কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

  


(৩) 

 

কেস স্টাডি ১

(Oh my friends, there is no friend.)

Aristotle

 

আমার বাড়িতে একটা ফুলদানি আছে। হৃদয় বলেছিল। ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তারপর বলেছিল, আমি কোনওদিন সত্যিকারের ফুলদানি দেখি নি। শুধু বইতে ছবি দেখেছি। আমাকে দেখাবি?

ছেলেটির চোখে চশমা। মুখে মেধার ছাপ। মাঠে খেলছিল সে। আগে কখনও এই ছেলেটিকে মাঠে খেলতে দেখেনি হৃদয়। সামান্য দুচারটে কথায় দুজনেরই দুজনকে ভালো  লেগে যায়। ছেলেটির নাম আগ্নেয়। হৃদয় আগ্নেয়কে নিজের বাড়িতে আসতে বলে। আগ্নেয় আসে। কিন্তু ঘরে না ঢুকে প্রথমেই যায় হৃদয়ের বাগানে। নিবিষ্ট হয়ে রঙবেরঙের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। বুক ভরে শ্বাস নেয়।

ওগুলো সব প্লাস্টিকের। প্রায় বছরখানেক হলো হৃদয়পুর দ্বীপে কোনও ফুল জন্মায় না। গত কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে ফুলের সংখ্যা কমছিলই। শেষে এই অবস্থা। হৃদয় বলেছিল।

তবু তো ফুল! আগ্নেয় যেন বাতাসের সঙ্গে টেনে নিতে থাকে ফুলের সুগন্ধ। হৃদয় সেইদিকে তাকিয়ে থাকে। আগ্নেয়কে নিয়ে তার মধ্যেও মগ্নতার জন্ম হয়। আগ্নেয় বাগান ছেড়ে উঠতেই চায় না। ফুলেদের মধ্যেই যেন সে স্বস্তিবোধ করে। হৃদয় অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

ফুল, এই একটি ব্যাপারই হৃদয় আর আগ্নেয়কে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে দেয়। আগ্নেয় পাশের একটা দ্বীপে থাকে। কিন্তু হৃদয়পুরে ওর মামাবাড়ি। এখানে ও যখনই আসে সঙ্গে থাকে নানারঙের ফুল। সবই প্লাস্টিকের। ফুল ছাড়া ওকে যেন ভাবাই যায় না। কত জায়গা থেকে কতরকম ভাবে ও ফুলগুলো জোগাড় করে আনে। আর এটাই হৃদয়কে মুগ্ধ করে।  আগ্নেয়কে নিয়ে ওর ঘোর লাগাটা বাড়তেই থাকে। ওদের বেশির ভাগ আলোচনাই হয় ফুল নিয়ে। কখনও কোনও ফুল ভালো লাগলে আগ্নেয় সেটা রেখে দিয়ে যায়। তারপর আর ফেরত নেওয়ার নামও করে না। এটাও হৃদয়ের খুব ভালো লাগে। আগ্নেয়র এই সহমর্মিতা ওকে খুব ভেতরে স্পর্শ করে। একবার তো আগ্নেয়র আনা একটা ফুল দেখে হৃদয় সেটা হৃদয় সেটা পুরোপুরিই চেয়ে বসে। ফুলটা আগ্নেয়রও খুব প্রিয়।

সে বলে, খুব কষ্ট করে পেয়েছি। এটা তোকে দিতে পারব না।

ঠিক আছে। আমার জন্যও একটা জোগাড় কর।

কোথায় পাবো? অনেক খুঁজে তবে এই একটা পেয়েছি...

হৃদয়ের সারা মুখে অন্ধকার নেমে আসে। আগ্নেয় কিছু বলে না। সারাদিন কাটিয়ে চলে যায়। রাতে হৃদয় ফুলটিকে নিজের বালিশের নিচে আবিষ্কার করে। ওর অজান্তে আগ্নেয় রেখে গেছে। এমনভাবে রেখেছে, যাতে ও টেরও না পায়। বিন্দুমাত্র আঁচ করতে না পারে। এইসব রহস্য আগ্নেয় পারে। আর তাই হৃদয়ের কাছে ওর আকর্ষণ এত বেশি। ছোটো ছোটো রহস্য। অদ্ভুত সব আত্মত্যাগ। বন্ধুত্বের বিরল কিছু মুহূর্ত। ফুলটির পাশে রাখা ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো, যাতে কোনও ভুল বোঝাবুঝি না হয়। হৃদয়কে আগ্নেয়র উপহার। অর্থাৎ ফেরত পাওয়ার আশা না করেই ফুলটি সে দিয়ে গেছে। এই আত্মত্যাগ সবাই পারে না। হৃদয়ের জীবনে এ এক বিরল ঘটনা। সে চমৎকৃত হয়ে যায়। আগ্নেয়র প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করে। একদিন হৃদয় বলে, জীবনে প্রথম কবে ফুল ভালোবেসেছিলাম, জানিস?

কবে? আগ্নেয় জানতে চেয়েছিল।

আমার এক দিদি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। একটি ছেলেকে সে খুব ভালোবাসত। একদিন দিদি সমুদ্রের ধারে হাঁটছিল। আমিও সঙ্গে ছিলাম। হঠাৎ সেই ছেলেটি এসে হাজির। দিদি আমাকে তার ছবি দেখিয়েছিল। ছেলেটি একটা ফুল এনেছিল। ফুলটা হাতে নিয়ে দিদি খুব খুশি হয়েছিল। সেদিনই আমি বুঝেছিলাম, ফুল মানে বন্ধুত্ব। ফুলদানি সেই হৃদয়, যা ভরে আছে বন্ধুত্বের অনুভূতিতে। তারপর থেকে আমার নতুন কোনও বন্ধু হলেই, আমি ফুলের স্বপ্ন দেখতাম। তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পরও দেখেছি। সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পরও বহুক্ষণ গোটা ঘর ফুলের সুগন্ধে ভরে থাকত।

আর ফুলদানি? সেটা কোথায় পেলি?

ওটা অনেক পুরনো। বহু বছর ধরেই আমাদের পরিবারে আছে। মাঝে মাঝে ভাবি, ওটা আছে বলেই বোধহয় এত সহজে আমার বন্ধুত্ব হয়। এমনকী অচেনা কারো সঙ্গেও। ওটা যেদিন হারিয়ে যাবে, এই মনটাও আমি হারিয়ে ফেলব।

একমাত্র ফুটবল মাঠেই একটু অন্যরকম লাগে আগ্নেয়কে। বিকেলে ওড়া একসঙ্গে দুজনে ফুটবল খেলতে যায়। তখন ওরা আর দুজন নয়, চারপাশে আরও অনেকে থাকে। আগ্নেয় হঠাৎ যেন পালটে যায়। সবার সামনে হৃদয়কে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সামান্য কারণে হৃদয়ের ভুল ধরতে থাকে। সবার সামনে হৃদয়ের সমালোচনা করে। খেলার কর্তৃত্ব নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করে। এক দলে থেকেও হৃদয়কে যেন ঠিক সহযোগিতা করতে চায় না। ওর ব্যবহারে হৃদয়ের সংবেদনশীল মনে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আঘাত লাগে। আগ্নেয়কে কেমন যেন দুর্বোধ্য লাগে। ঠিকমতো বুঝতে পারে না তাকে। এমনিতে হৃদয় চমৎকার ফুটবল খেলে। ওর খেলা খুব দৃষ্টিনন্দন। গোটা মাঠ জুড়ে কর্তৃত্ব করে। বল নিয়ে ফুল ফোটায় যেন।

কিন্তু যেসব দিন আগ্নেয় ওর সঙ্গে মাঠে নামে, কিছুতেই যেন নিজের খেলাটা ও খেলতে পারে না। কেমন যেন দমে যেতে থাকে। আগ্নেয় ওকে যেন নানাভাবে দমিয়ে দেয়। আর নিজে সবার দৃষ্টি কেড়ে নিতে চায়। হৃদয় কিন্তু কিছুতেই আগ্নেয়কে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে পারে না। নিজেকে তখন ও একটু সরিয়েই নেয়। খেলা থেকে, খেলার মাঠ থেকে, নিজের ব্যক্তিত্ব থেকে, মাঠের কর্তৃত্ব থেকে। এমনভাবে জায়গাটা ফাঁকা করে দেয়, যাতে আগ্নেয় অনায়াসে তার দখল নিতে পারে। সত্যিই তো, বন্ধু কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হয় না কী! আগ্নেয়র জন্য এটুকু অধিকার ছেড়ে দেওয়াই যায়। মনে হয়তো একটু খটকা লাগে। কিন্তু নিজের কাছেই সেটা স্বীকার করতে চায় না ও। আগ্নেয় কিছু বললে সেটা শান্তভাবেই মেনে নেয়। বন্ধুর পরামর্শ হিসেবেই সেটাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না, বরং গুরুত্ব দিয়েই ভাবার চেষ্টা করে।

হৃদয়ের বাড়িটা দোতলা, বেশ বড়ো, সমুদ্রের দিকে মুখ। বিধবা মা ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। বেশ অবস্থাপন্ন ওরা। হৃদয়ের মা আগ্নেয়কে নিজের ছেলের মতোই মনে করেন। এ বাড়িতে আগ্নেয়র অবাধ স্বাধীনতা। সে যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে, যে কোনও ঘরে ঢুকতে পারে, যে কোনও জিনিস স্পর্শ করতে পারে। সে এলে হৃদয়ের মা অতি যত্ন করে রান্না করেন।, নিজের ছেলের পাশে বসিয়ে খেতে দেন, নানা কথা জানতে চান, তার ছোটোখাটো সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। আগ্নেয়র বাড়ির অবস্থা ততটা ভালো নয়। বছরখানেক বাদেই ওর বাবা রিটায়ার করবেন। ওর মা স্কিজোফ্রেনিয়ার পেশেন্ট। বাড়িতে সব সময়েই একটা উদ্বেগের পরিবেশ। আর রয়েছে অভাব।

হৃদয় ওদের বাড়ি গিয়ে নিজের চোখে দেখে এসেছে। একদিনই আগ্নেয় ওকে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিল। পুরনো আমলের বাড়ি। অন্ধকার ঘোরানো সিঁড়ি। খুপড়ির মতো ছোটো ছোটো ঘর। যেন একটা আদিম, অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করেছিল সে। রান্না করতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আগ্নেয়র মা মাংসের ঝোলটা পুড়িয়ে দেন। তবু বন্ধুর মা বলে কথা! খুব তৃপ্তি করেই খেয়েছিল হৃদয়। হৃদয়ের বাড়িটা যতোটাই আলো ঝলমলে, আগ্নেয়র বাড়িটা ততোটাই স্যাঁতস্যাঁতে আর অন্ধকারে ঢাকা।

আগ্নেয় তাই অনেক সময়ে হৃদয়ের কাছে টাকাপয়সা ধার চায়। হৃদয়ও তার মাকে জানিয়ে যতটা সম্ভব সাহায্য করে, সে টাকা আর কখনো ফেরৎ পাবে না জেনেও। আগ্নেয় এমনভাবে টাকা পয়সা নেয়, যেন ওর নিজেরই টাকা। এই টাকায় ওরও অধিকার আছে। আগ্নেয় টাকা নিলে ওকে সাহায্য করতে পেরেছে ভেবে হৃদয়ের আনন্দই হয়। সেই টাকার কথা আর কখনও ও ভুলেও তোলে না। শুধু টাকাপয়সাই নয়, হৃদয়ের কাছ থেকে টুকুটাকি নানা জিনিস আগ্নেয় নিয়ে যায়। ওর রুচি খুবই উন্নত মানের। সাহিত্যের বই, পেইন্টিঙ্গের বই, পশ্চিমী ও ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সিডি বিশেষভাবে নিয়ে যায়। মোৎসার্ট ওর খুব প্রিয়। অনেক কিছুই আর ফেরৎ আসে না। আগ্নেয় সেগুলো হারিয়ে ফেলে। ভুল্র ফেলে আসে কোথাও। হৃদয়ের খুব কষ্ট হয়। কিন্তু বন্ধুত্বের প্রয়োজন আরও বেশি। আগ্নেয় ছাড়া ওর ফুলগুলি আর ফুলদানির অমন সমঝদার আর কে আছে! সে তাই চুপ করেই থাকে।

(ক্রমশঃ)   



2 কমেন্টস্: