দৃশ্য-চুরি
একদিকে
খালি গা গামছা মাথায় কিম্বা কাঁধে নিয়ে কতকগুলো লোক সওদা সাজিয়ে বসেছে। বাঁদিকের পিছনে একটা বড় গাছ। তার নিচে কিছু মানুষের জটলা। মুরগীর লড়াই শুরু হবে। উল্টো দিকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে দোকানীরা বসেছে। একটা তেলেভাজার দোকানও আছে। মোটামুটি এই হল দৃশ্য। গ্রামের দুই মোড়ল নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা
করছে। ঠিক এই সময়
দীপু ঢুকবে।
নাটকের
নাম ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’। কলকাতার
বিখ্যাত এই দলে দীপু যখন সুযোগ পায়, আনন্দে ডগমগ হয়েছিল। রবীন্দ্র ভারতীর নাট্য বিভাগের ছাত্র
দীপু। ওর শয়নে স্বপনে নাটক। কিন্তু উৎসাহ নিভে যেতে সময় লাগে নি। আগেই শুনেছিল, দলে যোগ দেয়া মানেই স্টেজ
পাবে, তা নয়। পিছনের কাজ
দিয়ে শুরু। চার মাস হয়ে যেতে মন খারাপ। ওর সঙ্গে যোগ দেয়া শিশির যেদিন স্টেজে
গেল ওর কষ্ট-কষ্ট মুখটা দেখে রিনিদি বলেই ফেলল, ব্যাটা রাগতে জানিস
না? একটু রাগ দেখা দিখি! বাপ বাপ বলে পার্ট
দেবে।
দীপু
দ্বিধায় ভোগে। নাটকের ছাত্র
বলেই জানে, ও যে কাজটা করছে সেটাও কত প্রয়োজনীয়। স্টেজের ওপর যারা ডায়লগ বলে আর যারা
জটলার মাঝে মুখবুজে অভিনয় করে, সবার সমান দায়িত্ব। দলের তিনটে নাটক সমানে চলছে। সব গুলোতেই প্রচুর ছেলেমেয়ের মাইমের
পার্ট আছে। সেরকম কিছুও
পেল না ও। সেটুকু যোগ্যতাও
কি ওর নেই!
অবশ্য
দলে ঢোকার সময় সিদুদা বলেইছিলেন, আসতে চাইছ এসো। কবে পার্ট পাবে সেটা এখুনি বলতে পারছি
না। আগে কাজ শেখো,
তারপর দেখা যাবে। পরে এ নিয়ে
কিছু বলতে এসো না বাপু! গত ছ’মাসে অনেক শিখেছে দীপু। কিছু করে দেখাতে পারছে কই! সিদুদা
যেন ওর ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন।
দীপু
আর জনা চারেক ছেলে মিলে সেট বদলায়। প্রথম
দৃশ্য শেষ হয়েছে। আজও ব্যস্ত হল কাজে। রিনিদি দৌড়ে এল, শিগগির দীপু! শিগগির! মেক-আপ করে নাও। হাটের
সিনে তোমাকে ঢুকতে হবে। শিউড়ে উঠল। এসেছে, অবশেষে সে দিন এসেছে!
মেক-আপ চলছে, সিদুদা এলেন। -‘বুঝতেই তো পারছো
কিসের মেকাপ হচ্ছে! তুমি
বদ্ধ পাগল, হাটের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছ, লোক
দূরছাই করছে। মোটামুটি
একটা চক্কর দিয়ে বেড়িয়ে এসো। ঠিক
আছে?’
হাটের দৃশ্য দীপুর মুখস্থ। মেক-আপ নিতে নিতে
ঠিক করে নিল কখন ঢুকবে আর কীভাবে কভার করবে। তৈরি হয়ে দাঁড়াল উইংসের পাশে। রথীনদা মনিদি আরো কয়েকজন যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে আবহ করছে। সজল ঢুকল, এক দোকানের সামনে দরদাম করছে মাইমে।
‘আহা রে! কোথায় দেবার কথা ছিল,
আর কোথায় দিয়েছে গো!’- রথীনদা বলে উঠলেন। মাইক চাপা দিয়ে সবাই হাসছে। দীপুও
হেসে ফেলেছে। সজলের ঘাড়ের
কাছে ক’গাছি চুল, অথচ সারা গায়ে বড় বড় লোম।
আবার
গুছিয়ে নিল দীপু। এবার ঢুকে পড়ল। তেলেভজা দোকানের সামনে দুজন মুড়ি খাচ্ছে
আর কথা বলছে। পাগলামো করতে
করতে দীপু শুনলো এক গ্রামবাসী তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় ফিসফিস করছে – ‘সাইড প্লীজ!’ মুড়ি চিবুতে চিবুতে একজন বলল, ‘করো কী!
করো কী! মাধব মালঞ্চী কইন্যার সময়ে ইংরেজি পাও
কৈথিক্যা?’ গ্রামবাসী
আবার বলে ফেলল, ‘সরি! সরি!’
হাসিতে
দীপুর পেট গুড়গুড়। এবার পাগলামি
করতে করতে ডিগবাজি খেল। হেলে
দুলে পুরো স্টেজ চক্কর খাচ্ছে। আজকের
সুযোগ হাতছাড়া করবে না। দর্শকদের
সাড়া পাচ্ছে ও। সিদুদা এক চক্কর
বলেছে,
দীপু দু-চক্কর দিয়ে আবার এগোচ্ছে। শুনলো
মুকুলদা ডায়লগ বলছেন, ‘দেহেন! দেহেন! এ পাগলা
করে কী!’
সিদুদা
সিনে। ওর দিকে এগোতে
এগোতে বললেন, ‘তাই তো! তাই তো! এ পাগলা
করে কী! দেহো দেহি!’ পেটের মধ্যে আঙুলের
খোঁচা। ফিসফিস করে
বললেন, ‘আর বাড়িয়ো না, আর বাড়িয়ো না!’ দীপু
বুঝে গেল, ও সিনে নাম লেখাতে পেরেছে।
‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’র হাটের
দৃশ্যে অন্য দিনের চেয়েও বেশি হাততালি পড়ল।
জীবন্ত....
উত্তরমুছুন