উৎক্রোশ
চিনিতে পিঁপড়ে ছিল। ঠ্যাঙ
চিতিয়ে চায়ে ভাসছিল। একটা নয়, চার-পাঁচটা। নকুল বাবুর কাপেও দু’একটা ছিল হয়তো বা । খেয়াল করেননি। রোজকার মত পত্রিকার শব্দজটে মগ্ন ছিলেন তিনি। এবারেরটা আসলেই
জটীল। চায়ের ট্রেটা সরমা বারান্দার টেবিলে রাখতেই অপলার ফোন! অপলা অমি’র বউ।
শুভ্রা রেলিঙের ধারে জবা গাছটার শুশ্রূষায় ব্যস্ত তখন। সরমা রিসিভারটা তাও শুভ্রার
হাতেই দিয়েছিল। কর্ডলেস
রিসিভার। মিঠু কিংবা অমির অবিরাম চাপেও ওঁরা সেল ফোনের চক্করে পড়েননি আজও। এই ল্যান্ডফোনটা অবশ্য
অমিই বিদেশ থেকে এনেছিল। হেঁড়ে গলায় অদ্ভুত ভাবে কলারের নাম বলে। অমি বলেছিল,
‘নিচে হাঁটতে যাও কী বারান্দায় অসুবিধা নেই, দিব্যি কথা বলা যাবে’। আসলে তা নয়। ‘বেইস’ থেকে
সরলেই আওয়াজ তলিয়ে যায়।
ঘন্টা তিনেক আগে মিঠুও কল
দিয়েছিল। মিঠু নেপাল যাচ্ছে। অফিসের কাজেই যাচ্ছে কিন্তু শুভ্রার মনে দ্বন্দ্ব, ‘এইতো
কদিন আগেই ঘুরে এলো, এখন আবার কী? বাড়ি আসতে বললেই রাজ্যের বাহানা’।
গত দু’মাস ধরে মিঠু ঢাকায়। কাজের চাপে
বাড়ি আসার ফুরসত পায় নি।
মিঠুর বাড়ি না আসার আরেকটা কারণ,
আত্মীয়স্বজনের ফিসফাস। শুভ্রাও কম জ্বালায় না। মিঠু এখন বিয়ে করতে চায় না । ‘আগে
ক্যারিয়ার তারপরে অন্যসব’- এই নিয়েই মায়ে-ঝিয়ে নিত্য ঝগড়া। শুভ্রা নিশ্চিত মিঠুর
কোথাও চক্কর চলছে নইলে এতো ভালো সব সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেয় কেউ? নকুলবাবু আপত্তি
তোলেন, ‘পছন্দ থাকলে তো জানাতোই’। শুভ্রার অতুল কল্পনাশক্তি। ‘কীভাবে
জানাবে? নিশ্চয় বেজাত কিংবা বউবাচ্চাওয়ালা কেউ’।
ফোনে তখন অপলার কথা কেটে
যাচ্ছিলো। বারান্দায়
এমনই হয়। শুভ্রাকে
ভেতরে যেতেই হ’ল। মিনিট
দশেক পরে যখন ফিরলেন তখন নকুলবাবু আড়াআড়ি তিন নম্বর শব্দটার চক্করে ঘুরছেন। পাশেই ‘সংসদ
বাংলা অভিধান’। এরমধ্যেই চা’টা শেষ করেছেন। পিঁপড়ে ফিঁপড়ে
খেয়াল করেননি।
বেতের চেয়ারটা ঘুরিয়ে রোদের
দিকে পিঠ পেতে বসেন শুভ্রা। ‘মিঠু ফেইসবুকে কী নাকি ছবি দিয়েছে। বউমা আসবে দেখাতে। কী এমন ছবি যে
তর সইছে না। বিয়ে
করে ফেলেনি তো!’ ওঁর গলায় আতংক। নকুলবাবুর
কানে কিছুই যায়নি। ওঁর সকল মনোযোগ সংসদের পাতায়, ‘ঈগল জাতীয় পাখি’। চার অক্ষর।
দ্বিতীয় ঘরে ‘ৎ’ থাকতে হবে। শব্দটা তাঁর চেনা। আগের কোন এক শব্দজটে পেয়েছিলেন
কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। শুভ্রা আপনমনেই বকছেন, ‘বউমা ঠিক জানে’।
দু’মাস হলো অমি অফিসের কাছাকাছি
ফ্ল্যাট নিয়েছে। উপশহরে। উপশহরই
এখন শহরের হৃদপিণ্ড। কিছুদিন আগেও এই এলাকাতেই ছিল সব। ভাল স্কুল,
কলেজ, বাজার, স-ব। আর এখন
শহর খোদ চলে গেছে উপশহরে। সবুজ
মাড়িয়ে ইটসুরকির দালান হুমহুম গজাচ্ছে সেখানে। সেরা স্কুল,
শপিংমল, হাসপাতাল সব ওধারে।
জবাফুল গাছটায় পোকা এসেছে। শুভ্রা গজগজ
করতে করতে আবার গাছটার পরিচর্যায় লাগেন, ‘সারাদিন ডিকশনরি নিয়ে বসে না থেকে একটু
হাত লাগাতে তো পার’! নকুলবাবু মনেমনে সিদ্ধান্ত নেন, নাহ্ এবার ফ্ল্যাটটা ভাড়া
দিয়ে অমির কাছেই থাকবেন। নাতিটাকে
মনে মনে হারাচ্ছে হয়তোবা। অমিরা
চলে যাবার পরেই শুভ্রার খিটখিটানিটা বেড়েছে।
আবার চেয়ারে ফেরেন শুভ্রা। নকুলবাবু
আড়চোখে দেখেন, একটু ফোলা ফোলা লাগছে কি? প্রেসারটা মাপানো দরকার একবার। কখন যে চিৎকার
করতে করতে হার্টফেইল করে কে জানে! চায়ের কাপটা আলগোছে তোলেন শুভ্রা। চোখ কুঁচকে কিছু জরীপ করেন,
‘পিঁপড়েশুদ্ধু চা খেলে!’ নকুলবাবু প্রমাদ গোনেন, আর সাথেসাথেই চিৎকার, ‘সরমা!’ পিঁপড়েগুলো
চামচে তুলে ফেলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! অসহ্য! নকুলবাবু পেপার, ডিকশনারি
গুটিয়ে ভেতরের ঘরে পা বাড়ান।
ড্রইংরুমে মৌনী বুদ্ধের মত টিভির
স্ক্রিনে চোখ সেঁটে আছে সরমার বাচ্চা। সরমা ওকে রোজ নিয়ে আসে কাজে। নিউজ চ্যানেলে খবর চলছে কিন্তু
আওয়াজ বন্ধ।
শুভ্রারই কাজ। ফোনে
কথা বলার সময় নিশ্চয় মিউট করেছিল। বাচ্চাটা তাও কেমন একনিষ্ঠ তাকিয়ে আছে! ‘কী রে কার্টুন
দেখবি?’ রিমোর্ট হাতে নিতে নিতে বলেন নকুলবাবু। বাচ্চাটার চোখ সরে না কিন্তু মুখে আলোর
ঝিলিক। নকুলবাবু
হাসেন। চ্যানেল চেঞ্জ করতে গিয়েই থমকান। লাল ফিতেতে চমকাচ্ছে ‘ব্রেকিং নিউজ’! কাঠমুন্ডুতে প্লেন ক্র্যাশ!
বুক কেঁপে ওঠে তাঁর। মিঠু!! ভয়ার্ত চোখে নকুলবাবু দেখেন লকলকে আগুন প্লেনের গা
বেয়ে ছুটছে আকাশে! বুকে প্রচন্ড চাপ! বাচ্চাটা চোখ মেলে আছে কার্টুনের প্রতীক্ষায়। সোফায় কাত হয়ে
ঢলে পড়তে পড়তে তিনি অসহায় দেখেন মাথার
পাশে টেবিলের কাচে লাফাচ্ছে টেলিভিশনের ছায়া। আগুনে ডানায়
যেন উড়ছে অসংখ্য ঈগল! চোখে আঁধার নামার ঠিক আগেই শব্দটা মনে পড়ে যায় নকুলবাবুর;
‘উৎক্রোশ’।
শুভ্রা তখনো চেঁচাচ্ছে
বারান্দায়।
খুব ভালো লাগলো। মনের মতো।
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা আপনাকে।
উত্তরমুছুন