কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

শাহনাজ নাসরীন

 

সমকালীন ছোটগল্প


ফেসবুক : ও বন্ধু আমার


আমার গায়ে একটা সুতো নেই। এই নগ্নতা নিয়ে আমি ছুটছি। চেষ্টা করছি কোনো রকমে পথটা পেরিয়ে বাসায় ঢুকে যেতে আর কিছু একটা পরে নিতে। কিন্তু তার আগেই যাদের থেকে লুকোনোর প্রাণপণ চেষ্টা, তাদের সামনে পড়ে যাচ্ছি। কেউ  দেখে ফেলার সেই ভয়, লজ্জা কী নির্মম তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে করতে ঘুম  ভাঙে। দেখি চোখ ভিজে গেছে কান্নায়, সারা গা ঘামে ভিজে জবজব করছে। আহ তবু শান্তি যে এ বাস্তব নয়, স্বপ্ন দেখছিলাম! একইসাথে শান্তি আর ভয় জড়িয়ে  রাখে। এমন একটা স্বপ্ন কেন দেখলাম, কোন দুর্ঘটনা ঘটবে কিনা সেই ভয়ে কুঁকড়ে যাই।

এরকম স্বপ্নের একটা ব্যাখ্যা জানালো বন্ধু মতো এক লেখক। বন্ধু মতো বলছি কারণ আমি খুব বন্ধু মনে করলেও সে কতটা মনে করে তা তো জানি না! সাহিত্য  সমাজে ভাগযোগ আছে। মুখ্য লেখক গৌণ লেখক আছে। মুখ্যরা গৌণদের সাথে খাতির করে না, রাখেও না। ফলে ছোট বড় কোন লেখকই আমাকে বন্ধু স্বীকার  করতে নারাজ। তারা প্রত্যেকেই পরিচয়ের পরপরই আমাকে ভুলে যান সম্ভবত। তাই যখনই দেখা হয়, নতুন করে পরিচয় দিতে হয়। একবার তো এক অনুষ্ঠানে  ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে দাওয়াত পেয়েছিলাম, তো সেখানে উপস্থিত এক  ফোকাসড নারী লেখক গ্রুপ ছবিতে আমার উপস্থিতি বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। তাকেও দোষ দিই না আমি। ইমেজ সচেতন হতেই হয়, নইলে ইমেজ ধরে রাখা  যায় না। এই ফেসবুকের যুগে সেজন্য খুব সাবধান হতে হয়। একটা ফালতু ছবি আপলোড হয়ে গেলে জাত যাবে তার। আমার মতো মানবেতর লেখকের সাথে তার মতো তারকা লেখকের ছবি কেন প্রকাশ পেলো, সেই জবাবদিহি করতে করতে জীবন যাওয়ার জোগাড় হবে তার। সুতরাং বেজার হবার জন্য দোষ তো দিতে পারি না!

আবার কিছু ধ্বজাধারী ওস্তাদ আছেন তাঁরা প্রথম শ্রেণি ও তৃতীয় শ্রেণি হিসেব করেন।  অতঃপর তাঁরা অবশ্য স্বতোপ্রণোদিত হয়েই নিজেদের হাত বা গলা বাড়িয়ে রাখেন, যেন তৃতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে গমনেচ্ছুরা সেই হাত ও গলা  আঁকড়ে ধরে প্রথমের দিকে যাত্রার অপার্থিব সিঁড়িগুলো অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু এমন বোকাচোদাও জগতে আছে, যারা কেবল কুলকিনারাহীন সাহিত্য  সরোবর মন্থনকেই জীবনের মোক্ষ মেনেছে। অন্যরা হয়তো বলবে, নিজে লাড্ডুগুড্ডু বলেই সফলদের এড়িয়ে চলে। ভীতু একটা! প্রতিভা নেই, সাহসও নেই। কথাটা  সত্যি। সাফল্যের ইঁদুর দৌঁড়ের নেতা হওয়ার চেয়ে কোন একটা চিপায় মুখ গুঁজে নিজের মতো যাপন করাতেই আনন্দ আমার। তাই নায়িকা না হয়ে এক্সট্রা হয়েই কেটে গেল অর্ধশতক। 

সাহিত্যচর্চায় গৌণ লেখক, ছোট লেখক, তৃতীয় শ্রেণির লেখক আমি  কেন এই স্বপ্ন দেখলাম?

বন্ধু বলেছে, ফ্রয়েড সাহেব বলেছেন সমাজের পদস্থ মানুষেরাই সাধারণত এরকম  স্বপ্ন দেখে। তাদের অবচেতনে সম্মানহানির একটা ভয় ঘাপটি মেরে থাকে, সেটাই স্বপ্নে এভাবে ভয় দেখায়। ব্যাখ্যাটা আমার মনোঃপুত হয়েছে। এখন যেন স্বপ্নটার একটা যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি মনে হচ্ছে। বাহান্নতম জন্মদিনের দিনটিতে আমি  বিশিষ্টতাবোধে আক্রান্ত হয়েছিলাম মনে হচ্ছে। বিশিষ্টদের জন্মদিনের মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বলন, কেক-কর্তন, উত্তরীয় দান, মানপত্র ও কবিতাপাঠ বা নৌবিহার, স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ এরকম কিছুই না থাকলেও ফেসবুকের কল্যাণে আমার জন্মদিনও এবার নীরব নিশ্চুপ ছিল না। এক বেলাতেই শ’দেড়েক মানুষ শুভেচ্ছা ও  শুভকামনা জানিয়েছে। আমার মতো গৌণ মানুষের জন্য এ এক বিশাল পাওয়া। খুশিতে আত্মহারা হয়ে আদেখলার মতো ডিগবাজি খেয়ে ফেলি আর কি!

আহা প্রিয় ফেসবুক, বন্ধু আমার! আজীবন ভুলে থাকা জন্মদিনটি তুমি ধ্বজাধারীদের ডিঙিয়ে বিশেষ দিন করে আমাকে উপহার দিলে! আর আমিও দেখতে দেখতে কেমন পুতুপুতু লেজবিশিষ্ট ভাব নিলাম! কিন্তু বন্ধু রাতের এই বীভৎস স্বপ্নের কী হবে? ন্যাংটো হয়ে পথে পথে ঘুরতে তো আমি রাজি নই। তার চে’ বেঁচে থাক নীরবতার রাজনীতি আর দলকানাদের প্রভুত্বে নিত্যনতুন কৌতুকের জন্ম হোক।

আমি চিড়িয়খানায় বেড়াতে ভালোবাসি, উদ্দীপ্ত হই।

 


1 কমেন্টস্: