কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯১ |
উনিশ বছর পর
সেই মর্মন্তুদ ঘটনার পরে প্রথম ক’বছর শোকে-ক্ষোভে দিনটিকে স্মরণ করত পুরুষ। পরে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাইয়ে খুঁজেছে গূঢ় কারণ। নথি ঘেঁটে নানা অনাচারে পার পাওয়া পুরুষদের শাস্তি নিশ্চিত করেছে। অতঃপর ভরা সভায় পুরুষ ঐকমত্যে পৌঁছেছে: নারীকে সে ‘মানুষ’ ভাবেনি কোনোকালে।
সেবারের বর্ষাও ছিল এমন বৃষ্টিময়। আকাশের বায়নাতেই ঘোর বরিষণ কিংবা রোদ্দুর। তবুও ছাতা নিতে ভুলত লোকজন। মেয়েটা সেইদিন ঐ গাছের নিচেই নেমেছিল বাস থেকে। ছুটে রাস্তা পার হয়েছিল। লিয়াকত তখন কেন্টিলিভার ঘেঁষে রিক্সার অপেক্ষায়। মেয়েটা সিঁড়ি টপকাতেই ভিজে একশা। ওর ওড়না লেপ্টে ছিল বুকে। সব ক’টা চোখ ওকে চাখছিল। লিয়াকতের দিকেই এগিয়ে এল সে। ব্যাগ থেকে চিরকুট বার করে ভিজে হাতে বাড়িয়ে ধরেছিল ঠিকানা। দুটো গলি দু-ধারে, কোন গলিতে এই বাড়ি জানতে চাইল সহজ গলায়। কোণে দাঁড়ানো রতনের চোখে চোখ পড়েছিল লিয়াকতের। মহল্লার সব দোকান রতনকে চাঁদা দেয়। রিক্সাটা যেন আশির্বাদ হয়ে উদয় হয়েছিল। ‘জানি না’, বলেই উঠে পড়েছিল রিকশায়। বুঝতে পারছিল হতভম্ভ মেয়েটা দেখছে ওকে। তিনদিন পরে মেয়েটার লাশ গন্ধ ছেড়েছিল রহমান সাহেবের পাতকুয়ায়।
নারী-নির্যাতনের নানান সংবাদে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মানুষ। সেই ভোরেও পত্রিকা জুড়ে ছিল ধর্ষণের খবর। বাড়ির পুরুষ বোঝেনি ঘুম ভাঙে-নি নয়, চিরঘুমে ঘুমায় কন্যা-জায়া-জননী… সকল নারী!
ক্রমশ জ্ঞাত হলো - একই দিনে একই সময়ে নারীশূন্য হয়েছে বিশ্ব।
আজ সেই দিন। লিয়াকত আজ এই চায়ের দোকানে বসেই কাটাবে। আজ এই শহরের পুরুষেরা বাড়ি ফিরবে না। দোকানে ঠাঁই নেই কিন্তু চারপাশ বড় বেশি নিস্তব্ধ, যেন বরফের নিচে জমে আছে মরা মাছ। হঠাৎ চোখ যায় অদূরে লাইটপোস্টের নিচে, কী আশ্চর্য! একটা একলা মেয়ে!
চোখ সরু করে ফের দেখে লিয়াকত। বৃষ্টির প্রকোপে মেয়েটাকে ঘষা কাচের ভেতর দেখার মতোই ঝাপসা লাগছে, তবুও এই ঋজুতা লিয়াকতের ভীষণ চেনা। লিয়াকত বেরিয়ে আসে। ল্যাম্পপোস্টের তারে মুক্তোমালার মতো বৃষ্টির জল ঝুলছে; মেয়েটা সেদিকে তাকিয়ে হাসছে খিলখিল। সেই হাসি বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে সবার কানে পৌঁছে গেল কীভাবে যেন! দোকান ছেড়ে অন্যেরাও নেমে এলো বাইরে। অমনি মেয়েটা হাত ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে এগোলো ওদের দিকে। ওর গায়ের রঙে মেঘলা আকাশ, পরনের পোশাক যেন জলের সবুজ। শরীরের বাঁক ঈশ্বরের নিজ হাতে গড়া। মেয়েটার গা থেকে এক এক করে পোশাক খসে পড়ে। মেয়েটার শ্যামলা স্তন মোমের মসৃণতা নিয়ে আকাশমুখি হলে উনিশ বছর আগের মাতৃহারা যুবকেরা মায়ের জন্য বুক ভেঙে কাঁদে। মেয়েটার নাভিমূল থেকে চন্দন সুবাস পাক খেয়ে উঠে কন্যাহারা পিতাদের বুকে মাতম তোলে। ওর জঙ্ঘার ঘর্ষণে আগুনের ফুলকির জৌলুসে হারানো সঙ্গীর জন্য বুকের পাঁজর ভাঙে অনেকের। লিয়াকত হাত জোড় করে মিনতি করে, ‘ক্ষমা কর। ফিরে এসো’-
মেয়েটা আনমনে ঘুরে ঘুরে নাচতেই থাকে…
ওর নগ্নতা জ্যোৎস্নার মতো চারপাশে স্নিগ্ধতা ছড়ায়। দন্ডায়মান সকল পুরুষ বিস্ময়ে আবিষ্কার করে, নারীমাংস নয়, ওরা দেখছে ঈশ্বরের দীর্ঘ পোশাক…
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনকী দারুন লেখাই না পড়লাম, খুব ভাবিয়ে তুললো মন এটা পড়ে।
উত্তরমুছুনআমার অবাক মন আলোড়িত হতে লাগলো শেষ লাইন দুটোর দাবি নিয়ে - "ওর নগ্নতা জ্যোৎস্নার মতো চারপাশে স্নিগ্ধতা ছড়ায়। দন্ডায়মান সকল পুরুষ বিস্ময়ে আবিষ্কার করে, নারীমাংস নয়, ওরা দেখছে ঈশ্বরের দীর্ঘ পোশাক…"
তবু লেখক এক ক্ষমার ডালি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন আর একবার পুরুষ ঐতিহ্যের কাছে সৃষ্টির বীজ নিয়ে। তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর! স্নিগ্ধতা বিছিয়ে নিয়ে আসুক ভালোবাসার অনাবিল প্রাঙ্গনে প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে। এস আনন্দে, এস সুরে, এস অসীম গভীরের চিরন্তন ডাকে, এসে দাঁড়াও তোমার ভালোবাসায় । কোন এক স্মৃতির কোল থেকে ভেসে আসা এই সুরই কী "ঈশ্বরের দীর্ঘ পোশাক" ?
লেখক রঞ্জনা ব্যানার্জী কে অভিনন্দন জানাই একটা বিশেষ মুহূর্ত কে তার লেখনীর মাঝে আবিষ্কার করে নেওয়াই। মনে করুন মিকেলএঞ্জেলোর সেই সিস্টিন চ্যাপেল এর এক অঙ্কন - ঈশ্বর তার হাত বাড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁতে চেষ্টা করছেন চিরকালের এক পুরুষ কে। জানি তুমি বারবার ভুল করছো এবং করবে, তবু এস আমায় গ্রহণ করো তোমার আনন্দে, তোমার সৃষ্টির মূর্ছনায়, তোমার ভালোবাসার অভিষেকে। তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর! এখনই অন্ধ-বন্ধ কোরোনা পাখা।
লেখক কে জানাই আমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ এই অপূর্ব পরিবেশনের জন্যে।