কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮

অচিন্ত্য দাস




ঊটের গল্প


রাজস্থান বা গুজরাটের গাঁয়েগঞ্জে গরু-ছাগলের মত উটও গৃহপালিত জীব। গাড়ি টানা, লোকজন বা মালপত্র পিঠে নিয়ে যাওয়া এমনকি জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার কাজ এরা করে। দুধও দেয়। ভগবান এদের গলায় স্বর দেননি, স্বভাবেও এরা খুব শান্ততবে চেহারাটা বেঢপ বলে মাথার ওপর ছাদ জোটে না। বাইরেই রাত কাটে। খুব শীত পড়লে একে অন্যের গা ঘেষে থাকে। খাওয়াটা ছাড়া এদের আর কোনো দাবী নেই। তবে সেদিন ‘টাইমস অফ ইণ্ডিয়া’ য় দেখলাম লোকেরা উট আর রাখতে চাইছে না। খোরাকি অনেক আর এরা যা কাজ করে তার জন্য ট্রাক, ট্রাক্টর, ভাড়াগাড়ি তো সহজেই পাওয়া যাচ্ছে আজকাল।

আজমীরের কাছে ফি-বছরের মত মেলা বসেছে। প্রথম দিকটায় তেমন বিক্রি হয় না বলে বলদেও আর তার ভাই এবার শেষ দুটো দিন দোকান নিয়েছে। কাচের চুড়ি, মেয়েদের কাচ বসানো জামা কাপড়, সাজবার জিনিস- এসবের ব্যাবসা এদের। ভালই চলে পাকা বাড়ি, গরু-ছাগল-উট-মুরগি আছে। তিনটে উটে জিনিসপত্র আর একটাতে ওরা দুজন এসেছে। দেরি একটু হয়, কিন্তু উট যখন আছে তখন গাড়িভাড়া কেন খামোকা খরচ করবে?

তা এবার মেলায় বিক্রি খুব ভাল হল। এতটাই যে যা এনেছিল সব খতম। মেলা শেষ। দোকানিরা মালপত্র গুটিয়ে নিয়েছে। চলেও গেছে অনেকে। প্রায় ফাঁকা মাঠে দোকানের খুঁটি সারিসারি,  ছেঁড়াখোড়া তেরপল দু-একটা বিকেলের বাতাসে ছটফট করছে। ধূলো উড়ছে। মাঠ ভর্তি ছেড়া কাগজ, প্লাসটিকের ঠোঙ্গা, আইসক্রীমের কাঠি। চায়ের দোকানটা এখনো খোলা – বলদেও আর তার ভাই দু’ গেলাস চা নিয়ে বসল। কদিন থেকে বলদেও যে কথাটা ভাবছিল, আজ মেলা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার বোঝা না থাকায় তা সে ঠিকই করে ফেলল। ভাইকে বলল – চল, আমরা বাসে ফিরে যাই। ওগুলো থাক। কী হবে বল নিয়ে গিয়ে, চার-চারটের খোরাকি জোগানো কম খরচের!
ভাইএর মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল, কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু দাদার  দাপটের সামনে ও কোনোদিনই নিজের কথা বলতে পারেনি, আজও পারল না। চুপচাপ দাদার পেছনে পেছনে বাস গুমটির দিকে হাঁটা দিল।

উটেরা ভারি বাধ্য জানোয়ার। যেখানে ওদের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সেখানেই ওরা ঠায় দাঁড়িয়ে। একটার খুব খিদে পেয়েছে, সে গলা সমান্তরাল করে দোকানের চালায় রয়ে যাওয়া খড় চিবোচ্ছে। পাশেরটা ভাবছে, এসব আজেবাজে খেয়ে কী হবে, আর একটু পরেই তো বাড়ির খাবার পাওয়া যাবে। তিন নম্বরটার মনে  অল্পসল্প সন্দেহ দেখা দিয়েছে, কী হল রে বাবা! এখনো ওরা আসছে না কেনসকলেই তো চলে গেল। অন্ধকার হয়ে আসছে যে। তবে ওর মনে ভরসা আছে   নিয়ে ওরা যাবেই। এই তো সেদিন গাঁয়ে ওদের বাড়িতে শহর থেকে কতগুলো ছোটছোট ছেলেমেয়ে এসেছিলও! ওদেরকে পিঠে চাপিয়ে সে কত ঘুরিয়েছিল। বাচ্চাগুলো কী যে খুশি হয়েছিল তা আর বলার নয়। খিলখিল করে সবকটা খুব  হাসছিল। না না, উট না হলে ওদের কিছুতেই চলবে না।

সন্ধে পেরিয়ে রাত্তির নামল। চাঁদ নেই, অমাবস্যা নাকি আজ? আকাশ ভরে তারা উঠেছে, অনেক তারা। ওদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীন উট যে সে মাথা তুলে আকাশ দেখছে স্থির হয়ে। তারার ভাষাতে নাকি ভবিষ্যত লেখা থাকে। তাদের যে আর কেউ নিতে আসবে না, গ্রামে যে তাদের আর কোনো জায়গা নেই, এই নক্ষত্রলিপিটুকু মূক প্রাণীটি কী করে যেন পড়ে নিয়েছে।      


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন