কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯১ |
দীপাবলি
বাবা
আজও ফেরে নি।
রেশানের বিনি পয়সার চাল আর মাঠের নানান শাক খেয়ে তাদের চলে যাচ্ছে। আজ আর আলাদা করে চোদ্দশাক রান্না হয় নি।
ঘরের এক কোণে লম্বালম্বি সুতোর টানা উদাস পড়ে আছে। ধুলোতে সুতোর আসল রং বোঝা যায় না। আজকাল মা অমনি উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যে দেখে সে জানে না। চুলগুলো শনের দড়ি হয়ে আছে। পোড়েনের বাঁধন ঢিলে। নয়া বাজারের সকাল এখন চুপচাপ, শান্ত। মাকুর খটাখট শব্দ থেমে গেছে।
মাটির ক’টা প্রদীপ বানিয়ে সে উঠোনে শুকোতে দিয়েছিল। মা সেগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় নি। মাঝেমাঝে একা বিড়বিড় করে, এতদিন হয়ে গেল মানুষটার কোনো খবর নেই।
লকডাউনের প্রথম মাসটা ঠিকঠাক চলেছিল। তারপর মহাজনের চাপ। বাজারে কাটতি নেই। বাজারটাই বন্ধ। বর্ষায় চাষের কাজ জানা না থাকলেও লকডাউনের ভেতর দিন কয়েক কাজ পেয়েছিল বাবা। দিন কয়েক সুতো বোনার মতো করে চারা গাছ বুনেছিল। অল্প বৃষ্টির পর তার রোয়া সব গাছ নাকি জলে ভাসতে শুরু করেছে। কেউ আর বাবাকে কাজ দেয় নি।
দক্ষিণের কোনও কারখানায় মজুরের কাজ আছে শুনে বাবা জোর করে চলে গেছে। তারপর থেকে কোনো খবর নেই। মোবাইলে ভরার মতো কোনও পয়সা নেই। তাও যদি মানুষটা কোনো খবর দেয়, এই আশায় একমাস রিচার্জ করা হয়েছিল।
আজ বিকেলে রোদে রাখা প্রদীপ তুলতে গিয়ে দেখে মায়ের পায়ের চাপে দুটো ভেঙে গেছে। ইরাবতী কেঁদে ফেলেছিল। মা একবার তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। কোনো কথা বলে নি।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নেমেছে। দূরে একটা হাউই উড়ে আকাশ আবার অন্ধকার করে দিয়েছে। তাঁতে জড়িয়ে থাকা বালুচরি নকশার একটুকরো কাপড় কেটে নিয়ে ইরাবতী চুপচাপ সলতে পাকায়। রান্নাঘরে রাখা প্লাস্টিকের ছোট বোতল অনেক ধৈর্য ধরে উপুড় করে রাখে মাটির প্রদীপের ওপর। অনেক অনেক পরে এক ফোঁটা, দু ফোঁটা, তিন ফোঁটা করে প্রদীপের ওপর চোদ্দটা ফোঁটা ঝরে পড়ে।
সলতের টুকরো সেই তেলে ভিজিয়ে দেশলাই কাঠি ধরাতে সারা ঘর আলোতে ভরে ওঠে। মা চমকে তার দিকে তাকায়। প্রদীপটা দু’হাতের আঁজলাতে ধরে কুলুঙ্গিতে রাখতে রাখতে সে বলে, বাবা ঠিক ফিরে আসবে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন