কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

অচিন্ত্য দাস

 


পাখি ফিরিয়া যায়

 


(মসীচিত্র ২)  

 

শুকসারি, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর দিন আর নাই। তাহারা ছিল সেই রূপকথার কালে।  রাজপুত্র অনেক দূর দেশে চলিয়াছে – চলিতে চলিতে দিন ফুরায়, সূর্যদেব পাটে নামেন, বনের ভিতর আঁধার ঘনায়। দুধসাদা ঘোড়াটিকে গাছে বাঁধিয়া রাজপুত্র গাছের ডালে রাত্রি কাটাইবেন বলিয়া মাচা করিলেন। শুইতে যাইবেন এমন সময় শুনিলেন মগডালে বসিয়া দুটি পাখি পরষ্পরের সহিত কথা বলিতেছে। মানুষের ভাষায়, মানুষ-মানুষীর গলায়।

সে রূপকথার যুগ কবে চলিয়া গিয়াছে। তাহা ছাড়া আমি রাজপুত্র নহি এবং আমার পক্ষিরাজ বা সাদা ঘোড়া কোনোটাই নাই। আপাতত আছে একটি ভাড়া করা গাড়িযা ঝড়ং-ঝড়ং আওয়াজ করিতেছে, তাহাতে মাথা ধরিয়া গিয়াছে।  জানালার কাচ তুলিয়া দিয়া চালক বাবজিকে একবার বলিয়াছিলাম, ভাই এ সি চালাইয়া দিবে...! চালক বাবাজি উত্তর দিল, “এ সি চালাইলে গাড়ি গরম হইয়া যাইবে”

সে আবার কী! এ সি র কাজ তো শীতল করা! মুখে বলিলাম, “অ্যাঁ, তাই নাকি?”

চালক মহাশয় বলিল, “ইঞ্জিন গরম হইয়া যাইবে, সিলভাসা অবধি গাড়ি চলিবে  না”কী আর বলিব, চুপ করিয়া যাইতে হইলচালক বাবাজি কিন্তু গাড়ি  থামাইয়া দিল। কী হইল রে বাবা, এ সির কথাতেই ইঞ্জিন গরম হইয়া গেল, না চালকবাবু রাগ করিল? দেখিলাম চালক গাড়ি হইতে নামিল। গাড়িটি এক পাক  প্রদক্ষিণ করিয়া জানাইল, চাকা পাংচার হইয়াছে। স্টেপনীতে হাওয়া নাই, ওই  মোড়ের মাথায় দোকান আছে, আমি যাইতেছি। আপনি বরং ওই মাঠের ধারে চায়ের দোকানে চা পান করিয়া আসেন। চাকা সারাইতে একটু সময় লাগিবে।

একে বৃষ্টি-বাদলার দিন তাহার উপর সেই কোন ভোরে উঠিতে হইয়াছে। ভোরে উঠিয়াছিলাম ঠিকই, কিন্তু বাহির হইতে দেরি হইয়া গিয়াছে। সিলভাসা যাইতে হইবে, কাজ রহিয়াছে। ঝড়ঝড়ে গাড়ি, রাস্তার অবস্থা স্থানে স্থানে অতীব বন্ধুর। শরীর-মন ম্যাজম্যাজ করিতে ছিল। দেরি তো হইয়াছেই তাহার উপর আবার  চাকা পাংচার। দুয়ে মিলিয়া হতাশা অথবা রাগ অথবা দুইই হইবার কথা ছিল,  কিন্তু দেখিলাম অ্যালজেব্রার অংকে যেমন মইনাসে মইনাসে প্লাস হইয়া যায় তেমন বিরক্তি এবং বিরক্তি মিলিয়া আমার মন কেমন যেন অন্যরূপ হইয়া গেল অবশ্য শ্রাবণপ্রাতের এই ছায়া, এই সিক্ত বাতাসও ইহার কারণ হইতে পারে। কয়েক পা আগাইয়া গিয়া ধাবা চত্ত্বরে প্রবেশ করিলাম এবং কোনোরূপ ভনিতা না করিয়া  চারপাই অর্থাৎ খাটিয়ার উপরে সটান চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িলাম। রাজা অথবা রাজপুত্রের মেজাজে ফরমাস করিলাম, “ভাল করিয়া চা বানাইবে।  আর হ্যাঁ, এখন নহে, মিনিট পনেরো পরে দিবে”, বলিয়া চোখ বুজিলাম।

ঘুম আসিতে একটু সময় লাগিল, কারণ যানবাহনের শব্দ। অনবরত ভারী ভারী  ট্রাক চলিতেছে বড় বড় সব মেশিন-পত্র লইয়া। তাপ্তি নদীর মোহনার নিকট এই স্থানে দুরন্ত গতিতে শিল্প স্থাপনা হইতেছে। পূর্বে কিছু গ্রাম, কিছু স্থায়ী-অস্থায়ী ঘরবাড়ি আছিল। রাস্তার কিনারায় বেশ কিছু দোকান বসিত। সে সব আর কিছু নাই। কিছু মানুষকে জোর খাটাইয়া, কিছু মানুষকে অর্থ দিয়া এ অঞ্চল হইতে সরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এলোমেলো বুনো গাছগাছালি যাহা ছিল তাহা সাফ্ করিয়া জমি তৈয়ারি করা হইয়াছে। কারখানা হইতেছে, কর্মচারীদের আবাসন হইতেছে। নূতন করিয়া গাছ পোঁতা হইয়াছে – কোথাও সার করিয়া খেজুর, কোথাও ক্ষেত্র ভাগ ভাগ করিয়া ইউক্যালিপ্টাস লাগানো হইয়াছে। শোনা যাইতেছে এখন হইতে বিরাট বিরাট সব জাহাজ লাগিবে, তাহাতে কাঁচামাল আসিবে এবং পণ্য রপ্তানী হইবে। ইহা ছাড়া বিকট শব্দে হর্ন বাজাইয়া সারি সারি ট্রাকসকল তৈয়ারি রহিয়াছে। অবশ্য শিল্প না হইলে দেশের উন্নতি হইবে কী করিয়া!  

যাহা হউক, ইহাতে আমার আপাতত বিশেষ কিছু যায়-আসিতেছে না এই তো  কেমন শ্রাবণের মেঘমলিন দিবসে খোলা আকাশের নিচে চিৎপাত হইয়া শুইয়া রহিয়াছি। মনে হইল “আমি শ্রাবণ আকাশে ওই, দিয়েছি পাতি মম জল ছলছল আঁখি মেঘে মেঘে ...” এই গানটি গাহিবার আদর্শ সময় এখনঅতিভোরে উঠিবার ক্লান্তিতে চোখ বুজিয়া আসিল। আর এই চোখ বুজিবার মুহূর্তটিতেই  তাহাদের দেখিলাম। দুটি পাখিসম্মুখের একটি ল্যাম্প পোস্টের উপরে বসিয়া আছে। আকারে কাক হইতে সামান্য ছোট কিন্তু শালিক হইতে বড়। রং ছাইছাই এবং কালো, পেটের নিকট একটু যেন সবুজের ছাপ রহিয়াছে। ল্যাজের আকৃতি ইংরাজি ‘ওয়াই’ অক্ষরের মত। কী পাখি তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না।

দিবানিদ্রায় চক্ষু যখন বুজিয়া আসিল তখন কিন্তু বুঝিতে পারিলাম, ইহারা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী। ইহারা কথা বলিতেছে এবং সে বার্তালাপ আমি বুঝিতে পারিতেছি। রূপকথা হইতে তফাৎ এইটুকু যে ইহারা রাজপুত্রকে তেমন কোনো দরকারি বিষয়, যেমন কী করিয়া রাক্ষস বধ করিতে হইবে, সরোবরের গভীরে  কোন কৌটার ভিতর রাক্ষসের প্রাণভোমরা রহিয়াছে, ইত্যাদি লইয়া কিছু বলিতেছে না। আর বলিবেই বা কেন, আমি তো রাজপুত্র নহি এবং আমাকে দেখিয়া রাজপুত্র বলিয়া ভুল হইবারও কোনো কারণ নাই।

ইহারা নিজেদের কথা বলিতেছে।

প্রথম পাখিটি বলিল, “আমরা কোথায় যাইতেছি রে, আরও কত উড়িতে হইবে?”

দ্বিতীয় পাখি বলিল, “ওই পূর্বদিকের বনে যাইব, সেখানে অনেক গাছ, বাসা করিবার ভাল ভাল ডাল পাওয়া যাইবে”

- “সে কত দূর?”

- “তা দূর আছে, তুই আজ বড় আস্তে উড়িতেছিস, তাড়াতাড়ি উড়িতে হইবে”

এই কথা শুনিয়া পাখিটি অন্য পাখিটির বুকে ঠোট গুঁজিয়া আদুরে গলায় বলিল, “কী করিয়া তাড়াতাড়ি উড়িব রে, আমার পেটে যে ডিম রহিয়াছে...”

পুরুষ পাখিটি এই খবর জানিত না। সে কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল এবং তাহার  পর দুইজনে পালক ও ঠোঁট ঘষাঘষি করিয়া খানিক সোহাগ করিল। পুরুষ পাখি বলিল, “চল্, এইবার ওড়া যাক”

মেঘ তো ছিলই, তাহার উপর আর একখণ্ড কালো মেঘ আসিয়া পড়িল। মেয়ে পাখি বলিল, “আঁধার ঘনায় যে রে, বেলা পড়িয়া গেল কি!

-না রে বোকা, বাদল করিতেছে বলিয়া এমন লাগিতেছে, এখনো অনেক বেলা  রহিয়াছে”

-আমরা যাইতেছি, কিন্তু আর কটা দিন দেখিলে হইত না?”

-না রে, এখানে আমরা আর থাকিতে পারিব না। দেখিলি তো, বণিকের লোক  আসিয়া পিপুল গাছটি কাটিয়া দিল। আমাদের বাসা মাটিতে পড়িয়া ভাঙ্গিয়া যাইল। উহারা রাস্তা বানাইবে। আমি নদীর ধারে আর জল খাইতে যাই না। কী যে ভীড় লাগিয়া থাকে! বড়বড় জাহাজ লাগিতেছে, ভীষণ আওয়াজ। অনেক খুজিয়াছি রে, বাসা করিবার একটা ডাল পাইলাম না।  আর তুইও তো  দেখিয়াছিস, সারাবেলা ঘুরিয়া ঘুরিয়া খাবার পাওয়া যায় না। গাছ সব কাটিয়া দিয়াছে, খাবার কোথায় পাইব? সাদা সাদা আকাশমণি গাছ লাগাইয়াছে কিছু,   কিন্তু উহার পাতায় যা ঝাঁঝ তাহাতে বমি পায়। পোকা-মাকড়ও সব পলাইয়াছে,  নয় মারা পড়িয়াছে”

সেই বৎসর আমরা যখন আসিয়াছিলাম তখন সে কত গাছ আছিল – আমরা  সারাদিন ফল খাইয়া বেড়াইতাম, তোর মনে আছে?

“মনে কেন থাকিবে না, সব মনে আছে। ঈস্, আমাদের অশত্থ গাছটি কী ঘন ছিল বল্ তো!

মেয়ে পাখি বলিল, “ চল্, রওয়ানা দিই, আমার কিন্তু ক্ষুধা পাইতেছে”

-“তবে একটু দাঁড়া” – পুরুষ পাখিটি ধাবার নিকট আস্তাকুড়ের উপরে একটি  রুটির খণ্ড দেখিয়াছিল, টুক করিয়া নিচে আসিয়া তাহা লইয়া গেল এবং দুইজনে ভাগ করিয়া খাইল। এবার তাহাদের উড়িবার পালা। তাহারা আর এ অঞ্চলে থাকিতে চাহে না থাকিতে পারিতেছেও না।

চা আসিয়া গেল। ধ্যাত্, এত তাড়াতাড়ি পনেরো মিনিট হইয়া গেল। উঠিয়া বসিলাম, যাইতে হইবে। আবার সেই গাড়ি, সেই রাস্তা।

ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথা যাহা শুনিলাম তাহা কি সত্য? সত্য হইতেই পারে।  কারখানা বাড়াইতে এত জমি-জায়গা প্রয়োজন হয় যে বন-বাদাড় সাফ তো  করিতেই হইবে। না করিলে রাস্তা হইবে কী করিয়া? রাস্তা না হইলে, মালপত্র আসিবে কি করিয়া? লোহার কারখানায় এককোটি টন উৎপাদনের ব্যবস্থা হইতেছে পাশের কারখানাটি পারমাবিক চুল্লীর বিশাল বিশাল কাঠামো তৈয়ারি  করিবে, তাহার পরের কারখানাটিতে প্লাস্টিক, পলিয়েস্টার ইত্যাদি তৈয়ারি হইতেছে অনেক দিন ধরিয়া। বিরাট কর্মকাণ্ড, বিরাট অগ্রগতি। এ অঞ্চল অভাবনীয় উন্নতি করিতে চলিয়াছে।

চা পান করিতে করিতে মনের মধ্যে কেবল একটিই খুঁতখুঁতানি লাগিতেছিল। এই অভাবনীয় উন্নতিতে পাখি দুইটার স্থান হইল না। পাখি ফিরিয়া যাইতেছে।

ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথায় অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিলা বলিয়া ঠিক বুঝিতে পারি নাই। চালকমশায় হাত নাড়িয়া আমাকে ডাকিতেছে। তাহার মানে চাকা ঠিক হইয়া গিয়াছে। এবার উঠিতে হয় উঠিলাম।

গাড়ি চলিল। গত কদিনের বৃষ্টিতে রাস্তায় অসংখ্য খানা-খন্দ জন্মিয়াছে। তাই ঝাঁকানি একটুও কমে নাই।  যাইতে যাইতে ভাবিতেছিলাম, সিলভাসা পৌঁছিতে অনেক বেলা হইয়া যাইবে। কাজ শেষ হইবে তো? না হইলে রাত্রিতে থাকিয়া যাইতে হইবে – সে বড় বিশ্রী হইবে। চালকবাবুর যা মেজাজ তাহাতে বলিতে ভরসা হইল না যে, একটু তাড়িতাড়ি গাড়ি চালাইলে ভাল হইত। গাড়ি যে গতিতে চলিতেছিল সেই গতিতেই চলিল।

খানিক আসিয়া গাড়ি আবার থামিয়া গেল। সামনের রেলওয়ে ফটক বন্ধ, ট্রেন আসিতেছে। আজকাল এই লাইনে রেল চলাচল অধিক হইয়াছে। কত মালপত্র যাইতেছে, আসিতেছে। এই অঞ্চলে যানবাহনও বেশ বাড়িয়াছে। মাত্র কিছুক্ষণ হইল ফটক বন্ধ হইয়াছে কিন্তু ইহার মধ্যেই অনেকগুলি দুই চাকা এবং চার চাকা গাড়ি দাঁড়াইয়া গিয়াছেপাশে এক মোটর-সাইকেল থামিয়াছিল, তাহার আরোহী এবং সহ-আরোহীর কথায় একটি ‘সুখবর’ পাইলাম। লাইনে দু-দুটি মাল গাড়ি শান্টিং হইবে, কমপক্ষে অর্ধঘণ্টা লাগিয়া যাইবে।

চূপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। কাজে যাইতে দেরি হইবার যেটুকু বাকি ছিল তাহা এই মালগাড়ি পূরণ করিয়া দিবে। তাই মনে যে উৎকণ্ঠা জন্মিতে ছিল তাহা আপনা হইতেই চলিয়া গেল। আজ সিলভাসার কোনো এক অপরিসর হোটেল ঘরে রাত্রিবাস অবধারিত। একেবারে ছাপার অক্ষরে কপালে লিখিত রহিয়াছে। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সর্মপ করিয়া সীটের উপর আরও একটু কাত হইয়া  বসিয়া আকাশ দেখিতে লাগিলাম।

এমন সময় তাহাদের আবার দেখিলাম। সেই পাখি দুটি। একটি বিজলি খুঁটির উপর কিছু লতাপাতা রাজ্য বিস্তার করিতেছে, পাশেই এক শুষ্কপত্র বৃক্ষবৃক্ষের  একটি শাখায় তাহারা আসিয়া বসিয়াছে একটু জিরাইয়া লইবার জন্য। তাহারা  কি কথা বলিতেছে? হয়ত বলিতেছে। কিন্তু আমি যে এখন জাগিয়া রহিয়াছি তাই উহাদের কথা আর শুনিতে পাইতেছি না। শুধু দেখিলাম পাখি দুটি আবার উড়িল।  

শ্রাবণের ঘনমেঘাচ্ছন্ন সকাল। বেলা যে কত হইল তাহা ঘড়ি না দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই।  মেঘের ‘পরে আরো মেঘ জমিতেছে, একা একা বসিয়া তাহাই দেখিতেছি আজ সারাদিন বাদল আর কাটিবে না। ভিজা বাতাস ঝাপটা দিয়া যায় থাকিয়া থাকিয়াআমার মনেও বাদল জমিয়াছে, ভালো লাগিতেছে না। এই অঞ্চলের সকল মানুষজনকে একত্রে ডাকিয়া চীৎকার করিয়া বলিতে ইচ্ছা করিতেছে – ও হে নগরবাসী, তোমরা কী কারণে সমস্ত দিন এত ব্যস্ত? তোমরা একটিবার আকাশপানে চাহিয়া দেখিতেছ না – পাখি ফিরিয়া যায় যে…  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন