কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৩৭)


ধারাবাহিকতা থাকে না। ধারাবাহিক হয়ে উঠবার তীব্র আর্তিতে ধারাবাহিকতার ধারাবর্ণনার মধ্য দিয়ে একধরনের ধারাবাহিকতাই হয়তো এসে যায়। ঝাপসা সব  গোলোকধাঁধার বৃত্তায়নে কবেকার এক কাঠপুল আর পুল থেকে নেমে এসে হাটগঞ্জের ভিতর যাওয়া। ধুলো ওঠার ব্যঞ্জনাময়তায় আটকে থাকা বিষণ্ণ বিবর্ণ ইটচাপা ঘাসের মায়াবন থেকে ভেসে আসে মোরগলড়াই পর্ব। এইসব ঘটনাক্রম থেকে জটজটিল ধাঁধার মতো এক পৃথিবী আবহমানের কালখণ্ড হয়ে জেগে উঠতে থাকে। মোরগলড়াই শেষ হয় তবে মোরগডাক থামে না। হাটের বিস্তার পেরিয়েও বিস্তারময়তার অচেনা কুয়াশাঘোরে বহু দূর থেকে দূরাগত হাওয়ার অনন্য নকসার সাজে সেজে ওঠে সবকিছু। ডুবে যাওয়ার অবকাশটুকুও দেয় না, কেবল জলজলায় কোরাসের অনবদ্যতায় সন্ধেগুলি রাত্রিগুলি ভোরগুলি হাতড়ে হাতড়ে তুলে আনতে চাওয়া ব্যাকুল সব পুঁথিপত্র, কথকথা।

কথকথাগুলি তুলোবীজ ফেটে উড়তে থাকে আকাশময়। আঞ্চলিক ইতিহাসের অনুসন্ধান করতে গিয়ে ধানমাঠ এলুয়া কাশিয়ার ফুল লোকগাথার পুতুল ভগ্নসব হর্ম্য অট্টালিকা দালানকোঠার বহুস্বরিক এক ভুবনায়ন বর্ণময় হাটগঞ্জকোরাসের উষ্ণতর উত্তাপের ওম পোহাতে পোহাতে বসন্ত মালির ঢোল ও বাঁশিতে ঢেউ তুলতে থাকে। এইভাবে গানসমগ্রের মধ্যে এসে দাঁড়াতে হয়। পথঘাট জুড়ে অনন্যতার ধুলো ওড়ে। ধুলোতে ঢেকে যাওয়া স্মৃতিসকল ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে অংশত দৃশ্যমানতা অর্জন করতেই কৌম সমাজের যৌথতার লীনতাপটুকু অন্তত টের পাওয়া যায়। রাতের পাখিরা ডেকে ওঠে বন্ধ চোখের ভিতর। বাঁশবনে সংখ্যাতীত জোনাক জ্বলে। মোমবাতি জ্বেলে কারা যেন খুলে বসে কবেকার সব ধারাবাহিকতা হারিয়ে বসা মেঘনদীবাজনার গান




(৩৮)


হেরম্ব হেঁটে যাচ্ছে শূন্য সব মাঠপ্রান্তরের মধ্য দিয়ে। হেঁটে যাওয়াটা তার  নেশা, জীবনের সাথে তীব্র জড়িয়ে থাকা; যেন অন্তহীন এক ভবিতব্য। হেরম্বর ঝাঁকড়া চুল সুপারিগাছের মতো পেশীবহুল নির্মেদ শরীর। ধারালো বল্লমচোখ। মঙ্গোলয়েড মুখ। দু’চোখে ঢের মগ্নতা আপাত বিষাদছোঁয়ানো। হেরম্ব হেঁটে যেতে থাকে মাইলের পর মাইল হেলাপাকড়ি বাঁকালী রামসাই জোড়পাকড়ি ভোটবাড়ি রাজারহাট চূড়াভাণ্ডার পদমতীর চর বরুয়াপাড়া জল্পেশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ধানপাটতামাকের অত্যাশ্চর্য জনপদগুলির মধ্য দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে ধরলা জর্দা বালাসন সানিয়াজান এইসব আঞ্চলিক নদীর জলে নেমে পড়ে সাঁতার কাটে, আবার কখনো ঘোড়াহাগা বিলে দু’দন্ড নিজের মুখ দেখে আবারো হাঁটতে থাকে হাওড় বিল কুড়া দহের দিকে। হাঁটাই হেরম্বের নিয়তি, যেন নিশিডাক। হাঁটা শেষ হয় না, তবে একসময় হাঁটাটাই যেন  এসে ঢোকে বিষহরা গানের আসর জল্পেশ মেলা কিংবা ভান্ডানী ঠাকুরের থানে। এইভাবে উত্তরের এক ভূমিপুত্র শ্রীহেরম্বচন্দ্র বর্মন তার আত্মপরিচয় ও উৎস খুঁজতে শুরু করে একধরনের ঘুমঘোরের বাধ্যবাধকতাহীন অনিবার্যতায়। তখন পাটখেত  গমখেতে বৃষ্টির জমা জলে কিলবিল করে হেলেসাপ জলঢোড়া সোনাব্যাঙ কোলাব্যাঙ আর লোকজসুরের বহতায় বেজে ওঠে আদিঅন্তহীন সব গান। তিস্তাপাড়ের গ্রামে গ্রামে তিস্তার চরে চরে সারাটা বৈশাখ মাস জুড়ে তিস্তাবুড়ির গান জাগে, মেচেনী খেলায় মেতে ওঠে মেয়ে বউয়ের দল। অলংকৃত ছাতা মঙ্গলকলস দলবদ্ধ নাচের মোহগ্রস্থতায় সীমাহীনতায় হাই তুলতে তুলতে এগিয়ে আসে নদীজলবাহিত চিরায়ত কুয়াশার দলাপাকানো শূন্যতারা। এতকিছু ঘটে যায় হেরম্বের  আপাত নিরীহ পদযাত্রার প্রায় পুরোটা জুড়েই




(৩৯)


হাট বসে হাটের মতো। হাটের পরিসর এসে, স্পর্শ করে মন্দির, বৃহৎ জলাশয়। হাতের মধ্য দিয়ে মেচেনী খেলতে যায় মেচেনী দল। ঢাক বাজে। মুখাবাঁশি। সানাই। হাটের নিজস্বতায় মিশে যেতে থাকে লোকবাজনার সমগ্রটুকু। এতসবের যথাযথ হেরম্ব এসে পড়ে। দু’দশ বিশ পঞ্চাশ হাটগঞ্জ ঘোরা হেরম্ব হাটের রকমফের ও বদলটুকু অনেক অনেক আগে কিছু কিছু হাটে সে দেখেছিল কোচবিহারের মহারাজার শিকারযাত্রার মিছিল, কামতাপুরের জুলুস, রাণী অশ্রুমতীর জলসত্র উদ্বোধন, নুরুদ্দিন জোতদারের সফেদ হাতি, ঝামপুরা কুশানীর কুশাণযাত্রা আরো আরো অনেক কিছু। আবার হেরম্বের সাথে জলধোয়া বসুনিয়ার প্রথম দেখাসাক্ষাত এরকমই কোনো হাটে। হাটের খন্ড অনুখন্ড উপখন্ড জুড়ে কতরকমের মানুষজন কথাবার্তা খোসপাঁচালি। হাটের নিজস্ব ভাষায় হাট কথা বলে যায়। কথাবার্তার সূত্র ধরে না দিলেও কথাবার্তা গড়াতে থাকে যেভাবে রাত গড়ায়। সকালের হাট বিকেলের হাট সন্ধ্যের হাট সব ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে ভাঙা হাট। হাট ভাঙার অবসরে কূপির ছড়ানো ছড়ানো খন্ড আলোর দোলাচলে হেরম্বর মনে পড়ে জলধোয়া বসুনিয়ার গরুর গাড়িতে চড়ে আরো আরো পাইকার ব্যাপারীর সাথে ভাঙা হাটের ধুলো ও বিষাদ মেখে গন্তব্যহীন কোনো গন্তব্যের দিকে চলে যাওয়া। হেরম্ব বসে  থাকে না; দাঁড়িয়েও নাআসলে থিতু হতে না পারবার অনাবশ্যকতায় সমগ্র অস্তিত্ব  দিয়ে শরীরময় শ্যাওলার বহুবর্ণতা নিয়ে আবহমান জীবনের দিকে পা বাড়ায় হেরম্ব। তখন তার কোনো অতীত বর্তমান থাকে না, ভাবনাস্রোত লুপ্ত হয়ে যায়। হাটের  চারপাশে ধানমাঠসরসে বাগিচা পুকুরদহ সবই গ্রাস করতে এগিয়ে আসে গাঢ় এক অন্ধকার, যা চিরায়ত। হাট থাকে হাটের মতো। হাটের গভীর থেকে গহন এক হাটই যেন উঠে আসে




(৪০)


হেরম্ব হেঁটে যায়। কান্নার পর কান্না পেরিয়ে শীত বর্ষা বজ্র ঝড় সবকিছু সঙ্গে নিয়ে মাইলের পর মাইল। যাত্রাকালীন সময়পর্বে কত কত লোকমানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়। দেখা হওয়াটা বড় নয়। দেখা তো হতেই পারে। দেখা হওয়ার মধ্যে আবশ্যিক সুত্রসংযোগ অতিজরুরী ভাষ্যপাঠের মতো সংগত হয়ে উঠতে থাকে। একেক হাট থেকে গোলকধাঁধার বৃত্তায়ন ভেঙে ভেঙে বিচিত্রতর সব হাট হেরম্বর উল্লম্ফন ধ্বনি-প্রতিধ্বনির চিরন্তনতার মতো ঘোর তৈরী করে। জলধোয়া বসুনিয়া আব্রাহাম মিনজ অথবা মেচেনীবুড়ি বুধেশ্বরীর উষ্ণতায় আন্তরিক হয়ে উঠতে থাকবার এক রসায়নে নদীমাঠ প্রান্তর গঞ্জহাট টাট্টুঘোড়া গরুর গাড়ির হ্যাঁচোর প্যাঁচোড় সমস্ত আবডাল টপকে পুনরাবৃত্তির মধ্যে ডুবে যেতে চায় বারংবার। হেরম্ব হাঁটতে থাকে, সর্বঅঙ্গে মাখতে চায় কেবল জীবন আর জীবন। নদীর শুকনো খাতে ভাবনাকাশিয়ার বনের মধ্যে মানুষের পায়ে পায়ে জেগে ওঠা নতুন নতুন সব পথ ধরে ধরে তার হেঁটে যাওয়া অন্তহীন ও অতিজীবন্ত ছবির মতো আবশ্যিক হয়ে ওঠে। আবশ্যিকতার বাঁকানো অংশগুলিতে কুশাণ পালার মেয়েরা কখনো নেচে ওঠে গানের সুরে সুরে। নদীর কিংবা নদীখাতের খুব গোপনতা থেকে দোতারা বাঁশিও বেজে উঠতে পারে। বেজে ওঠার সাবালকত্বের জন্য অপেক্ষা না করে হেরম্ব, এগিয়ে যেতে থাকে হাঁটাপথে। জলধোয়া বসুনিয়ার সখ্যতাকে অস্বীকার করা যায়; উপস্থিতিকেও। এই মতন ভাবনাকে প্রামাণ্যতার সহজিয়ায় ভাসিয়ে দেবার সুযোগ কখনো আসলেও সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করবার আগ্রহকে সামগ্রিক এক জলবর্ষায় মিশিয়ে দিতে চাইবার প্রাণপণ আকুতিটুকু বুকের খুব নিজস্ব নিভৃতিতে ক্রমাগত আগলে রাখতে চায়  হেরম্ব। আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে রহস্যময় জীবনকথার জালে প্রবেশ করতে গিয়ে সে কিন্তু তার সততাটুকু হারায় না। হেরম্ব হেঁটে যায় অতিবিরল এক দৃশ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন