হারাধনের বউ
হারাধনের বউ নেই কিন্তু হারাধন নিজে আছে। ঐ যে দোতলার
বারান্দা, ছোট চেয়ার, দুপুর রোদ আপন মনে খেলছে –
না, এখানে হারাধনের কোনও কর্তৃত্ব নেই। যদিও রোজ সুয্যি ওঠার
অনেক আগেই তার ঘুম ভাঙ্গে, তবু হারাধন খুব সুখেই
বেডরুমে ভাল ফ্লাওয়ার ভাস, ভাসে লালফুল, রুম ফ্রেশনার, চাকাওয়ালা মাঝারি টেবিল ,
টেবিলে বাজার চলতি তিন রকম ম্যাগাজিন,
নামী কোম্পানীর কলম, কালী ঠাকুরের ল্যামিনেটেড ছবি ইত্যাদি সুন্দর করে শুধু যে
সাজিয়ে রেখেছে তা নয়, কাজের মেয়েটাকে পইপই
করে দু’বেলা এসব ঝাড়াপোঁছা করার কড়া হুকুমও দেওয়া আছে।
কাজের মেয়ে লক্ষ্মী্র আজ মন ভাল নেই। রোজ রোজ কাজ করতে কারও
ভাল লাগে? যতদিন জ্ঞান হয়েছে , কাজই করে যাচ্ছে কেবল। রান্না করা
বাসন মাজা ঘর ঝাঁট পোঁছা করা কেউ ডাকলে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেওয়া
হারুদার মোবাইল রিসিভ করা বাজার করা, আরও আছে তারপর – সুইগী অ্যাপসটা এখনও ডাউনলোড
করা যাচ্ছে না । করতে পারলে রান্নাবান্নার
হাত থেকে দু’বেলাই রেহাই। সকাল
বিকাল দুপুর যখন খুশী রেডিমেড রান্না মুখের সামনে হাজির। একটা কল শুধু। ব্যস্! কিন্তু
আজ আবার নেট এত স্লো যে লক্ষ্মীর মেজাজটাই বিগড়ে যাচ্ছে... ধুর! রাস্তায় পা দিতেই পাকড়াও করল চ্যাটার্জিবৌদি।
ফোন ধরিস না কেন রে? মো্বাইল কই তোর দেখি ?
মানে... ইয়ে! আমার এখন ডিপ্রেশন হয়েছে। মো্বাইল ধরতে
মানা!
কে মানা করল? ডাক্তার?
হ্যাঁ গো! ডাক্তারই মানা করেছে। নইলে আর কারও কথা আমি
কানে তুলি?
কিন্তু মুখে এ কথা বললেও লক্ষ্মীর হাড় জ্বলে যাচ্ছে, মনে
মনে উচ্চারণ করল – বেদো মেয়েছেলে, এ
জন্মেও তোর দরজা আর মারাবো না! কত্ত শক! আমার মোবাইল দেকবে!
ভ্রু কুঁচকে বৌদি আস্তে আস্তে বলল, গেল মাসে যে হাজার
টাকাটা ধার নিয়েছিলি, সেটা শোধ করবে কে? তুই না তোর ডাক্তার?
গ্যাঁড়া এবং গম্ভীর প্রকৃ্তির বিনয় ডাক্তার ততক্ষণে পুরনো
মরচে ধরা সাইকেলটা বাউন্ডারী ওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে মনে মনে ভাবছে, আজ
কি কোনো রুগী আসবে? অন্তত একটা রুগী এলেও চেম্বারে যাবার খরচাটা ওঠে।
ডাক্তারের পসার নেই। উপরন্তু আকাশে এখন হঠাৎ মেঘের আনাগোনা। মাঝে মাঝে মনে হয়
ডাক্তারী ছেড়ে সাইকেল রিপেয়ারীং শপ করলেও না হোক দু’একজন খদ্দের ঠিক জুটত। দুটো পয়সা আসত হাতে। আর মাম্পির মায়ের তিরিক্ষি
মেজাজটাও কিছু নরম থাকত। আর
মাম্পিকেও দিনে রাতে বই মুখে করে পড়ার টেবিলে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকতে হত না। স্কুল থেকে এসেই দুটো ভাত
মুখে দিয়েই মাম্পিকে পড়তে বসে যেতে হয়। মায়ের কড়া হুকুম।
মা আর আগের মত রাগী নেই। ভুল হল। মা এখন আগের
চাইতে অনেক বেশি রাগী, কিন্তু মাম্পির ওপরে মা একদম রাগ দেখায় না। উলটে মাম্পিকে
নানা রকম গল্প শোনায়। মাম্পির এবার এগার ক্লাশ। আসছে বছর
বোর্ড পরীক্ষা।
পিঠোপঠি অল ইন্ডিয়া জয়েন্টও আছে। জয়েন্টে মেডিকেল পেতেই হবে। পেয়ে গেলেই
সোজ্জা ব্যাঙ্গালোর। চোখ
ঘুমে ঢুলে আসে, তবু মাঝরাত্তির অব্দি জেগে মেডিকেলের জন্য লড়ে যায়।
বাবা!
সেকি? পড়া ছেড়ে উঠে এলি যে? তোর মা কোথায়?
পাকা ফোঁড়া ফেটে গেলে যেভাবে গলগল করে পুঁজ বেরিয়ে আসে, ঠিক
সেভাবেই মাম্পি উত্তর দিল, ব্যাঙ্গালোরে। অনলাইন কম্পিউটার কোর্স শিখছে।
মানে?
মানে কামিং সাড়েচার বছর আমি যখন ব্যাঙ্গালোরে মেডিকেল পড়ব,
মাও কোনও একটা কোম্পানীতে বেসিক জব করবে। তুমি তখন এখানে খুব হিজিবিজি হয়ে যাবে বাবা!
তাই আবার হয় নাকি?
হয়ই তো! তুমি আমি মা, মাত্র এইটুকুতেই আমরা শেষ। কিন্তু বাবা
আমরা ব্যাঙ্গালোরে চলে গেলে তুমি যেন নিজেকে ঘেন্না করা শুরু কোর না প্লিজ!
এসব জানলি কী করে বল তো? কে বলল?
মাথা নামিয়ে মাম্পি উত্তর দিল, হারাধন জ্যেঠু!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন