো কী হে! আমরা  সবাই কি জেলে নেই? আমরা কি স্বাধীন নাকি? ক্যাম্প, জেল, সে তো জেলের ভিতর জেল!

ঘুমে এলিয়ে পড়ছে বুলি। জামিন হল, নাকি হল না? আসলে স্বাধীন কে… আকাশ কি স্বাধীন...কোন দেশের আকাশকে নিজস্ব বলা যায়...আর ওই প্রশ্নচিহ্নটা…

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন