কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

নিবেদিতা আইচ

 

সমকালীন ছোটগল্প


জঙ্গল

 

- মরে যায়নি তো?

- না, এখনো শব্দ করছে অল্প অল্প, কান পাতলেই শুনতে পাবি

- তবে কি বেঁচেই গেল এ যাত্রা?

- বাঁচা বলে একে? শরীরে জান থাকলেও রোজ অল্প অল্প করে মরবে কথার ঘায়ে।

- কিংবা আজকে বাড়ি ফিরে গলায় দড়ি দেবে৷ মনে আছে সেবার নাপিত পাড়ার মেয়েটা কী করেছিল?

- তা সে অত রাতে অমন না বেরুলেও পারতো!

- সে না হয় বেরিয়েছিল ল্যাট্রিনে যেতে, ছেলেগুলো তো ভদ্র ছিল খুব, ওরা বাঁশঝাড়ে কী করছিল অত রাতে?

- আহা রে, শরীরে কী কষ্টটাই না পেয়েছিল মেয়েটা!

- হ্যাঁ, ডান পাশের খাবলে নেয়া বুক থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছিল। ঘেয়ো কুকুরটাও এসে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ, জীবিত মানুষকে ছুঁতে তার বিবেকে বাঁধছিল

- আচ্ছা, হাসপাতালে কেউ ছিল না ওর সাথে? অতগুলো ঘুমের ওষুধ কে দিল ওকে?

- সম্ভব হলে আমিই দিতাম ঘুমের ওষুধ, এত যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচা যায়?

- পাশের পাড়ার সেই ঘটনাটা মনে আছে? সেই যে সাত মাসের বাচ্চা পেটে ছিল, বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল মেয়ে, বাড়ি থেকে তুলে এনেছিল শুয়োরগুলো

- আহা রে, বাচ্চাটাও পেটের মধ্যে মরে গিয়েছিল

- এত রক্ত গেছে! ওকে দেখলে এখনো মনে হয় পিশাচের দল সব রক্ত শুষে নিয়েছে সেদিন

- শুধু কি সেই মেয়েটা! সেবার নাতির বিয়ে খেতে এসে বুড়িটা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। মদখোর ছেলেগুলো ছাড় দেয়নি একটুও।

- বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছিল ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রীটা। গভীর রাতে খুবলে খাওয়া লাশটা ফেলে গেল না এখানে?

- চকলেটের লোভ দেখিয়ে ক্লাস টুয়ের ফুটফুটে বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল এ পথ দিয়ে বাড়িতে বলে দেবে বলায় গলা টিপে মারল, তারপর মাটিচাপা দিল বাবলা গাছটার পাশে

- বাজারে বসতো যে পাগলিটা, গায়ের কাপড় নাকি ঠিক ছিল না তার। ওকে তুলে আনেনি সেদিনের ছেলেগুলো? রড ঢুকিয়ে দিয়েছিল বেচারির এক চোখে

- মনে আছে? ডিউটি শেষ করে ভোরবেলা বাড়ি ফিরছিল ডাক্তার মেয়েটা। চারজন মিলে বাস থেকে ফেলে দিয়েছিল জানালা দিয়ে। যাবার সময় পা দুটোর ওপর চাকা তুলে দিয়েছিল।

- সেদিন কুকুরটা দেখলি না কেমন ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে গেল রাস্তা দিয়ে। বেচারা মাটিতে বসতেও পারছিল না একটু। এখন মানুষ দেখলেই ভয়ে কুঁইকুঁই করতে থাকে

- আহা রে, মেয়েটা কেমন কাতরাচ্ছে শোন, ওর বাড়ির লোকজন না জানি কোথায় কোথায় খুঁজছে

- বাচ্চা মেয়ে না তো? গলাটা কেমন পাখির ছানার মতোন

- আহা রে মেয়ে কোন কপালে জন্মেছিলি রে এই মুলুকে!

- তোর ঘেন্না হয় না রে প্যাঁচা? নিজের প্রতি? মানুষগুলির জন্য কষ্ট হয় না?

- হয়, কদিন পর পর এই আর্তনাদ শুনতে দিশেহারা লাগে।

- এদের ঘাড় মটকে রক্ত খেতে পারতাম যদি!

- আমার মনে হয় হুল থাকলে ছুটে গিয়ে সবকটা জানোয়ারের চোখে মুখে হুল ফুটিয়ে দিতাম

- আমাদের কি তাহলে কিছুই করার নেই প্যাঁচা?

- শুনতে পাচ্ছিস ঝিঁঝি, মেয়েটা কেমন করে মাকে ডাকছে? কার বুক খালি হচ্ছে কে জানে!

ঝিঁঝির সাড়া না পেয়ে প্যাঁচা এবার ডানা ঝাপটে উড়াল দিল। শব্দটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে ছুটছে সে। ডানা দুটো বিশাল থেকে বিশাল হচ্ছে ওর৷ পায়ের নখরগুলো তীক্ষ্ণ হতে হতে যেন ছুরির ফলার মতো হয়ে উঠছে।

ছোট্ট শরীরটাকে চেপে ধরেছিল মাঝবয়েসী দুটো লোক৷ বিশাল ডানার ঝাপটায় টাল সামলাতে না পেরে ওরা এবার মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আর ঝিঁঝি সদ্য গজানো সুঁইয়ের মতো সুঁচালো হুলগুলো চোখে মুখে সারা গায়ে ফুটিয়ে দিল একে একে।

দোপেয়ে দুটোর আর্তনাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই এবার ঘুমন্ত জনপদ জেগে উঠলো। লোকজন ঘর ছেড়ে বের হলো আর দেখতে পেল অদ্ভুত এক দৃশ্য। জঙ্গল থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে সমস্ত প্রাণী। শিং নিয়ে তেড়ে আসছে মোষের দল, ফণা তুলে ছোবল দেবে বলে ফোঁসফোঁস করছে বিষধর সাপ। পায়ের তলে ফেলে পিষে ফেলবে বলে ধুপধাপ করে ছুটে আসছে বুনোহাতির পাল। ঘোরলাগা চোখে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে মানুষের মনে হলো ছুটে আসা এই জন্তুগুলো নয়, আসলে তারাই জঙ্গলে বাস করছিল এতকাল!

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন