কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

অম্লান বোস

 

এমন একটা মাণিক খুঁজে পেলাম…




“ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বন” – কিন্তু কোন বোঝাটা, সেটা কিন্তু এই আপ্তবাক্যটিতে বোঝা যায় না। মনের বোঝাপড়া, না কাঁধে টানার বোঝা? আমার ক্ষুদ্র মস্তিস্কের স্বল্প পরিসর এবং অপরিণত শারীরিক গঠনের জন্যে আমি কোন বোঝাই বইতে সক্ষম নই। তবে ভগবানই বোধহয় ‘ভাগ্যবান’ ঠাউরে আমার বোঝা টোঝা বয়েই দেন। অনেক ভাগ্যবানেরাই জীবনপথে চলার সময় মাঝে মধ্যে মণিমানিক্য পেয়ে যান, যা বেশিরভাগ মানুষই পান না, আবার পেলেও  কারও কারও চোখেই পড়ে না। ঐ যে, শিবপার্বতীর সেই গল্পটা মনে আছে?

পার্বতী মায়ের দয়ার শরীর। হিমালয়ের অন্তরীক্ষ থেকে নীচে এক গরীব ব্রাহ্মণকে দেখিয়ে বললেন, “মহাদেব, এই ব্রাহ্মণ তোমার একনিষ্ঠ ভক্ত, ভিক্ষে করে খায় আর সারাদিন তোমারই নামগান করে। তুমি ওকে কিছু ধনরত্ন পাইয়ে দাও না কেন?” শিবঠাকুর সবে কল্কেটাতে একটা জবর টান দিয়েছেন, এবারে নিমীলিত চোখে সরস একটা ঢোঁক গিলে ধোঁয়াটাকে ভেতরে চারিয়ে নিয়ে বললেন, “ওর যে কপালে নেই পার্বতী, ব্রহ্মদেব যে সেরকমই লিখে দিয়েছেন!” স্নেহময়ী পার্বতী জানেন শিবের অসাধ্য কিছুই নেই। আবদার ধরলেন আশুতোষ শিবের কাছে, “ঐ তো ও গঙ্গাস্নানে যাচ্ছে, দাও না কয়েকটা মোহর ঘাটে ফেলে, লোকজন তো এখনও আসে নি তেমন”। ভোলানাথ মহাদেব কথা রাখলেন।  কয়েকটা মোহর পডলো জলের ধারে, ওর পায়ের কাছে। আর তখনই ব্রাহ্মণের হঠাৎ কী যে মনে হল, সে ভাবলো, স্নানের আগে চোখ বন্ধ করে দেবতাকে স্মরণ  করে গঙ্গায় নামলে ফলটা অনেক ভালো হবে। আর তাই চোখবন্ধ, ধ্যানমগ্ন ব্রাহ্মণের চোখে পড়ার আগেই ঐ মোহরগুলো অন্য কোন সত্যিকারের আদর্শ এক ‘ভাগ্যবানের’ হাতে চলে গেল।

নানা ঘাত প্রতিঘাতে ধাক্কা খেয়ে বিপর্যস্ত আমি, নিজেকে কখনই সেরকম ভাগ্যবান মনে করি নি, তবে আমি কিন্তু ঐ বামুনের মত ভাগ্যহীনও নই। ওপরতলার কারসাজিতে আমার জীবনেও চলার পথে কিছু কিছু উজ্জ্বল  মণিমাণিকের ছ্বটায় আমি আলোকিত হয়েছি। দিল্লীর বিমানপথে এমনই এক অসামান্য ‘মাণিকের’ দেখা পেয়েছিলাম। ঐ বিশাল মহীরূহের শেকড়টা যে আমাদের এই মাটিকেই কামড়ে ধরে রেখেছে, মাথাটা আমাদের নাগালের বাইরে হলেও এই মাটিতেই দাঁড়িয়ে আমাদের হৃদয়ে সবুজ হাওয়ার পরশ দিতে, সেই অবিশ্বাস্য সত্যিটা বিস্ময়ে মনের পর্দায় শাশ্বত হয়ে ঝলমল করছে।

হ্যাঁ, মাণিকদা - সর্বজন পূজ্য, অতিসমাদৃত, ভারতীয় চিত্রজগতের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক এবং সরস্বতীর বরপুত্র শ্রীসত্যজিৎ রায়। যিনি সর্বকার্যে পারদর্শী হয়েও জীবনে একটি বিষয়েই বোধহয় কোনদিনই বাধা অতিক্রম করতে পারেননি!  কাউকেই মন খুলে বলতে পারেন নি, “তুমি আমার বিজয়ার ভালবাসা নিও।” কী করে বলবেন, ওনার জলজ্যান্ত বিদুষী, সুযোগ্যা সহধর্মিনীর নামই যে বিজয়া!

ঐরকম এক বিশাল প্রজ্জ্বলিত ব্যক্তিত্ব কারুরই চোখ এড়াবার মত নয়। সাদাসিধে বুশসার্ট আর খয়েরী ঘেঁষা ট্রাউজার। বিমানের সামনের দিকে দ্বিতীয় সারিতে মাঝের আসনে আসীন। হাতের কাগজপত্রের ওপর চোখদুটি নিবদ্ধ। পেছনে আমি তো উত্তেজনার আবেগে চনমন করছি। ভয় বা হৃদস্পন্দন নয়, শ্রদ্ধা মেশানো উদগ্র একটা কৌতূহল আমাকে পায়ে পায়ে টেনে নিয়ে গেল ওনার কাছে। দাঁড়ালাম পাশের আইলে সম্মানের দূরত্বটা রেখেই। তখন তো করোনা ভাইরাসের বাধ্যতা ছিল না। অতি পরিচিত গভীর চোখদুটির অতল দৃষ্টি আমার মুখের ওপর একটা জিজ্ঞাসু ঝাপটা দিল। মুখ সাধারণভাবেই গম্ভীর। বললাম,

“নমষ্কার। আমি অম্লান বোস। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি মি: রয়?”

আমার সাদা চুল, অখাদ্য মুখমন্ডল থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত ঐ সম্মোহনী চোখ দুটো এম আর আই-এর একটা আলতো অনিশ্চয়তা বুলিয়ে গেল। চোখে সোজা চোখ রেখেই বললেন, “আপনি কি জার্ণালিস্ট? কোনও কাগজ, ম্যাগাজিন বা দূরদর্শনের রিপোর্টার?”

“না না, আমি খুবই সাধারণ মানুষ, আপনার ভীষণ ভীষণ এ্যাডমায়ারার”।

ঠোঁটের দুর্ভেদ্য আঙ্গিকটা সঙ্গে সঙ্গে সরল হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পাশের সীট থেকে কাগজপত্রগুলি সরিয়ে জানলার সীটে রেখে বললেন, “বসুন”। গলার  সাধারণ নিরহঙ্কার আমন্ত্রণটা হৃদয় ছোঁয়া। ধন্য হয়ে গেলাম। বসে পড়লাম, সত্যি বলতে গেলে একটু কুন্ঠাভরেই, যেটা কোনদিনই আমার চরিত্রে নেই। ওনার মাথাটা হিমালয়ের মত প্রায় এক ফুট ঊঁচুতে। কুশল জানতে চাইলেন।  আমার চোখ মুখ তখন বিনীত, নির্বাক প্রশংসায় উদ্ভাসিত। ভেতরে ঢেউএর অসহ্য চাপটা সত্যি সত্যি বাঁধ ফাটিয়ে বেরিয়ে না আসে! তিনি যেন আমাকে ঐ  যদু মধুদের মত সাধারণ আদেখলা স্তাবকবৃন্দের দলে না ফেলে একটু সময় দিলেন।

“দিল্লী যাচ্ছেন মিস্টার রায়, নিশ্চয়ই কোন ছায়াছবি সংক্রান্ত কাজেই?”

“না না, এবারে ঐ একটা পুরস্কার নিতে যাবার পথেই দিল্লী। হ্যাঁ, ছবিসংক্রান্ত তথ্য কিছু জোগাড় করার ইচ্ছে তো আছেই”।

দু-তিনদিন পরে দিল্লীর সব কাগজেই প্রথম পাতায় ওঁর ‘ঐ একটা পুরস্কার’  নেবার ছবিটি আলোড়ন তুললো। বার্লিনে বিশ্ব সমাদৃত গোল্ডেন বার্লিন বেয়ার, ছবিটা বোধহয় ‘অশনি সঙ্কেত’।

প্রসঙ্গত, এই প্রতিভাবান ব্যক্তিটি ৩৬টি ছবিতে বোধহয় ১৩৪টি পুরস্কার এনেছেন দেশ বিদেশ থেকে। আমার সংখ্যাতত্বে ভুলও হতে পারে।

উঠে পড়লাম। ফিরে আসার সময় কুন্ঠাভরে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার একটা ছবি নেওয়া যাবে মি: রয়?” সাবধানী দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতে তাকাতেই বললেন, “ভেতরে তো তুলতে পারবেন না, বরং দিল্লিতে নেমে…”। ভরসা পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ঊঠল মনটা ।

কনভেয়র বেল্টটা নিজের মনে ঘুরে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আমার হাল্কা সবুজ স্যুটকেসের কোন সংবাদ নেই। আড়চোখে দেখেছি ওনার ছোট এ্যাটাচিটা অনায়াসেই তুলে নিয়ে অপেক্ষারত কারুর হাতে দিয়ে দিলেন মিনিট পাঁচ সাতেক আগে। একটু দূরে গিয়ে দাঁডিয়ে আছেন। হয়তো আর একটা লাগেজের অপেক্ষা। চারদিক থেকে ক্যামেরার ঝিলিক চোখে পড়ছে - প্রচুর ছবি উঠছে। ঋজু, অচঞ্চল উনি। অবশেষে চলেই এলো আমার বাক্সটি। ওটাকে আর কোনরকম  আদিখ্যেতার সুযোগ না দিয়েই হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেললাম। ভারসাম্যটা সামলে উঠিনি তখনও, পেছনে অনেকটা উঁচু থেকে জলদগম্ভীর গলা, “ছবি নেবেন বলছিলেন না - আরও জিনিষ আছে বেল্টে?” হাতে আর কোন ব্যাগ না দেখে বুঝলাম, ব্যাগের জন্যে নয় , আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন উনি। হৃদয়টা উচ্ছাসে ফুলে ফেঁপে উঠে ফেটে পড়বে না তো? ঐ বিশাল মহান মাটির মানুষটি আমার মত সাধারণ একজনকে অতি সাধারণভাবে দেওয়া একটা আলতো কথা রাখবার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন? কত দেখব, কত শিখব, অপরিসীম শ্রদ্ধায় কতটা নত হতে পারব? মাটি তো আর আমার জন্যে ফেটে ফাঁক হয়ে আমাকে বুকে নিয়ে আরও আরও নিচু করতে পারবে না? “আসুন!” বলে এগিয়ে চললেন উনি মন্হর, মাপা পায়ের গতিতে। পেছনে আমি, চামড়ার খোলস থেকে পুরনো ইযাশিকা বের করতে করতে অসংবৃত পায়ে চলেছি। ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালেন। কৌতূহলী ফ্যানমন্ডলীকে নিজেই হাত নাডিয়ে দূরে থাকতে ইশারা  করলেন। আমি তখন জাপানী যন্ত্র নিয়ে হিমশিম। এখনকার মত এক নিমেষেই মোবাইলে ফ্রেমবন্দী করার মত বিজ্ঞান তখন দূর ভবিষ্যতে। এই মানুষের এক জায়গায় স্হিতু হয়ে থাকা অসম্ভব, উনি খুব হাল্কা পায়চারী শুরু করলেন আমাকে নজরে রেখে। মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার এস এল আর, বি-  টুয়েলভ ক্যামেরার ফোকাসে আসছেন। এ তো স্টিল ছবিকে ক্যামেরাবন্দী করা নয় - চলন্ত গতি অনুসরণ করে ফোকাস করি তো আলো কমে যায়, এ্যাপারচার ঘোরাই তো ততক্ষণে উনি ফোকাসের বাইরে - সেটা ঠিক করতে গিয়ে আবার এক্সপোজার আউট, সবকিছু আয়ত্বে এলো তো ফ্রেমটা মনোমুগ্ধকর হল না।  পেছনে ট্রলিভর্তি করে যাত্রীদল। উনিই বা আনাড়ির জন্যে কতটা সময় নস্ট করবেন? হাঁটতে হাঁটতেই ঘাড় বেঁকিয়ে (এটা কিন্তু ঠিক হাতে পড়লে একটা মারাত্মক শট্ হতে পারতো!) একটু হেসে বললেন, “কি, হচ্ছে না বুঝি?” আবার সেই ‘ধরিত্রীকে দ্বিধা’ করে দেবার জন্যে অদম্য কামনা - এবার লজ্জায়। তাড়াতাড়ি ঐ কাছাখোলা অবস্হাতেই দিলাম শাটারটা টিপে, যা হয় হোক! এই অপ্রস্তুত লজ্জাজনক অবস্হা থেকে রেহাই তো পাই আগে, ওনার প্রশ্রয়ভেজা  কৌতুক দৃষ্টির বাইরে গিয়ে! শাটারের আওয়াজ শুনেই উনি মুচকি হেসে হাতটা একটু নাড়িয়েই লম্বা পা ফেলে দরজার দিকে দ্রুতবেগে এগিয়ে গেলেন। তিনি  স্হিরনিশ্চিত যে আমি কোনমতে ফটোগ্রাফার বা রিপোর্টার হতেই পারি না!  আমাকে ধন্যবাদ জানাবার সুযোগও দিলেন না উনি। পেছনে তখন ছুটছে উৎসাহীর দল।

সেদিনই ওয়াশ করালাম রোলটা, শেষ না হতেই। উত্তেজিত কম্পমান আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, একেবারে ঘষা ঘষা একটা ভৌতিক অবয়ব, আর  জ্বলন্ত দুটো বিশাল চোখের ছাপ নিথর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ  বিদ্রূপ বা ছিটেফোঁটা অসহিষ্ণুতার ছায়ামাত্র নেই।

বেশ কয়েক বছর পর যখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গল্পটা করছিলাম, ঝরঝরিয়ে হেসে উঠেছিলেন তিনি। চলতি ভাষাতেই মজা করে বলেছিলেন, “অম্লান, কার কাছে খাপ খুলতে গেছো! উনি নিমাইদাকেও (ঘোষ) কতসময় কত সুন্দর ভাবে পরামর্শ দিতেন, জানো?” এবারে আর “জানতাম না” বলতে একটুও লজ্জা করল না আমার।

সেই সাদাকালো ছবিটা এখনও হাতছাড়া করি নি।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন