কবিরা খড়া বজার মেঁ -
১
--------------------------------
কবিরা
খড়া বজার মেঁ, মাঁগে সবকা খ্যয়ের ।
না
কাহুসে দোস্তি, না কাহুসে ব্যয়ের ।।
('বজার'
মানে মানে এই সমাজবিশ্ব। কবির সেখানে দাঁড়িয়ে সবার মঙ্গল কামনা করছে। তার সঙ্গে কারও
বন্ধুতা নেই, শত্রুতাও নেই কারও সঙ্গে।)
ছোটবেলায়
পড়া কবিরের অনেক দোহার থেকে এই দোহাটি আলাদা করে মনে থেকে গিয়েছিলো। নির্গুণ ভূমাদর্শনের
সব কথা এই কটা শব্দের মধ্যে ধরে ফেলা কবিরের পক্ষেই সম্ভব। বয়সের বিভিন্ন স্তরে এই
শব্দনির্মাণটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
---------------------------------
------------------------------
এই
সময়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখা যাক। দিল্লির সুলতান, বিখ্যাত বা কুখ্যাত তুর্কি মুহম্মদ
বিন তুঘলক আর নেই। নিহত হয়েছেন ভাই ফিরোজ শাহ
তুঘলকের হাতে। সেই ফিরোজ শাহ তুঘলকও মারা গেলেন ১৩৮৮ সালে। দিল্লির মসনদে প্রায়
রোজ রাজাবদল। সীমান্তের ওপারে বহুদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলেন তুর্কো-মোঙ্গল যুদ্ধব্যবসায়ী
তইমুর লংগ। ১৩৯৮ সালের শীতকালে তিনি আক্রমণ করলেন
দিল্লি। তৎকালীন সুলতান মাহমুদ শাহ পালিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু আট দিনের দিল্লি
অবরোধে এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হলো এবং লুণ্ঠিত হলো সব সম্পদ। একজন মুসলিম শাসকের
হাতে এতো মুসলিমের রক্তচিহ্ন বোধ হয় এদেশ প্রথম দেখেছিলো তখন। হিন্দু, হিন্দুর সঙ্গে
নেই, মুসলিম, মুসলমানের সঙ্গে নেই। মানুষ মানুষের সঙ্গে নেই। ইতিহাসের ঘোর অন্ধকার পর্ব শুরু হয়েছিলো সেদিন।
-----------------------------------------
বারাণসি
শহরের দক্ষিণে একটি প্রাচীন জলাশয় আছে। এই বিশাল সরোবরটির সঙ্গে কোনকালে গঙ্গার যোগসূত্র
ছিলো। নদীর মতো-ই এর জলে তরঙ্গ উঠতো এবং মানুষজনের কাছে এর পবিত্রতার খ্যাতিও শোনা
যেতো। তরঙ্গকে হিন্দিতে বলে লহর, আর ফার্সিতে জলাশয়কে বলে তাল, হিন্দিতে তা হয়ে যায়
তালাও। এই সরোবরটিকে লোকে বলতো লহরতাল, অপভ্রংশে লহরতারা। তার জলে ছিলো পদ্মবন আর শীতল
শান্তি। আজকের বারাণসী রেল স্টেশন
থেকে তিন কিমি মতো দক্ষিণে হবে।নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় আজ গঙ্গার জল আর সেখানে পৌঁছোয়না
। সরোবরের ব্যাপ্তি আর নেই।
একজন
মুসলিম তন্তুবায়, নাম আলি, ডাকনাম নিরু, বিয়ে করতে গিয়েছিলেন শহরের উপান্তে মান্দুর গাঁয়ে। এই মান্দুর আজকের
মডুয়াডিহ। নতুন বৌ নীমাকে নিয়ে দ্বিরাগমন করতে যাবার সময় লহরতালের ধারে একটি সদ্যোজাত
শিশুকে তাঁরা কুড়িয়ে পান। তার গর্ভধারিনীর কোনও খোঁজ নেই, দেখে মনে হয় উত্তমকুলে জন্ম। খোঁজাখুঁজি করেও যখন কোনও দাবিদার মেলেনা তখন এই
দম্পতি তাকে আল্লাহর আশীর্বাদ ভেবে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নীরুর তাঁতবাড়ি ছিলো লহরতারার
থেকে পাঁচ-ছ কিমি উত্তরে বরুণানদীর চৌকাঘাটের কাছে। সেখানে ছিলো একটা টিলার মতো উঁচু
জমি, মুহল্লা নরহরপুরা, সেখানেই দরিদ্র নিরুজোলার দরিদ্রতর গেরস্থালী। আজ তার নাম নিরুটিলা।
মৌলভি সাহেব সেই কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর নাম দেন ঈশ্বরের নামে, কবির। কবির বড়ো হয়ে ওঠেন
এই আবহে। বড়ো হবার পর তাঁর কাছে কেউ যখন বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইতো, তিনি বলতেন,
কবিরা
তেরি ঝোপড়ি
গলকট্টো
কে পাস ।
জো
করেগা সো ভরেগা
তুম
ক্যিঁউ হোত উদাস ।।
সেটা
ছিলো গলকট্টো অর্থাৎ কসাইদের টোলা। তারা ছাড়া থাকতো কিছু জুলাহা আর সস্তা গণিকা। শৈশব
থেকেই এই দরিদ্র মানুষগুলি ও তাদের কাদামাটির জীবনধারার সংস্পর্শে থেকে কবির বুঝতে
পেরেছিলেন পোষাকি ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মিকতার বহ্বাড়ম্বর এই সব দরিদ্র সংখ্যাগুরু মানুষদের
কাছে কতোটা মূল্যহীন।
----------------------------------
নরহরপুরায়
নিরুজোলার টিলার উপর ভাঙ্গাচোরা পর্ণকুটির আর পাশের একটা চবুতরা ছিলো কবিরের খাস দুনিয়া
। একটু বড়ো হবার পর তিনি পিতার সঙ্গে জাতব্যবসায় যোগ দেন। দিনের শেষে এই চবুতরাটিই
ছিলো সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে গল্পগুজবের ঠিকানা। এখানে বসেই কবির আশপাশের নিরক্ষর,
হতদরিদ্র, মানহীন শ্রমজীবীর দলকে আশ্বাস দিতেন তাদের মানুষজন্ম বৃথা নয়। তাদেরও ঈশ্বরলাভ
হতে পারে। ঈশ্বর শুধু ব্রাহ্মণ আর শেখসৈয়দের মৌরসিপট্টা নয়। দিনে দিনে কবিরের খ্যাতি
ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে মানুষের ভিড় নরহরপুরার পুরোনো চবুতরা ছাপিয়ে যায়। পাশে আর একটা নতুন
চবুতরা তৈরি করতে হয়। কবিরের নামে তার নাম হয় কবির চবুতরা। লোকমুখে সেই নাম কবিরচৌরা
হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই কবিরচৌরাতে বসেই
ধনীর আরও ধনলালসা দেখে ঈশ্বরের কাছে কবিরের আর্জি,
সাঁই
ইতনা দিজিয়ে
জা
ম্যঁয় কুটুম সমায় ।
ম্যঁয়
ভি ভুখা না রহুঁ
সাধো
ন ভুখা জায় ।।
আবার
ব্রাহ্মণ্য পন্ডিতদের আত্মগর্ব দেখে প্রচার করলেন তাঁর অমোঘ উক্তি,
পোথি
পড়ে পড়ে জগ মুয়া
পন্ডিত
বনেঁ ন কোয় ।
ঢাই
আখর প্রেম কা
পড়ে
সো পন্ডিত হোয় ।।
তাৎক্ষণিক
জাগতিক সাফল্যের আশায় অতৃপ্ত অসহিষ্ণু মূঢ়দের শোনালেন,
ধীরে
ধীরে রে মনা
ধীরে
সব কুছ হোয় ।
মালি
সিঁচে সও ঘড়া
রিত
আওয়ে ফল হোয় ।।
-----------------------------------------------
ইতিহাস যখন থেকে নিয়মানুগভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে, অর্থাৎ সপ্তম-অষ্টম শতকে, তার পরের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই শিশুটির আবির্ভাবের তথ্য সতত কুয়াশায় অন্তরালে। শুধু আবির্ভাবেই নয়, তাঁর তিরোভাবের তথ্যও রূপকথার রাজ্যের কথকতা। ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এতো পরস্পরবিরোধী যে এই মানুষটির সর্বসম্মত কোনও জীবনকথা এখনও পাওয়া যায়না। তাঁর জন্মসাল হিসেবে একবার বলা হয় ১৩৯৮, আবার কখনও ১৪৪০ বা ১৪৫৫ সন। তবে তিনি গুরু নানকের ( জন্ম ১৪৬৯) অনেক আগেই এসেছিলেন সেটা নিশ্চিত। গুরু নানকের 'জন্মসাক্ষি' পঞ্জী বেশ নিষ্ঠা সহকারে গ্রন্থিত আছে। সেখানে দেখছি তাঁর প্রথম দেশযাত্রা, যাকে শিখরা 'উদাসি' বলে থাকেন, সেটি ছিলো ১৫০০ থেকে ১৫০৭ সালের মধ্যে। এই সময়ই গুরু নানক বারাণসিতে সন্ত কবিরের সঙ্গ করেছিলেন। গুরু নানকের সঙ্গী ছিলেন ভাই মর্দানা, একজন মুসলিম। এর ঠিক আগেই ১৪৯৯ সালে গুরু নানকের ইষ্টদর্শন হয় এবং তিনি প্রচার করতে থাকেন, ঈশ্বর তাঁকে বলেছেন জগতে হিন্দুও নেই, মুসলমানও নেই, শুধু 'আমি' আছি। তাই নানক সমস্ত প্রচলিত ধর্মমতকে অস্বীকার করে 'ঈশ্বরের' শিষ্য হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন। শুধুমাত্র ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমেই যে মানুষের উত্তরণ ঘটে সেই আদর্শই তিনি সন ১৫০০ থেকে ১৫২৪ পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষ, তিব্বত, মধ্য এসিয়া, আরবদেশ ও শ্রীলংকায় প্রচার করেন। গুরু নানক যখন বারাণসিতে এসেছিলেন, তখন সন্ত কবিরের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা মধ্যগগনে। কারণ গুরু নানকের ধর্মমত যেসব সাধকের চিন্তন ও বোধিপুষ্ট, সন্ত কবির তার মধ্যে প্রধান। গুরু গ্রন্থসাহিবে সর্বাধিক গ্রন্থিত রচনা সন্ত কবিরের বাণী থেকেই সংগৃহীত। তাই ধরে নেওয়া যায় মোটামুটি ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে পরে হতে পারে। কিন্তু তিনি যে একদিন এদেশের মাটিতে বেঁচে ছিলেন, হেঁটে বেড়িয়েছেন, আর এদেশেই একদিন ঐহিক অস্তিত্ত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সামূহিক মানববিশ্বে লীন হয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ রয়ে গেছে তাঁর রচনাবলীতে আর লোকবিশ্বাসে।(ক্রমশ)
চমৎকার যথাযথ বিশ্লেষণ! পরের কিস্তির অপেক্ষা।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ..
মুছুন